pallab kumar dey

Drama

3  

pallab kumar dey

Drama

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-20-নিউটনের গতিসূত্র

ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-20-নিউটনের গতিসূত্র

5 mins
9



 ভাষার মাধ্যম নিয়ে কিছুদিন থেকেই একটা অশান্তি শুরু হয়েছে অসমের কলেজগুলোতে। অসমের কলেজগুলোয় এযাবৎ ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশোনা চলছিল। এবার ছাত্রসংস্থার দাবি অসমিয়া মাধ্যম প্রবর্তন করার। দাবির পক্ষে যেমন জোরালো যুক্তি আছে তেমনি বিপক্ষেও রয়েছে ভিন্নমত। বিশেষ করে দক্ষিণ অসমের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী(যারা নব্বই শতাংশই সিলেটি ভাষায় কথা বলেন) ছাত্রছাত্রীদের মতামত আলাদা।

 ইতিমধ্যে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল প্রস্তাবও নিয়ে ফেলেছেন অসমিয়া মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু করে দেওয়ার। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও চলছে কলেজে কলেজে। কিন্তু অসমের কংগ্রেস সরকার এখনই এই প্রস্তাব মানতে নারাজ। কংগ্রেস সরকারের ইচ্ছে অসমিয়া মাধ্যম প্রবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমও বহাল রাখার, আর বরাক উপত্যকার ছাত্রছাত্রীদের জন্যে আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন। এসব নিয়েই পক্ষে বিপক্ষের এক জটিল আবর্তে হিংস্র আন্দোলন মাথাচাড়া দিচ্ছে। অশান্তির নানা খবর প্রায় সময়েই এদিক ওদিকে থেকে আসে।

 আমাদের কলেজের কলা বিভাগের সিনিয়ার একজন ছাত্র এখন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। জেলার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে আজকাল তাকে প্রায়ই দেখা যায়। আরও একজনকে আজকাল মাঝে মাঝেই ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সেরকম জোরালো না হলেও, কিছু কিছু কথা বলতে শোনা যায়, সে হল যুব কংগ্রেসের একজন বাংলাভাষী মুসলিম নেতা।

 অসমিয়া মাধ্যমের চর্চাও শুরু হয়েছে কলেজে কলেজে। যদিও এখনও পর্যন্ত হিংরেজি পাঠ্য বই-ই পড়তে হচ্ছে সবাইকে। এক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে ছাত্রছাত্রীরাও। তারাও দিশেহারা। আমার দিশেহারা অবস্থা অবশ্য অতটা ব্যাপক নয়। বিজ্ঞানের এসব পাঠ কয়েক বছর আগে পূর্বপাকিস্তানে থাকার সময়ে বাংলায় আমার অনেকটাই পড়া হয়ে গেছে। বিজ্ঞান আমার ভালো লাগত বলে অল্প বয়সেই অনেক পড়ে ফেলেছিলাম। অল্প বয়সে আমার ওরকম জিনিয়াসনেসে অভিভূত হয়ে স্কুলের স্যাররা আমায় ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের একজন বিজ্ঞানী বলেই ভেবে নিয়েছিলেন। অল্প বয়সে সেসব পড়েছিলাম বলে আজও আমার মনে কিছু গেঁথে রয়েছে। 

 কলেজে অসমিয়া মাধ্যমে চর্চা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটু সুবিধেই হচ্ছিল আমার তাতে। আর সেটা বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় ও শব্দবন্ধগুলো অসমিয়া ও বাংলা ভাষার মধ্যে অনেকটা মিল ছিল বলেই বোধহয়। বরং ইংরেজিতেই অস্বচ্ছন্দ আমি। খেই হারিয়ে ফেলছিলাম এতরকম ভাবে পড়ার পরেও। ইংরেজি অর্থই বুঝতে পারছিলাম না সেরকম ভালো ভাবে। তবুও পড়তে হচ্ছিল ইংরেজিতে। যদি অসমিয়া মাধ্যমে পড়তে পারতাম সম্ভবত ভালোই হতো আমার জন্যে।  

 ভাষা আন্দোলন পূর্ণগতি পাওয়ার কিছুদিন আগে একদিন। কলেজের ফিজিক্সের ক্লাসে স্যার ছাত্রছাত্রীদেরকে নিউটনের গতিসূত্র অসমিয়া অনুবাদ করে বলতে বললেন। ক্লাসে এমন একজনও ছাত্র-ছাত্রী নেই যে, উঠে দাঁড়িয়ে অসমিয়ায় অনুবাদ করে বলতে পারে!

 আমি হাত ওপরে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, স্যার মই।...স্যার আমি। আমি বলব।

 স্যারও উৎফুল্লে বলে উঠলেন, হয় হয় কোয়া কোয়া... হাঁ হাঁ বলো বলো!

 তিনচার বছর আগের বাংলা মাধ্যমের সেই পড়া তো গেঁথেই ছিল আমার মনে। সেটাই সামান্য একটু অসমিয়া ভাষায় হেরফের ঘটিয়ে দিলাম সবটা উগরিয়ে। শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্যার হাততালি দিয়ে ফেটে পড়লেন। বিশেষ করে আমার মতো এক বাঙালি ছাত্র নিউটনের গতিসূত্র এত ভালো অসমিয়া অনুবাদ করে বললাম বলে!

 ক্লাস শেষে বিশ্বজিৎ বিশ্বাসই করতে পারছিল না, বিজ্ঞানের অসমিয়া বই না পড়েই কী করে আমি নিউটনের গতিসূত্র অসমিয়ায় বলে দিতে সমর্থ হলাম?

  বিশ্বজিৎকে আমি বললাম, নিউটনের গতিসূত্র আমার বাংলায় পড়া আছে। সেটাই একটু অসমিয়ায় হেরফের ঘটিয়ে বলে দিয়েছি। আসলে বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো তো বাংলা আর অসমিয়ার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই, তাই! 

 'হয় নেকি?.. তাই নাকি?' বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিশ্বজিৎ আমার দিকে। 

 অবাক হওয়ারই কথা। খুবই মধাবী ছাত্র বিশ্বজিৎ। সে জানে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর জন্যে বিজ্ঞানের ওপরে বাংলায় অনেক বই লেখা হয়ে গেলেও অসমিয়া ভাষায় তখনও সেরকম করে বই লেখা হয়নি। যদিও বা লেখা হয়েও থাকে, ছাপানো ও বিপনন সবটাই তো হয় সেই কলকাতা থেকে। সেই যোগাযোগ কার আছে, কে যাবে কলকাতায় বই ছাপাতে? তারওপর ঠগবাজের কারবারে সিদ্ধহস্ত কলকাতার বইওয়ালারা। বিশেষ করে উত্তরপূর্বের শিক্ষক, প্রফেসর, লেখকদের হাতের নাগেলে পেলে যেন ছিঁড়ে খেতে চায়। অবজ্ঞা, অপমান ও অসম্মানে চূড়ান্ত করে ছাড়ে।

 ছুটির পরে বিশ্বজিৎ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে এসে কলেজের উলটো দিকে দীপকদার পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। সৌম্যও এসে জুটল এসময়ে। অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট খেতে না পেরে যেন হাঁসফাঁস করছিল সে। তাড়াতাড়ি দীপকদার থেকে একটা ফিল্টার উইলস সিগারেট কিনে নিয়ে সে আগুন ধরাল আগায়। সিগারেটের টানে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, তোকে একটা দেব? তুই খাবি?

 আমি মাথা নাড়িয়ে বলল, আরে না না! প্রতিদিনই একই কথা কেন জিজ্ঞেস করিস! আমি সিগারেট খাই না তুই ভালো করে জানিস! কিন্তু তুই সারাদিনে কটা খাস?

