ব্যতিক্রমী ভোজ
ব্যতিক্রমী ভোজ
সব কার্ডগুলোর উপরে একবার ভালো করে নামগুলো চেক করে নিলো অদিতি | না, কোনো ভুল নেই | মোটামুটি লিস্ট মিলিয়ে সব নিমন্ত্রিতদের নামেই কার্ড তৈরী করা হয়ে গেছে, এখন শুধু কুরিয়ার করে দিলেই হয়ে যাবে |
নিমন্ত্রণের কার্ডগুলোকে টেবিলের একপাশে রেখে চামেলীদিকে এককাপ কফি বানাতে বলল অদিতি | একটু বাদেই মেয়েকে স্কুল বাস থেকে নামাতে যাবে, যাবার আগে এই গরম গরম এককাপ কফি যেন প্রাণ জুড়িয়ে দেয় অদিতির!!
চামেলী কফির কাপটা টেবিলের উপরে রেখে স্তরে স্তরে সাজানো কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, "এসব ছেলেখেলা না করলেই কি নয় দিদি ?? বড্ড ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে যে !! "
চামেলীর কথা শুনে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে অদিতি বলল, "এটাই ভালো হোলো না ?? তুই না চামেলীদি, কিচ্ছু বুঝিস না | আরে, মনটা যত ছেলেমানুষি করবে, জানবি জীবনটা তোর ততো ভালো কাটবে | "
চামেলী অদিতির থেকে বছর দুই তিনেকের বড়ো হবে | সেই যে ছোটো বেলায় অদিতির মা নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে অদিতির একজন সঙ্গী হিসেবে, তবে থেকেই এই বাড়ির আরেক মেয়ে হয়ে রয়ে গেছে চামেলী | গরীব ঘরের বড়ো সন্তান যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার বাসস্থান নিজের বাড়ি নয়, কাজের বাড়ি হয় | চামেলীরও তাই হয়েছিল | তবুও অদিতির মায়ের চেষ্টা আর ভালোবাসায় মাধ্যমিকের গন্ডীটুকু পেরিয়েছিল চামেলী | তারপর নিজে থেকেই বলেছিল, "মামী, আর লেখাপড়া করবো না | অনেক হয়েছে লেখাপড়া | বাড়িতে নিয়ম করে টাকা পাঠাও আমাকে তোমার কাছে রাখো বলে, আবার আমায় খাইয়ে পরিয়ে লেখাপড়াটাও শিখিয়ে দিলে | আর ভালো লাগছে না, তোমার উপরে বোