ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-27-পরাজয়ের গ্লানি
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-27-পরাজয়ের গ্লানি
যদিও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ব্যাপারটা কলেজ কর্তৃপক্ষই নিয়ন্ত্রন করেন। কিন্তু আমি তো এক অকিঞ্চিৎকর উদ্বাস্তু পরিবারের হিন্দু বাংলাভাষী ছাত্র! কোন অধ্যাপকের কাছে গিয়ে এখন আমি দারস্থ হতে পারব অনুচিত উপায়ে আমায় পাশ করিয়ে দেওয়ার বায়না জানাতে? অথবা করুণা ভিক্ষা চাইতে? অমূল্য এক শিক্ষাবর্ষ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল আমার জীবন থেকে। ভুল সম্ভবত আমারই। এই ভুলের জন্যে আমি আর কাকে দোষ দেব? হাহাকারের নীরব আর্তনাদ যেন উত্থিত হচ্ছিল বুকের ভেতর থেকে। চিৎকার করে, হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেঁদে কেঁদে যদি হতাশার জমাট কালো অন্ধকারের নিগড় থেকে কিঞ্চিৎ বিমুক্ত হতে পারি। মল্লযুদ্ধে পরাস্ত বিধ্বস্ত রাস্তার এক কুকুরের মতো ফিরে এলাম বাড়ি। বাড়ি ফিরেও নিজেকে লুকাবো কোথায়?
মা সন্দিগ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে তোর? দেইখ্যা তো মনে হইতাছে যেন মানুষ খুন কইরা আইছস?
মায়ের সামনে হাউ হাউ করে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম। পরাজয়ের গ্লানি বুকে নিয়ে হাহাকার করে উঠে বললাম, মা আমার সব শেষ! সব শেষ হয়ে গেছে আমার! ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেছে! এ বছর আর আমি পাশ করতে পারলাম না মা!
বজ্রাহতের মতো থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মা। কয়েক মুহূর্ত পরে যেন পারছিলেন না আর দাঁড়িয়ে থাকতে। বসে পড়লেন পালঙ্কের ওপরে। একটি কথাও যেন আর বলতে পারছিলেন না। কিছু একটা আন্দাজ করে পিতৃদেবও ছুটে এলেন ওঘর থেকে।
‘কী হইছে? কী হইছে?’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি।
‘তুমার গুণধর পুলা, কবে পরীক্ষা হইয়া গেছে সেই খবরও তার নাই!’ মাথা নেড়ে নেড়ে অপার নৈরাশ্যে জবাব দিলেন মা।
‘আমি তো জানি। সে তো মধুসূদন সাজবার চাইতাছে!’ ভর্ৎসনা দিয়ে উঠলেন পিতৃদেব, মধুসূদন মদ্যপান করলেও তার অনেক গুণ আছিল। অকৃত্তিম ভালোবাসা আছিল হেনরিয়েটার লগে। আর তুই যা করতাছস এইগুলারে কি ভালোবাসা কয়? এইগুলা হইল কাম, কামের জ্বালায় অন্ধ হইয়া গেছস তুই! পড়াশুনা আর করবি কোনসময়? ছাত্র বয়সে কামের আধিক্য হইলে পড়াশুনা নষ্ট হইবই!
পিতৃদেবের তিরস্কার তো নয় যেন উদগ্র ধিক্কার। আমি বুঝতে পারছিলাম না সুউচ্চ আকাশের সঙ্গে আমার মতো এক অকিঞ্চিতের তুলনা টেনে পিতৃদেবের এই ধিক্কার কী জন্যে?
মা’ও ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলেন, তুই যে সেই ছেমড়ির পিছনে পড়ছস, হেই ছেড়ি তরে সারাজীবন খাওয়াইব? কয়দিন আনন্দমার্গের পিছনে দৌড়াইয়া দিনরাইত নষ্ট করলি। আর অহন শুরু করছস পিরিত? পিরিতের জ্বালা উঠছে তর শরীরে?
হতবাক হয়ে গেলাম আমি। কীসের পিরিত, কার সঙ্গে পিরিত? প্রশ্ন করব সেই মুখও তো আর নেই আমার এইক্ষণে।
‘তোর কোন দাদাদিদিরা এরকম আছিল?’ আবারও ধিক্কার দিয়ে উঠলেন মা, তোর ছোড়দি দুই বছর ধইরা কলেজে যায়, কোনওদিন খারাপ কিছু শুনছস? তোর বড়দি, কেউ কোনওদিন তারে কিছু কইতে পারছে? কেউ তার খারাপ কোনওদিন কিছু দেখছে? আর তর দুই দাদা, তারা তো চাকরি আর পড়া নিয়াই সারাদিন ব্যস্ত। আর তুই?
‘আরে অমানুষ একটা! নকশাল, নকশাল হইয়া গেছে এইডা! মানুষের বাচ্চা এখন আর সে নাই! সে এখন..’ বলতে বলতে পিতৃদেব থেমে গিয়েও অনুচ্চারিত অশ্রাব্য তিরস্কারে তিরের ফলার মতো বিদ্ধ করলেন আমাকে।
নতুন করে কান্না ঠেলে উঠে আসছিল আমার বুকের ভেতর থেকে। মানুষের অদৃষ্ট..ভাগ্য এসব কাকে বলে টের পাচ্ছিলাম আজ আমি হাড়ে হাড়ে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
আত্মগ্লানিতে বিধ্বস্ত হয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলাম এইঘর ছেড়ে সামনের ঘরে। গোটানো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চাদর টেনে মুছে নিচ্ছিলাম চোখের জল।
এই ঘরের পাশেই আমাদের সেই পুরানো চালাঘরটি। এই চালাঘরে বসেই বেশ কয়েক বছর আগে লকড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলেন পিতৃদেব আর বড়দা মিলে। এই চালাঘরের নিচেই রাতের পাহারা বসত গন্ডগোলের সময়ে। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল এই চালাঘরের আর সংস্কার হয় না। ভূতের ডেরার মতো হয়ে পড়ে আছে।
সেই চালাঘরের নিচে এসে আচমকা খোকনকাকু বলে কে যেন আমায় ডেকে উঠল। চমকে তাকিয়ে দেখি ভাস্বতী। নীল রঙের ঘাঘরা আর গোলাপি জামা তার গায়ে।
‘খোকনকাকু কী হয়েছে তোমার, কাঁদছ কেন?’ অবাক চোখে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল।
ভাস্বতী আমার বাল্যের খেলার সাথি। কৈশোরের প্রিয় বন্ধু। আজ এই যৌবনের প্রারম্ভে সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। আমার অনেক অনেক আত্মীয় দাদাভাই-দিদিভাই, ভ্রাতা, ভাগনে-ভাগনি, ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে ভাস্বতী যেন সবার চেয়ে প্রিয় পরমতমা আত্মীয়া। অঢেল মনের কথা আমরা দুজনে মিলে ভাগাভাগি করি। পাশের বাড়ির বড়মামার বড় আদরের পৌত্রী এই ভাস্বতী। বড়মামার সাথে আমরা দুজনে একসঙ্গে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করি। বহু বছর আগের পূর্বপাকিস্তানের মামাদের দেশের বাড়ির ভূত দেখার সেসব গল্প রুদ্ধশ্বাসে বসে শুনি।
ভাস্বতী আমার চোখে যেন ছোটবেলা থেকেই রূপকথার সুন্দরী এক পরি। সবার চেয়ে বেশি লাবণ্যময়ী ও রূপসী। আমি কোনও উত্তর দিচ্ছিলাম না দেখে ভাস্বতী আমার চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্যে জানালার গারদের ফাঁক দিয়ে তার কোমল পেলব দুধে আলতা রঙের একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ওর পেলব হাতের স্পর্শে আমার কান্না যেন আরও বেশি বাধ ভাঙা হয়ে নামছিল। আর এই সময়েই মা এসে প্রবেশ করলেন ওই ঘরে। হতভম্ব মা তখন তখনি মাথা নাড়িয়ে তীব্র গলায় ভর্ৎসনা করে উঠলেন, কি যে কমু তগো দুইটারে! আর খুকন, পরীক্ষায় তো পাশ করতে পারবিই না ভালো কইরা তুই জানস! এই একটু আগেই তরে এত কইরা বকলাম, তারপরেও তর লজ্জা নাই? আবারও ভাস্বতীর লগে লুকাইয়া লুকাইয়া পিরিত শুরু কইরা দিছস? কীরকম কুলাঙ্গার ছেলেরে তুই?
মায়ের উচ্চস্বরের তীব্র তিরস্কারের নিনাদ শুনে পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন ভাস্বতীর মা। তিনিও তার মেয়েকে আমাদের ঘরের জানালার পাশে চালাঘরের নিচে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিদীর্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, এই ভর দুপুরে তুই ওইখানে দাঁড়াইয়া কী করতাছস? তরে আমি কত সাবধান করি, তোর দিদি, মামা তারাও কত বোঝায় তরে! সাবধান করে, খুকনের লগে মিশবি না, মিশবি না! তারপরেও তুই লুকাইয়া আইয়া পড়ছস খুকনের লগে কথা কইতে? তুই মইরা যাস না ক্যান অসৎ মাইয়া? আয় তুই আজ ঘরে, তর একদিন কি আমার একদিন!
ভাস্বতীর মার বিদীর্ণ গলার শব্দ পেয়ে মা পুনরায় আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সবিতা কি কইতাছে শুনতাছস ত? তারপরেও তর লজ্জা নাই, কুলাঙ্গার? তর লাইগ্যা আর কত কথা আমরার শুনন লাগব? তুই পুকুরের জলে ডুব দিয়া মরস না ক্যান? নাহইলে বিষ খাইয়া মর!
এই যেন প্রথম আমার অন্তরে নীরবে নিভৃতে অলক্ষ্যে প্রথম ভালোবাসার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম।
আর তাতে করে নিজের মনের ভেতরেই যেন আরও বেশি ধিক্কারের আলোড়ন উঠছিল আজ। না না আর নয়, থাকবই না আমি আর এই গলিত বিষ জর্জরিত এই দেশে, এই বিষাক্ত দূষিত ভূখণ্ডে। এই দেশ, সমাজ, আপনজন, প্রিয়জন, পিতা-মাতা, ভাস্বতী.. সবাইকে ছেড়ে চলে যাব আমি আমার শৈশবের, বাল্যের স্মৃতি বিজরিত ময়মনসিংহ শহরে। ময়মনসিংহ গিয়ে আমি নতুন করে ভরতি হব মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে ভরতি হব ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের স্যাররা কত ভালোবাসেন আমায়। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আমার আবৃত্তি শুনে সহপাঠীরা কত প্রশংসায় ভরিয়ে তোলে আমাকে। আমার কৌতুক অভিনয় দেখে স্কুলের সবাই কিরকম করতালি দিয়ে ফেটে পড়ে। হেড মাস্টার মশায় গুপিনাথ দত্ত দেখা হলেই খোকন চন্দ্র বলে কত আদরে ডেকে ওঠেন আমাকে। মজিদ স্যার আমার প্রতিভায় অভিভূত হয়ে আগামী দিনে দেশের বিজ্ঞানী বলে মনে করেন আমায়।
দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছিল। মা রাগে দুঃখে খেতেও ডাকলেন না আজ আর আমাকে। আমিও বুক ভরা হাহাকার আর অভিমানে উপুর হয়ে মুখ চেপে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। খানিক বাদে কি ভেবে সাইকেলের চাবিটা হাতে নিয়ে, অভুক্ত পেটে বারান্দায় গিয়ে কাঁঠাল কাঠের বেঞ্চিটার ওপরে গিয়ে বসলাম। মাতামহ নবীন রায়ের সময়ে নির্মিত সেই যুগের বহু পুরোনো কাঁঠাল কাঠের বেঞ্চি। জায়গায় জায়গায় রং উঠে দাগ-ছোপ পড়ে গেছে। সেই বেঞ্চিটার ওপরে সাইকেলের চাবির ধারালো মুখটা দিয়ে আঁচর কেটে কেটে অস্পষ্ট হলেও লিখে ফেললাম দুটি কথা, “খোকন ভাস্বতী”।
লেখার শেষে উঠে এলাম ভেতরের ঘরে।
বিকেলের সূর্য নেমে গেছে অনেকটাই প্রায়।
বড়োঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম মা কেমন যেন বিষণ্ণ মনমরা হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। পিতৃদেবও বারান্দার চেয়ারে চোখ বুজে তন্দ্রার ঘোরে ঢুলছেন। ছোড়দি গেছে পাশের মেসোদের ঘরে।
পূর্বপাকিস্তানে থাকার সময়ে বিদেশি ফোমের তৈরি একটা ব্যাগ কিনেছিলেন মা। সেই ব্যাগটায় গুছিয়ে নিলাম আমি আমার কয়েকটা জামাকাপড়। মায়ের খাটের ওপরে ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখা বিছানার তোশক উলটিয়ে, যেটা আমি আশা করেছিলাম সেটা পেয়ে গেলাম। কড়কড়ে ন’খানা দশটাকার নোট। নোটগুলো তুলে ঢুকিয়ে নিলাম পকেটে। এই নব্বইটি টাকাই এখন আমার জন্য অনেক। বাংলাদেশে যেতে হলে এই নব্বইটি টাকার এখন আমার খুবই প্রয়োজন।
সন্ধ্যা নামবে নামবে প্রায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যে ছয়টায় হয়বরগাঁও রেলস্টেশন থেকে চাপরমুখ যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। স্টেশন খুব দূরে নয় আমাদের বাড়ি থেকে। সেই স্টেশনে যাব বলেই মনে মনে মা-বাবাকে প্রণাম জানিয়ে সবার অলক্ষে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে।
বিদায়, তোমাদের সবাইকে বিদায়। চলে যাচ্ছি আমি বাংলাদেশের মময়নসিংহ শহরে। আর কোনওদিন ফিরে আসব না দেশ ভাগের বিষ জর্জরিত ভারত নামের তোমাদের এই দেশে।
next episode- ফিরে পাওয়ার আশায়