ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-19-টেলিগ্রাম
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-19-টেলিগ্রাম
ওদিকে বিশ্বজিতের সঙ্গে দুই বোনের খুনসুটি চলছিলই। ওদের হাসাহাসি, শরীরের ঢলাঢলি ও খুনসুটির ধরণ দেখে অনুমানই করতে পারছিলাম না, তাদের দুই বোনের মধ্যে কার সঙ্গে বিশ্বজিতের এখন প্রেম ভালোবাসা? ছোটবোন নাকি বড়জন কে সত্যিকারের বিশ্বজিতের প্রেমিকা? কখনও মনে হচ্ছিল বিশ্বজিৎ ছোটবোনটিকেই ভালোবাসে, আবার পর মুহূর্তেই যেন অনুমান হচ্ছিল সে বড় বোনের সঙ্গেই প্রেমে পড়েছে।
কলেজে ঢোকার পর থেকেই বিশ্বজিতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বতা। এত দিনের মধ্যেও কোনওদিন আমি কোনও মেয়ে সম্পর্কে ওর মুখে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ধরণের কোনও কথা কিছু শুনিনি। আর এই দুইবোনের সম্বন্ধে তো কোনওদিনই না। বেশি সময়েই সে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। আমার সঙ্গে বেশি সময়েই সে কলেজের ক্লাস ও পড়াশোনা নিয়েই কথা বলে। বলা যায় এই কলেজের একজন মেধাবী ছাত্র সে। ক্লাসের সেরা ছাত্রও তাকে বলা যেতে পারে।
আর আমার আরেক বন্ধু সৌম্য, এরমধ্যেই তাদের প্রতিবেশী একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়ে গেছে। ওই মেয়েটিকে নিয়ে আজকাল সে প্রায় সময়েই আদি রসে পূর্ণ রসালো গল্পও আমায় বলে। আর এসব আদি রসের রসালো গল্পে অনেক সময়ে অজান্তে যখন আগ্রহ দেখিয়ে ফেলি, তখন সে আরও বেশি বেশি করে আমাকে শোনায়।
সন্ধ্যে পেরিয়ে যাচ্ছিল। গল্প ছেড়ে ওঠার কোনও আগ্রহই দেখতে পাচ্ছিলাম না বিশ্বজিতের মধ্যে। আর আমিও হঠাৎ করে উঠে চলেও যেতে পারছিলাম না। তবুও তার মধ্যেও একবার বলেতেই হল, বিশ্বজিৎ তয় ব, মই এতিয়া যাও?...বিশ্বজিৎ তুই বোস, আমি এখন যাই? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো আমার। আমার তো বাড়ি ফিরতে হবে। সেই কতদূর মোল্লাপট্টি যেতে হবে আমাকে।
থামিয়ে দিল বিশ্বজিৎ আমাকে, আর একটু বস। আরে আমিও তো যাব। একসঙ্গেই বেরোবো।
এরমধ্যে চা-বিস্কুটও চলে এল, খেলাম দুই বন্ধু মিলে। সন্ধ্যে পার হয়ে রাত নামবে নামবে প্রায়। হঠাৎ এই সময়েই বাইরে থেকে সাইকেলের বেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ ও মুহূর্ত পরেই ভারী গলায় জনৈক লোকের হাঁকডাক, টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম আছে এখন আপনালোকর।
টেলিগ্রাম! এই অসময়ে? হতভম্ব হয়ে গেল মা-মেয়ে সবাই। টেলিগ্রাম মানেই তো দুঃসংবাদ! তাদের সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল আমরাদেরও। বিশ্বজিৎ দরজা খুলে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। টেলিগ্রাম অফিসের পিয়ন আর দেরি না করে বারান্দায় উঠে সই করিয়ে বিশ্বজিতের হাতে টেলিগ্রামটা ধরিয়ে চলে গেলেন। ইতস্তত স্তম্ভিত বিশ্বজিৎ কম্পিত হাতে টেলিগ্রামটা খুলতেই সত্যি সত্যিই এক মহা ভয়ংকর দুঃসংবাদ!
"ঋতুরাজ এক্সপায়ার্ড, সিগারেট পয়জনিং!"
ঋতুরাজ মানে এই বাড়ির একমাত্র ছেলে যে ডাক্তারি পড়ছে অন্য এক শহরে। খবরটা শুনে বজ্রাহত মা তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আর দুইবোন তো চিৎকার হাহাকারে আকড়ে ধরল বিশ্বজিৎকে।
বিমূঢ় বিশ্বজিৎ মা এবং মেয়েদেরকে কিভাবে সামলাবে পাচ্ছিল না ভেবে। হতবাক আমিও। শরীর যেন আমার কাঁপছিল। এ কিরকমের টেলিগ্রাম? এরকম টেলিগ্রামের কোনওরকমের অর্থই কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনওরকমের ধারণাও তৈরি হচ্ছিল না কারো মধ্যে। বিশ্বজিৎ দুইবোনকে কোনওরকমে সামলে নিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠল, এটু কেনেকুয়া টেলিগ্রাম...এটা কীরকম টেলিগ্রাম? সিগারেট পয়জনিং? সিগারেট পয়জনিং-এ কারও মৃত্যু হয় এরকম কথা তো জীবনে কোনওদিন শুনিনি! আর সত্যি যদি কিছু ঘটেও থাকে, কী করে ঘটল, কেনই বা ঘটল? কেই বা এরকম একটা টেলিগ্রাম পাঠাল? আমার তো মনে হচ্ছে সবটাই মিথ্যে, বুজরুকি!
সত্যিই হোক আর মিথ্যে, টেলিগ্রাম তো একটা এসেছে! এসেছে তো এসেছে, মুহূর্তের মধ্যে মহা বিপর্যয়ের এক ঘূর্ণিঝড় তুলে দিয়েছে ছাপোষা একটা গৃহস্থ পরিবারের মধ্যে! ততক্ষণে খবরটা দাবানলের মতো আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়েছে। খবর পেয়ে আর আর্তনাদ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। ভিড় জমে গেল কিছুক্ষণেই মধ্যেই।
রহস্য দানা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। সিগারেটের বিষক্রিয়ায় কারও মৃত্যু হতে পারে, কারোরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। তাছাড়া মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে তো টেলিগ্রাম আসেনি! টেলিগ্রামটি এসেছে অজানা-অচেনা নামের অন্য কোনও এক ব্যক্তির থেকে!
মহা ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম আমি। প্রতিবেশীরা কৌতূহলী আর কেমন যেন এক সন্দেহের চোখে আমাদের দিকেও তাকাচ্ছেন। এদিকে রাতও বাড়ছে একটু একটু করে। রাত সাড়েনয়টা পেরিয়ে গেছে এরমধ্যেই। রাত দশটার কাঁটা প্রায় ছুঁইছুঁই। আমাকেও যে এবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে। ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে আমার অভিভাবকরাও নিশ্চিত এতক্ষণে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় পড়ে গেছেন। আরও তো আরও, কিছুদিন থেকেই ভাষা আন্দোলন জনিত কারণে শহরে সম্প্রদায়গত যেসব অশান্তি শুরু হয়েছে তাতে আমার ফিরতে দেরি হওয়ায় তাদের মধ্যেও যে অশুভ চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না কে বলতে পারে?
এদিকে আশপাশ থেকে লোকজনের ভিড় আস্তে আস্তে বেড়েই যাচ্ছিল। নানা জনের নানা কথা। এরমধ্যে মেয়েদুটির মা একটু একটু কথা বলার মতো অবস্থায় যেন ফিরে এলেন। এবার কী করতে হবে, কী করে যোগাযোগ করা যায় সেসবই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক এক জনের এক এক রকম অভিমত। শেষে বলতে হল বিশ্বজিৎকেই, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আজ রাতেই আমাদের তাহলে রওনা হতে হয়!
গাড়ির ব্যবস্থা না হয় হয়েই গেল, এই মুহূর্তে ওদের সঙ্গে যাবে কে? সেটারও উত্তর দিতে হল সেই বিশ্বজিৎকেই, মই ..মই-ই লই যাম। ...আমি …আমিই তাহলে নিয়ে যাই! আমিই সঙ্গে যাব!
এই অবসরে আমি আস্তে করে বিশ্বজিৎকে কানে কানে বলে ফেললাম, মোরও তু ঘরত যাব লাগিব বিশ্বজিৎ! নহলে দেওতা-মায়ে খুব চিন্তা করিব! ...আমারও তো ঘরে যেতে হবে বিশ্বজিৎ! নাহলে তো আমার বাবা-মা খুব চিন্তা করবেন!
'বিশ্বজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হয় হয় তয় যা … হাঁ হাঁ তুই চলে যা। নইলে তোদের ঘরেও বাবা-মা দুর্ভাবনায় পড়বেন!
রাত প্রায় দশটার দিকে ফিরে এলাম বাড়ি। পিতৃদেব উৎকঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, এত রাইত হইয়া গেছে, কই আছিলি? ভাষা আন্দোলন লইয়া দেশে একটা অশান্তি শুরু হইছে জানস না? এর মধ্যেও এত রাইত কইরা ঘরে ফিরস?
কী উত্তর দেব আমি, কেমন করেই বা গুছিয়ে বলব ভেবেই পাচ্ছিলাম না। অত কিছু না বলে শুধু বললাম, কলেজের এক বন্ধুর সঙ্গে ওদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলাম। আত্মীয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেখানে দেরি হয়ে গেল।
'সেইটা তো বুঝলাম। আসল অশান্তির শুরু তো তর কলেজ থিকাই, তাই কই সাবধানে চলাফেরা করিস! বেশি রাইত কইরা বাইরে থাকিস না।' পিতৃদেব আবারও বলে উঠলেন।
কিন্তু মা আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করলেন না। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে শুধু বললেন, তুই যে কই যাস, কি করস তুই জানস!
next episode- নিউটনের গতিসূত্র