ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-31-চিঠি
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-31-চিঠি
দেখতে দেখতে দুটি মাস গড়িয়ে গেল। বাংলাদেশে আমি কোথায় আছি, কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছি, কাদের আশ্রয়ে থেকে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করছি, লিখে কিচ্ছুই তখনও ভারতের অসমের বাড়িতে জানাইনি। একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে মিনুভাইয়ের মা আবারও কথাটা তুললেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কি রে খোকন ভারতে মায়ের কাছে চিঠি লিইখ্যা সব জানাইছস?
অপ্রস্তুত আমি স্মিত হাসিতে আস্তে করে উত্তর দিলাম, না মাসিমা এখনও লিখিন। প্রতিদিন ভাবি লেখব, পরে আবার ভুলে যাই।
মাসিমা গম্ভীর হয়ে আবার বললেন, তর ভীষন ভুলা মন! কবে থিকা তরে কইতাছি, ভারতে মায়ের কাছে একটা চিঠি লেখ। আর তুই ভুইল্যাই যাস। বাংলাদেশে তুই কোন জায়গায় আছস, এইটা অহনও মা-বাবারে জানাইবি না? কাজটা তুই ভালো করতাছস না। তুই আইজকেই চিঠি লেখবি। আমি আর কোনও অজুহাত তর শুনুম না।
‘লেখব লেখব আজ লেখবই।’ হেসে বললাম আমি। খানিক বাদে আবার বলে উঠলাম, মাসিমা একটা কথা বলব? মানে আমি ভাবছিলাম কি, যদি আমি বাংলাদেশেই থেকে যাই? যদি বাংলাদেশে থেকেই পড়াশোনা করি?
শুনে মাসিমা খানিক থ হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর প্রায় বকে দেওয়ার মতো বলে উঠলেন, এইসব অবান্তর কথা তর মনে আসে কি কইরা? তুই কি পাগল হইয়া গেছস? থাকবি কার কাছে এই দেশে? কে তরে জায়গা দিব? চিরজীবন আমরার কাছে থাকতে পারবি? আর তরে আমরা রাখুমিই বা ক্যান? পুলারে এইসব পাগলামি ছাড়, বাবামায়ের কাছে ফিইরা যা।
মাসিমার কথাগুলো আমার মনঃপূত না হলেও তবুও অন্তরে কোথাও যেন মনে হচ্ছিল কথাগুলো তিনি ঠিকিই বলেছেন। থাকব আমি এদেশে কাদের কাছে? এই বাংলাদেশে কোন আপনজন আমার আছে যে, আমাকে ঠাঁই দেবে? আমাদের জ্ঞাতী সম্পর্কের কিছু আত্মীয়রা আছেন জুবলিঘাটের দিকে। যদি তারা আমাকে আশ্রয় দেন? তাদের কাছে গিয়ে যদি প্রস্তাবটা রাখি? মনে মনে ভেবে নিয়ে মিনুভাই আর মাসিমাকে কথাটা জানিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সেদিনই তৈরি হয়ে পড়লাম। ওনারাও আপত্তি করলেন না তাতে।
দুপুরের দিকে মিনুভাইদের থেকে বিদায় নিয়ে জুবলিঘাটে আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম আমি। আত্মীয় পরেশদাদা আমাকে দেখে অবাক হলেন না একটুও। বসতে বললেন তিনি আমাকে তাদের সামনের ঘরে। আমাকে দেখে তিনি অবাক না হলেও আমি বাংলাদেশে কবে এসেছি, কোথায় এখন থাকছি সেসব অবশ্য জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর শোনার পর আমার সঙ্গের ব্যাগটা দেখে আবারও প্রশ্ন করলেন, তা এইখানে কী মনে কইরা?
আমি একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম যেন। তবুও লজ্জা সরম ত্যাগ করে বলেই ফেললাম, থাকতে এলাম আপনাদের কাছে। আপনারা আমাদের আত্মীয়, আপনি হলেন গিয়ে বাবার জেঠতুতো ভ্রাতা, ভাবছি কিছুদিন আপনাদের এখানেই থাকব।
‘আমাদের এইখানে?’ অবাক সুরে প্রশ্ন করলেন পরেশদাদা। তারপর আবার বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও একটু বসো।
বলে তিনি দ্রুত চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। একটু পরেই হাতে করে নিয়ে এলেন একটা পোস্টকার্ড। আমার হাতে দিয়ে বললেন, পইড়া দেখো!