 তুড়ি মেরে হেসে বলল, আরে বন্ধু জীবনটাও নিউটনের গতিসূত্র! সিগারেট খাবি না, মদ খাবি না, গাঁজা খাবি না, একেবারে রিঅ্যাকশনলেস লাইফ! কতদিন বাঁচবি বল তো জীবনে? পঞ্চাশ ষাট সত্তর? ফুস করে চলে যাবি একদিন! কিচ্ছু নেই..কিচ্ছু নেই…কিচ্ছু নেই, সব জিরো! তাই বন্‌ যা হিরো!

 'তুর মন গইছে তই খা, ভাল লরাটুক কিয় ব্যয়া করিব ধরিছ?.. তোর ইচ্ছে হচ্ছে তুই খা, ভাল ছেলেটাকে কেন খারাপ করতে চাচ্ছিস?' গম্ভীর হয়ে বলল বিশ্বজিৎ।

 'সরি ফুকন, বস যখন বলছে আর কোনওদিন তোকে সাধব না।' বলে হাসছিল সৌম্য। 

 বিশ্বজিৎ হেসে বলল, কি লরা তয় হো সৌম্য, হদায় ধেমালি করি থাকো... কী ছেলেরে তুই সৌম্য, সবসময় ইয়ার্কি করছিস, একবার অন্তত সিরিয়াস হ!

 বলে বিশ্বজিৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফুকন তেনেহলে তহতে ইয়াতে রই থাক...ফুকন তাহলে তোরা এখানে দাঁড়া, গল্প কর, আমি যাই। আমায় এখন আমলাপট্টিতে যেতে হবে।

 বিশ্বজিৎ আমলাপট্টিতে যেতে হবে বলতেই হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই দুইবোন ও তাদের ভাইটার কথা। বেশ কিছুদিন হয়ে যাওয়ায় সেই ঘটনার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। আচমকা আজ মনে পড়ায় বিশ্বজিৎকে জিজ্ঞেস করলাম, ও হ্যাঁ হ্যাঁ.. ওই যে দুটি সুন্দরী বোন, দাদা মেডিক্যাল পড়ছে, সিগারেট পয়জনিং হয়ে মারা গেছে বলে টেলিগ্রাম এসেছিল, ওদের বাড়িতেই যাচ্ছিস তো? ওদের কী খবর? কী হয়েছিল ওদের দাদার, কী ঘটনা?

 'আর ন কবি, গোটেইখন মিছা! ...আর বলিস না, সবটাই মিথ্যে!' উত্তর দিল বিশ্বজিৎ, ওদের দাদাটা খুব ভালো ছেলে! জীবনে কোনওদিন তামূল তো দূর একটা সিগারেটও ছুঁয়ে দেখেনি! রিগিং, সিনিয়ারদের রিগিং!- খপ্পরে পড়ে গেছিল! সিনিয়াররা বলেছিল ওদের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক নাগাড়ে সিগারেট টেনে যেতে হবে। কয়েকটা টানার পর আর পারেনি! অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল। আর সেটাই গুজব হয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিথ্যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল কেউ বা কারা। এ নিয়ে অনেকদূর যাওয়া হয়েছিল, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শাস্তি কারোরই হয়নি।       

 'যাকগে তবুও ভালো, ছেলেটা তো বেঁচে আছে!'

 'সে তো বুঝলাম, মেডিক্যাল কলেজে এখনও রিগিং বন্ধ হয়নি! সিনিয়াররা এখনও জুনিয়ারদের রিগিং করেই চলছে! ভয় হয়!' দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল বিশ্বজিৎ।

 আসলে ওর ভয়টা অন্য জায়গায়। যদি বিশ্বজিৎ মেডিক্যালে চান্স পেয়ে যায় তবে কি তাকেও এরকমই রিগিং-এর দুঃসহ যন্ত্রণাগুলো পেরিয়ে যেতে হবে?

next episode-   মামার সঙ্গে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama