Amit Ghosal

Drama Classics Inspirational

4.4  

Amit Ghosal

Drama Classics Inspirational

নুন ভাতের নিমন্ত্রণ

নুন ভাতের নিমন্ত্রণ

13 mins
1.2K



সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় উজান I বেশ কিছুক্ষন ধরে টিভির রিমোটের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও কি বা কোনটা দেখা যায়, স্থির করে উঠতে পারলোনা I

আসলে প্রশ্ন যখন অনেক গুলো থেকে একটা বেছে নেওয়ার, তখনি হয় মুশকিল I স্যাটেলাইট চ্যানেল আর ডিশ এন্টেনা আসার আগে, টিভি তে ছিল সবে ধন নীলমনি একটি হিন্দি আর একটি বাংলা চ্যানেল, তাই ঘর সুদ্ধ সবাই একসাথে বসে দেখতো I সে রামায়ণ মহাভারত ই হোক, বুধবার আর শুক্র বার সন্ধেবেলার চিত্রহারই হোক অথবা রবিবার বিকেলের সিনেমাই হোক I

এখন দিন কাল পাল্টেছে, সঙ্গে পাল্টেছে আমোদ আহ্লাদের সংজ্ঞা I সবার ড্রয়িং রুমের টিভিই এখন ডিশ এন্টেনা আর সেট টপ বক্স কে অতীতে ফেলে ওটিটি তে ঢুকে পড়েছে I প্রাইম, নেটফেলিক্স, হটস্টার, হইচই, সবাই হাজির যে যার পসরা নিয়ে I সিরিজ থেকে শর্ট ফিল্ম, কমেডি থেকে রমেডি, হাই ফাই থেকে সাই ফাই; সব মিলিয়ে মহা মোচ্ছব; রিমোটের বোতামের এক টিপুনিতে টিভির পর্দায় 'লাইভ'; কোন টা ছেড়ে কোনটা দেখি !!

উজানের অবস্থাও খানিকটা সেইরকমই I নিউজ থেকে নাচন কোঁদন, এনিম্যাল থেকে এলিয়েন, ক্রিকেট থেকে কারাওকে - সবখানে ঘুরে ফিরে, শেষটায় থুক্কুম দেয় I ওর খিদে পেয়েছে; তাই বোধ হয় টিভিতে মন বসছেনা, ড্রয়িং থেকে ডাইনিং এর দিকে হাঁটা দেয় I

প্রেসার কুকারে ডাল বসানো, গরম করার জন্য তরকারি ফ্রিজ থেকে বের করে টেবিলে রাখা; কিন্তু, কিচেনে কেউ নেই; স্টাডির আলো জ্বলছে I তিস্তা এখনো স্টাডিতে কি করছে !! সাড়ে আটটা বাজে I সাধারণতঃ ওরা আটটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নেয় I তিস্তা স্কুল থেকে ফেরে ছটা নাগাদ আর উজানের ফিরতে ফিরতে ৭ টা হয়ে যায় I আজও তাই হয়েছে I কিন্তু তিস্তা এখনো বেরোয়নি কেন !!

উজান একটু জোরে ডাক দেয়, 'তিস্তা খেতে এসো' I

'আস্ত ছাগল একটা', স্টাডি থেকে আওয়াজ আসে I

'মানে??, আমিতো তোমাকে খেতে ডাকছি '. রাগত স্বরে, বেশ গলা চড়িয়েই উত্তর দেয় উজান I

খানিকখন পরে উজান আবার হাঁক দেয়,'তুমি কি আসছো?'

স্টাডি থেকে উত্তর আসে, 'বেহায়া, বাঁদর' I

উজানের রাগটা বাড়তে থাকে, কিন্তু কিছু বলে না . . .

‘গবেট, গর্ধব’ I আবার তিস্তার গলা স্টাডি থেকে I

এবার উজান ধর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় I ওর ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে I একে পেটে খিদে, তার উপর, তিস্তার আজে বাজে কথা I দাঁতে দাঁত চেপে সে কোনো উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকে I অনাবশ্যক জোরে জোরে শব্দ করে খাবার গুলো মাইক্রোওয়েভ চালান দেয় I

 টাইম সেট করার রেগুলেটর টা একটু বেশিই জোরে মুচড়ে দেয় সে I

বেসিনের কল খুলে, চোখে মুখে খানিক জল দেয় পেটের থেকে ভিসুভিয়াসের মতো উপরে উঠতে থাকা রাগটাকে বাগে আনার জন্য I

আর ঠিক এই সময় টাতেই, স্টাডি থেকে তিস্তার ছুঁড়ে দেওয়া কিছু বাছা বাছা আরেক প্রস্থ শব্দ উজানের কানের পর্দার উপর আছড়ে পড়ে -

' টেনে একটা চড় কষিয়ে দিতে হয়. . . .'

এরপর যা হওয়ার তাই হলো I প্রেসার কুকারের সিটির শব্দ. . . আর সেই শব্দকে ছাপিয়ে, উজানের পরিত্রাহী চিৎকার !!

কি হয়েছে কি তোমার ?

তখন থেকে যা নয় তাই বলছো ??

আমি তো তোমাকে শুধু খেতে ডেকেছি !!!

আমাকে এসব বাজে কথা গুলো বলার মানে কি ?

তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি???

এক নাগাড়ে সমস্ত রাগ উগরে দিয়ে থামলো উজান I

ওর গলা শুকিয়ে এসেছে, ফুসফুসেও খানিকটা অক্সিজেন দরকার I

টেবিলে রাখা জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ায় . . .

ঢাকনা খুলে জলটা গলায় ঢালবে, এমন সময়, স্টাডির দরজা খোলে, পর্দা সরে, লাইট নেভে এবং তিস্তা বাইরে বেরিয়ে আসে I

ওর এক হাতে স্কুলের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন পেপার, অন্য হাতে এক তাড়া এনসার শীট | মুখের ভঙ্গীটা অনেকটা ত্রাণ শিবিরে থাকা আফগান মহিলার মতো I

এমনিতে তিস্তা দেখতে বেশ সুন্দর; বেশ বড়ো বড়ো চোখ, ঘন ভুরু, যেন তুলি দিয়ে আঁকা, গালে টোল পড়লে ভারী মিষ্টি দেখায় I কিন্তু এখন সেই সুন্দর মুখে ক্ষোভ, দুঃখ, রাগ, অনিশ্চয়তা আর হতাশার ছাপ স্পষ্ট I

ও কোনো রকমে উজানের কাছে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে অস্ফুটে কিছু একটা বলতে গিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে I আর উজান ওর চওড়া বুকে তিস্তাকে আশ্রয় দিয়ে ডাইনিং হল কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে I

তিস্তার আজে বাজে কথা গুলো বলার কারণ এখন পরিষ্কার I সে ওর স্কুলের টার্ম পরীক্ষার খাতা দেখতে বসেছিল I ইলেভেনের খাতা I আর খাতাতে ওর ছাত্ররা উত্তর হিসেবে যেসব অমূল্য মনি মুক্ত ছড়িয়ে রেখেছে তা পড়তে পড়তেই ওর ওই প্রতিক্রিয়া I

বেশ খানিকটা সময় তিস্তা আর উজান একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে I আর উজান তিস্তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় I কেউ কোনো কথা বলেনা I কিন্তু এই নীরবতা ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলে দেয়. . . . একের প্রতি অন্যের সম্মান, ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা I

তিস্তা একটা সরকারী স্কুলে ইংরিজি পড়ায় I স্কুল টা ওদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে I টোটো বাস ট্রেন ইত্যাদিতে চেপে আদ্ধেক কলকাতা জয় করে ও প্রতিদিন স্কুলে যায় এবং ফেরে | যাতায়াতের পরিশ্রম আর সময় - দুটোই যথেষ্ট বেশি I পড়ায়ও যথেষ্ট মন দিয়ে I তার বিনিময়ে প্রাপ্তি ছাত্রদের ভুলে ভরা এই সব উত্তর পত্র I