পোস্টকার্ডের ওপর টানা টানা আরবি ভাষার মতো হাতের লেখা, দেখেই বোঝা যায় চিঠিটা আমার পিতৃদেবের। চিঠিটা লিখেছেন তিনি পরেশদাদাকে। দুএকলাইন আশীর্বাদ কুশল সংবাদের পরেই তিনি লিখেছেন, একটা কথা তোমাকে জানাইতে চাই। আমার কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীমান খোকন আজ কিছুদিন হয় কাউকে কিছু না বলিয়া না জানাইয়া দেশত্যাগ করিয়াছে। সম্ভবত সে বাংলাদেশে চলিয়া গিয়াছে। যদি তোমাদের ওইখানে গিয়া থাকে, তাহাকে স্থান দিও না। যদি তাহাকে আশ্রয় দেও তাহলে তোমাদেরই সমূহ বিপদ। কেননা সে নকশাল হইয়া ভারত হইতে পালাইয়া গিয়াছে।...ইত্যাদি আরও দুএক লাইন।
পরেশদাদা যে আমায় কি বলতে চাইছেন এই চিঠিই যেন তার উত্তর । লজ্জায় নত হয়ে গেল আমার মাথা। নত মাথায় ফিরে এলাম আবার মিনুভাইদের বাড়িতে। মিনুভাইয়ের মা অর্থাৎ মাসিমা সব শুনে বললেন, তুই গেলি ক্যান তগো আত্মীয়ের বাড়িতে? আমরা তরে যাইতে কইছিলাম? যে কয়দিন ভারতে ফিইরা না যাস থাক আমগো এইখানে। কইলাম না, ভারতে তর মা’রে একটা চিঠি লেইখ্যা জানাইয়া দে সব। তেনারা না জানি কত চিন্তা করতাছনে তরে নিয়া!
মাসিমার কথা মতো একটা চিঠি লিখে ফেললাম সেদিনই। কাচারি রোডের বড় ডাকঘরে গিয়ে মিনুভাই সেটা পোস্টও করে দিয়ে এলেন।
কিন্তু সময় বয়ে যায় সময়ের মতো। সেই চিঠির উত্তর আর আসেন না। কিছুদিন যেতে না যেতেই যে অলীক কল্পনায় বিভ্রান্ত হয়ে চলে এসেছিলাম বাংলাদেশে, সেই স্বপ্নও যেন কেমন ফিকে হয়ে আসছিল আস্তে আস্তে। একদিন মিনুভাই আমায় বললেন, অবাস্তব অসম্ভব ভাবনা-চিন্তাগুলো সব ছাইড়া আবার ফিইরা যাও বাবা মায়ের কাছে। এইখানে এই বাংলাদেশে থাকবা কই তুমি? আমগো এইখানে না হয় কিছুদিন থাকলা, তরপরে? কে তুমারে চিরজীবন দেইখ্যা রাখব? কোন কলেজে তুমি ভরতি হইবা, কে তুমারে ভরতি করাইব, আর পড়ার খরচ চালাইব কে? ভাবছ কিছু? কল্পনায় গরুকে গাছে চড়ানো যায়, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব না!
আমি লজ্জায় সঙ্কুচিত বলে উঠলাম, হাঁ আমিও ভাবছি ফিরেই যাব। তবে ভারতের অসম থেকে একখানা অন্তত চিঠি এলে রওনা হয়ে যাওয়াতে যেন আমার সুবিধে হত। দেখতে দেখতে হয়েও গেল তিনমাসের ওপরে। আর আপনাদের বাড়িতে বেশ আরাম আয়েশেই তো আছি। যত্নেরও কোনও খামতি নেই। ভালো ভালো খাই, এদিক ওদিক যাই।
মিনুভাই রেগে উঠলেন, এসব কী কথা? মারব এক চর!
আমি হেসে বললাম, যা সত্যি তাই তো বলছি!
‘হয়েছে হয়েছে আর পাকামি করতে হইব না। থামো এইবার!’
মায়ের কাছে একবার শুনেছিলাম ঢাকার নবাবদের বংশধর নাকি মিনুভাইয়েরা। তাদের হাবভাব চালচলনে এখনও যেন সেই আভিজাত্যের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। বাড়িতে তিনজন পরিচারিকা ছাড়াও রান্নাবান্নার জন্যে আরও দুই রাঁধুনি নিয়োগ করা আছে । প্রায় রাতেই মাছের সঙ্গে মুরগির মাংসও হয়। এত কিছু খাওয়ার পরেও আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় দুধ খাব কিনা?
শীত বিদায় নিয়ে নেমে চলে এসেছে গ্রীষ্মের দাবদাহ। সারা দুপুর ব্রহ্মপুত্রের পারে ঘোরাঘুরি করে ঘর্মক্লান্ত হয়ে মিনুভাইদের বাড়িতে ফিরতেই মাসিমা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জামের আরক বের করে সরবত বানিয়ে খেতে দিলেন।
ফারুকভাই জিজ্ঞেস করলেন শিলঙের কথা। শিলঙে তার খুব যাওয়ার ইচ্ছে। শিলং দেখতে কেমন? তাছাড়া অধ্যাপক ফারুকের অসম সম্বন্ধে নানা জিজ্ঞাসা নানা কৌতূহল। বছরে একদুবার কলকাতায় তাদের যাতায়াত হতে থাকলেও অসম অথবা শিলঙের দিকে কোনওদিন তার যাওয়া হয়নি।
আমি বললাম, আমাদের কাকু থাকেন শিলঙে। সেই সূত্রেই কয়েকবার গিয়েছি আমরা। বড় সুন্দর জায়গা, ভালোই লাগে। ময়মনসিংহ থেকে ডাউকি বর্ডার দিয়ে কাছেই তো। ঘুরে আসেন একবার।
‘ডাউকি বর্ডার দিয়া যাতায়াত শুরু হইলেই যামু।’ বললেন ফারুকভাই।
এই এতদিনের মধ্যে ফারুকভাই এই প্রথম আমার সঙ্গে একটু কথা বললেন। আসলে তিনি কথা খুব কম বলেন। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। বেঁটেখাটো হলেও মিষ্টি চেহারা। সারা দিনরাত কী যেন ভাবেন, আর ঘরের ভেতরেই পায়চারি করতেই থাকেন।
দেখতে দেখতে প্রায় চারমাস হতে চলল। ভারতে মায়ের কাছে দু দুটো চিঠি লেখা হয়ে গেছে আমার। তারপরেও ভারত থেকে তখনও কোনও উত্তর কিছু আসেনি। মিনুভাইরা এসব নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস না করলেও বড় অস্বস্তিতে পড়ে যাই মাঝেমধ্যে। রাতে খাবার টেবিলে বসেছি, মুখ ভার আমার। মাসিমা হঠৎ জিজ্ঞেস করলেন, খোকন গোরুরমাংস খাইবি?
একেবারে অপ্রস্তুত যেন আমি। তার মানে আজ খাবারের মেনুতে গোরুর মাংসও আছে। কী জবাব দেব কিছুই পাচ্ছিলাম না ভেবে?
মিনুভাই বলে উঠলেন, ওহ্ আম্মা গোরু ওরা খায় না, তবুও ক্যান জিজ্ঞাসা করতাছ?
‘তুই থাম! খোকন আজকালকার পুলা, ভাবলাম কিজানি খাইলে খাইতেও পারে? তাই জিজ্ঞাসা করতাছি। তর ফরিদভাই কলিকাতায় গেছিল, কলিকাতার তার অনেক হিন্দু বন্ধুই গোরুরুমাংস খায়। দুইদিন তো থাকছিল সত্যজিৎগো বাড়িতে, তারা কি গোরুরুমাংস খায় না?’
‘খায় অনেকেই খায়। এইটা যার যার রুচির ব্যাপার।’
‘আমিও তো সেই কথাই কইতাছি। খোকনের যদি মনের ইচ্ছে হয় খাইব, না হইলে খাইব না। এইডা তো কোনও জোরাজুরির কথা না। কিরে খোকন খাইবি?’
মাসিমা প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
সনাতন হিন্দু ধর্মের কোন সংস্কারে, কোথায় আর কীভাবে গোরুরুমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বলা আছে আমি তখনও কিচ্ছু জানি না। তবুও জন্ম থেকে শুরু হওয়া সংস্কারের লালিত বন্ধনে আবদ্ধ তো আমি নিজেও। আমি পারব না সেই মাংসের টুকরো মুখে তুলতে। মুখ দিয়ে অজান্তে যেন বেরিয়েই এল, না না মাসিমা খাব না!
মাসিমা মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেন কিনা বোঝা গেল না, তবে কৃষিবিজ্ঞানী ফারুকভাই বলে উঠলেন, গোরুরমাংস না খাওয়াই তো ভালো। অবশ্য কোনও মাংস খাওয়াই ভালো না। আইজ মাংস খাওয়া মানে এই মাংসই পরে আমগোরে খাইব।
next episode- মনে পড়ে