উজানও ওর অবস্থা দেখে কষ্ট পায় I খেতে খেতে বলে, 'সরকারী স্কুলে একা তুমি কিছুই বদলাতে পারবেনা তিস্তা, একটা ক্লাশ একশো জন ছেলে, ও ভাবে কি হয়? 'চাকরীটা এবার তুমি ছেড়েই দাও, আমার স্যালারি তো এখন যথেষ্ট বেশী, তোমাকে আর স্ট্রেস নিতে হবেনা' I

সেটা যে তিস্তা বোঝেনা তা নয়, কিন্তু ও কিছু বলেনা I চুপ চাপ খেয়ে নিয়ে হাত ধোয় I

একটা এক্সপোর্ট হাউসের বেশ বড়ো পোস্টে চাকরি করে উজান I আর অফিসে ওর যথেষ্ট সুনাম, কাজের লোক হিসেবে I দক্ষিণ কলকাতার একটা নামী সোসাইটিতে ওদের তিন কামরার হাত পা ছড়ানো ফ্ল্যাট, সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমেত I টাকা পয়সার অভাব ওদের নেই, বরং, দরকারের চেয়ে খানিকটা বেশিই আছে I

তাই তিস্তাও মাঝে মাঝে ভাবে, 'সত্যি তো কি হবে এতো স্ট্রেস নিয়ে !! চাকরী টা বরং ছেড়েই দি I

'ঠিক বলেছো' I খাওয়ার পরে সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য বাইরে বেরোতে বেরোতে নীরবতা ভেঙে তিস্তা বলে ওঠে I প্রতিদিন এই হাড় ভাঙা খাটুনির কোনো মানেই হয়না' I ওরা লিফটের জন্য অপেক্ষা করছে; নিচে নামবে I উজান তিস্তার বাম কাঁধে আলতো করে হাত রাখে I

ওদের প্রতি রাত্রের অভ্যেস - খাবার পরে হাঁটা I আর তার জন্য, এই সোসাইটি টা আদর্শ I বেশ অনেক খানি খোলা জায়গা, যত্ন আর পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা গাছ, পিভার ব্লক দিয়ে বাঁধানো হাঁটার রাস্তা I আর ঠিক মাঝ খানটাতে টলটলে পরিষ্কার জলে ভরা একটা সুইমিং পুল I পুরো সোসাইটি খানি ছ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, গেটে সিকিউরিটি গার্ড আর স্থানে স্থানে সিসি টিভি ক্যামেরা I অনেকটা রাত অব্দি হেঁটে চলে বেড়ালেও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হয়না I

গালের উপরে চলে আসা চুলগুলো আলগোছে কানের পেছনে সরিয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটে তিস্তা বলে চলে, 'সত্যিই তো !! আমি কেন করছি এই চাকরি'?


প্রতিদিন দু ঘন্টা করে লোকাল ট্রেনে ধাক্কা খাও

স্কুলে পাঁচটা ছটা করে ক্লাস

প্রতি বছর তিনটে ক্লাসে চারবার করে পরীক্ষা;

তার কোয়েশ্চন করো, খাতা দেখো

নাম মাত্র টাকায় মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখো

মে মাসের গরমে বিনা ফ্যানে ক্লাস নাও . . .

তিস্তা চাকরি না করার একশো আটটা কারণ পুরো না করে থামবে বলে মনে হয়না I

উজান কিছু বলেনা I শুধু তিস্তার পাশাপাশি হাঁটে I ও জানে তিস্তা ওর স্কুল আর স্কুলের ছেলেদর কতটা ভালোবাসে I আর স্কুলটা ওর জীবনের কতখানি জুড়ে আছে I


রাত একটা বাজে I উজান ঘুমিয়ে কাদা I ও খুব ভোরে উঠে দৌড় দৌড়ি করে, তারপরে জিমে যায় I ওর দর্শন খুব পরিষ্কার I ' কষ্টের রোজগার, ডাক্তার কে দেবোনা' I তাই রোজকার শরীর চর্চা I

কিন্তু তিস্তার চোখে ঘুম নেই I

ও আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে, আলো না জ্বালিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে শোবার  ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্টাডি তে ঢোকে এবং সন্ধে বেলার দেখা খাতা গুলো তুলে নিয়ে আবার চোখ বোলাতে শুরু করে I

প্রথমেই একেবারে মোক্ষম খাতাটি হাতে এলো I রত্নটির নাম অর্ক প্রভ রায় I সাদা বাংলায় যাকে বলে হাড় জ্বালানী, ঠিক তাই I যেমন দামড়া মতো ষণ্ডা মার্কা চেহারা, মাথাটিও ঠিক তেমনিই নীরেট I কোনো রকমে মাধ্যমিকের খাল টি ডিঙিয়ে ইলেভেনে এসে জুটছে I পেছনের বেঞ্চে যেভাবে বসে থাকে, তাতে অর্কের প্রভা বছর দুয়েকের মধ্যে বারো ক্লাসে পৌঁছবে বলে মনে হয়না I

'নির্জলা গবেট একটা' I তিস্তা ভাবে I আর সেই জন্যই বোধ হয়, অংকের স্যার অশোক বাবু ক্লাসে ঢুকেই আগে অর্কর খোঁজ করেন I অর্ক কে বেশ খানিক বেতিয়ে হাতের সুখ কর নেন, তারপরে ক্যালকুলাস শুরু করেন I

তবে আশ্চর্যের বিষয় টা হলো, অর্কই প্রথম যে কিনা প্রত্যেক শিক্ষক দিবসে সবার আগে স্টাফ রুমে এসে অশোক বাবুকে প্রণাম করে আর অশোক বাবু ব্যাগ থেকে একটা লজেন্স বার করে অর্কর হাতে দেন I

সব কিছু সিনেমার রিলের মতো তিস্তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে I মাস ছয়েক আগের ঘটনা. . .

অশোক বাবুর রিটায়ারমেন্টের কিছু দিন আগে I উনি একদিন স্কুলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন I পরে জানা গিয়েছিলো মাইল্ড স্ট্রোক I স্কুল টা বড়ো রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে, কিছুতেই একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করে ওনাকে তক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিলোনা I বাকি টিচার রা ঘাবড়ে গিয়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেননা . . . এমন সময়ে পাজীর পাঝাড়া অর্ক ওর পিছনের বেঞ্চের আরো দু একজন সাগরেদ কে নিয়ে, তাড়াতাড়ি বড়ো রাস্তায় গিয়ে এক ট্যাক্সি ওয়ালা কে রীতিমতো ধমক ধমক দিয়ে স্কুলে নিয়ে আসে এবং অশোক বাবু কে তুলে নিয়ে সদর হাসপাতালে যায় Iঅংকে বেশী নম্বর পাওয়া ছেলে গুলোকে কিন্তু সেদিন আসে পাশে দেখা যায়নি I

সে যাত্রায় অশোক বাবুর খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়নি I দিন দশেক পর থেকে উনি আবার স্কুলে আসা শুরু করেন I

প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকে উনি পড়াতে শুরু করার পর অর্ক পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে, 'স্যার আজকে মারলেন না তো ?' শুনে অশোক বাবু অর্ক কে কাছে ডাকলেন I বেত টা আলতো করে পিঠে ছুঁইয়ে সস্নেহে বললেন, 'তোর বড্ডো বাড় বেড়েছে ' I


পুরো ঘটনাটা মনে পড়াতে, তিস্তার চোখের কোল দুটো ভিজে ওঠে I অর্ক ভালো না খারাপ তার বিচার কি শুধু ওর অংক আর ইংরিজিতে পাওয়া নম্বর দিয়েই হবে ? মানুষ হওয়ার অন্যান্য যে মাপকাঠি, সেগুলোতে তো ও এখুনি স্টার, লেটার সব কিছু পেয়ে বসে আছে !!! 'আমি কি পারিনা এই শিক্ষাটাই অন্য ছাত্রদের মধ্যেও চারিয়ে দিতে?' তিস্তা ভাবে I

রাত প্রায় দুটো বাজতে যায় I তিস্তা আড়মোড়া ভেঙে শোবার ঘরে ফেরত যাবে ভেবেও কি মনে করে আরেকটা খাতা হাতে তুলে নেয় I এটিও কোনো অংশে কম নয় I আগের জন ছিলেন অর্ক, ইনি রবি !!! এগারো ক্লাসের নবরত্নের দ্বিতীয় রত্ন I এদের প্রতিভার ছটাতে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েই বোধ হয় সুয্যি ঠাকুর প্রতি সন্ধ্যায় একবার করে মুখ লুকোন !!


রবির খাতাতে প্রায় সব গুলো বানানই ভুল | একদম রফতানি যোগ্য মগজ !! কি করে পারে কে জানে !!!এমন কি ইন্ডিয়া বানান টা পর্যন্ত ভুল !!! ইন্ডিয়া বানানের দ্বিতীয় 'আই' টা মিস্টার ইন্ডিয়ার মতোই বেমালুম উবে গেছে !!!

খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতোই মরিয়া হয়ে তিস্তা পুরো খাতাটা চিরুনি তল্লাশি করে ফেলে একটা ঠিক বানানের আশায় !! সেটা ও খুঁজে পায়না, তবে ছেলেটার ব্যাপারে একটা ঘটনা তিস্তার মনে পড়ে যায় I ওদের ক্লাস টা থাকে ঠিক টিফিনের পরে আর রবি প্রায় দিনই দেরি করে ক্লাসে আসে আর সেটাও প্রায় দশ পনেরো মিনিট I

তিস্তা বকা ঝকা, নীল ডাউন, কান ধরে দাঁড়ানো কোন ভাবেই ওর অভ্যেস বদলাতে পারেনি I শেষে নিরুপায় হয়ে রবির ক্লাসে ঢোকা বন্ধ করে দেয় I আর সে ও অভ্যেস মতো পনেরো মিনিট পরে এসে চুপ চাপ ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে I ক্লাসের ভেতরে অন্য ছেলেরা হাসা হাসি করে, ও ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকায় I

এভাবেই চলছিল. . . কিন্তু একদিন . . .


সেদিন তিস্তার কোনো কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার দরকার ছিল I তাই সে টিফিনের পরেই স্কুল থেকে বের হয় I স্টেশনে এসে একটা খালি বেঞ্চ দেখে বসে পড়ে I ডাউনের ট্রেন আস্তে এখনো মিনিট দশেক দেরী I খানিক পরে ট্রেন ঢোকার এনাউন্সমেন্ট শুনে ছাতা ব্যাগ ইত্যাদি সামলে উঠে দাঁড়ায় I

ট্রেন তখনো রীতিমতো জোরে ছুটছে , একটা ছেলে অনেক গুলো বই হাতে করে খুব বিপজ্জনক ভাবে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে, বইগুলো প্লাটফর্মে ছড়িয়ে যায় I ঘটনাটা ঘটলো তিস্তা যে কামরা টা তে চড়বে তার পরের পরের দরজাটার মুখেই I

একি!! এতো রবি !!! আর একটু হলেই তো কাটা পড়ছিলো !!!

তিস্তার আর ট্রেনে ওঠা হয়না I আরো কিছু লোকের মতো সেও রবির দিকে এগিয়ে যায় I রবির হাঁটু আর কনুই ছোড়ে গেছে I কপাল টা ফোলা I স্টেশনের বুক স্টলের লোকটা তো এই মারে কি সেই মারে !! রবির হাত ধরে ওর দোকানের সামনে এনে বসায়, জল খাওয়ায় I

'তোকে না কত দিন বলেছি, ট্রেন পুরো না থামলে হাতে বইয়ের বোঝা নিয়ে এভাবে লাফিয়ে নামবিনে I তবু তুই কথা শুনিস না I বুক স্টলের লোকটা রবির শুশ্রূষা করতে করতে বলে I

'ও, তাহলে এই জন্যই তোর ক্লাসে আস্তে দেরি হয়'I রবি বা বুক ষ্টল ওয়ালা কেউই তিস্তা কে খেয়াল করেনি I ওর গলার আওয়াজ পেয়ে রবি একটু কুঁকড়ে যায় I বুক স্টলের লোকটাও একটু সরে দাঁড়ায় I সে ম্যাডাম কে চেনে আর স্কুলের ম্যাডাম বলে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে I

সে তিস্তা কে বলে, 'জানেন ম্যাডাম, আমি ওকে কতবার বলেছি, তুই তোর ম্যাডাম কে আর হেড স্যার কে বল, টিফিন পিরিয়ডে ট্রেনে বই ফিরি করিস তাই তোর ক্লাসে আস্তে একটু দেরি হবে, কিন্তু ও কিছুতেই বলবেনা | উল্টে, প্রতিদিন এরকম প্রাণ হাতে করে ট্রেন থেকে লাফায় I ক্লাসে যাতে দেরী না হয় সে জন্য I আমি আর তোকে কাল থেকে বেচার জন্য বই দেবোনা' I লোকটা থামে I

রবি খানিকটা ধাতস্ত হয়েছে I খুব আস্তে আস্তে বলে, 'ম্যাডাম আমি ভয়ে বলিনি, এত বড়ো স্কুলের ছাত্র হয়ে হকারি করি শুনলে যদি আপনারা স্কুল থেকে বের করে দেন!!'

তিস্তা ওর পাশে বসে রবির মাথায় হাত রাখে, তাতে খানিকটা ভরসা পেয়ে ও পুরো ব্যাপার টা খুলে বলে I মোদ্দা ঘটনাটা হলো - ওর মা বাবা নেই I রবি আর রবির ভাই কাকার বাড়িতে থাকে I কাকা বলে দিয়েছে, সে যেকোনো একজনের পড়াশোনার দ্বায়িত্ব নিতে পারবে | যেহেতু ওর ভাই লেখা পরে ভালো, তাই, রবি কাকাকে বলেছে ভাইকে দেখতে, ওর পড়াশুনোর খরচ ও নিজেই জোগাড় করে নেবে I আর সেই জন্যই ট্রেনে ট্রেনে এই পার্ট টাইম বই বিক্রী . . .

তিস্তা খুব যত্ন করে রবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, 'কাল থেকে তুই দেরী করেই ক্লাসে আসিস I কিন্তু খবরদার, ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামবিনা I আমি হেড স্যারের সাথে কথা বলে নেবো I

বুক স্টলের লোকটা তত ক্ষনে, রবির জন্য এক গ্লাস গরম দুধ আর তিস্তার জন্য এক কাপ চা নিয়ে হাজির | রবি এখন অনেকটা স্বাভাবিক I জিজ্ঞেস করে, 'ম্যাডাম, আজকে আপনি ক্লাস নিলেননা ?'

'না রে, আজকে আমি ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, আজ আমার জন্ম দিন ' I

রবি তাড়াতাড়ি ওর পড়ে যাওয়া বইগুলো থেকে একটা বই খুঁজে নিয়ে সেটা স্কুলের জামাটা দিয়ে ভালো করে মুছে তিস্তার দিকে এগিয়ে দেয় I

বলে, 'ম্যাডাম, আপনার জন্মদিনের উপহার –

উইংস অফ ফায়ার'

ডাব্লিউ আই এন জি এস - উইংস

ও এফ - অফ

এফ আই আর ই - ফায়ার

এবার আর রবির একটা বানানো ভুল হয়না I

তিস্তা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে I বইটাকে বাগে ঢোকায়না I দুই হাতে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ট্রেনে ওঠে I

পেছন থেকে ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে রবির গলা 'হ্যাপি বার্থ ডে ম্যাডাম . . . ' I


ভোর হয়ে এলো I তিস্তা আর ঘুমোনোর চেষ্টা না করে উজানের সাথে বেরিয়ে পড়ে I সকালের নরম আলো আর মিঠে বাতাস মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে দেয় I তিস্তা হাঁটতে হাঁটতে রাতের ঘটনা টা উজান কে বলে I উজান একটু মুচকি হাসে, কিন্তু কোনো উত্তর দেয়না I শুধু তিস্তার হাত টা একটু চেপে ধরে I খানিক পরে বলে -

' তিস্তা আজ আমি তোমাকে স্কুলে ড্রপ করে দেব 'I

ভোরে ওঠা প্রথম সূর্যের আলোয় তিস্তার মুখটা ভীষণ উজ্জ্বল আর চকচকে দেখায় I রাত জাগার ক্লান্তির লেশ মাত্র নেই I


উজানের গাড়ি থেকে নেমে স্কুলে ঢোকার রাস্তার বাঁকের মুখে তিস্তা অন্যান্য দিনের মতো আজকেও সেই হাসি মুখের বৃদ্ধা কে দেখতে পায় I ভিক্ষে করে; কিন্তু আজ ওর হাতে ভিক্ষের বাটি টি নেই I ভিক্ষে করে খেলেও এই বুড়ি আর পাঁচটা ভিখারীর থেকে একটু আলাদা I পরনের শাড়িটি শতছিন্ন কিন্তু পরিষ্কার | মুখে হাসি লেগেই থাকে | আর যে যা দেয় তাতেই সন্তুষ্ট I সবাই কে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করে I

যখনি চায়, তিস্তা ওকে দশ টাকা কুড়ি টাকার নোট বের করে দেয় I ও শুনেছে, ভিক্ষের উপার্জন থেকেই বুড়ি প্রতিদিন সন্ধেবেলায় আট দশ জন অনাথ ছেলেমেয়েদের একবেলা ভাত খাবার বন্দোবস্ত করে I তাই কখনো সখনো তিস্তা ওকে একটু বেশি টাকা দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করে থাকে I

আজ ও বেশ খুশিয়াল মেজাজে আছে তাই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ব্যাগ থেকে বার করে বুড়ির দিকে এগিয়ে দেয় I কিন্তু বুড়ি টাকা নিলোনা I বলে, 'আজ আমি ভিক্ষে চাইতে আসিনি' I

তিস্তা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, 'তাহলে. . . ?. .'

বুড়ি একটু আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে, 'মা তুমি যে টাকা গুলি আমারে দাও, তাই দিয়া আমার বাচ্চা গুলার একবেলা নুন ভাতের জোগাড় হয় I পরশু দিনে স্বাধীনতা দিবস, তুমি তো মা ইস্কুলে আসবেই; ফিরার পথে যদি আমার বাছা গুলার সাথে টুক দেখা করতে, ওরা আমার মুখে তোমার কথা শুনছে I

তিস্তা হতভম্ব | ঠিক কি বলবে বুঝতে পারেনা |

বুড়ি বলে, ' স্টেশন থেকে টুকু দূরেই আমার কুঁড়া ঘর, যদি মা একবার আসতে . . .

তিস্তা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ; নিজেকে গুছিয়ে নিতে ওর একটু সময় লাগে I

বুড়ি হাত জোড় করে আবার বলে, 'আসবে মা?'

তিস্তা কোনোরকমে অস্ফূটে একটা ক্ষীণ হ্যাঁ ছাড়া আর কিছু বলে উঠতে পারেনা I

বুড়ি তখনো হাত জোড় করে . . . . 'আইর একটা কথা ছিল, '. . . .

তিস্তা চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, 'কি. . '?

বুড়ি কেমন যেন ইতস্তত করে, কোনো রকমে কাঁপতে কাঁপতে বলে, আর যদি তুমি. . .

বুড়ি আবার আটকে যায় | খানিক চুপ থেকে সাহস সঞ্চয় করে বলে, 'আর যদি তুমি সেদিন আমার বাছা গুলার সাথে বসে চাট্টি নুন ভাত আর শাক ভাজা খেতে . . . ?'

তিস্তা দুই হাত দিয়ে বুড়ির হাত দুটো জড়িয়ে ধরে, ও নিজের কান্না আটকাবার কোনো চেষ্টাই করেনা |

'এইতো! এইতো !! এইতো আমি !!!

এইতো আমার দেশ !!! 

এইতো আমার ভারত বর্ষ !!!! 

এই নুন ভাতের নিমন্ত্রণ কে না বলার আমি কে !!! 

এই নিমন্ত্রণ কে অগ্রাহ্য করবো আমার সাধ্য কি !!!!

তিস্তার কিছু বলার দরকার হয়না I বুড়ি সব বুঝতে পারে I দুই হাত তুলে 'ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন' বলে আস্তে আস্তে নিজের কুঁড়ের দিকে এগিয়ে যায় . . . যেন বৃদ্ধা ভারত মা তার বাচ্ছাদের ভাতের জোগাড়ে যায় . . .


স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের পঁচাত্তর বৎসর পূর্তির অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে | ভেসে আসে গান-

'ওঠো গো ভারত লক্ষী . . .


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama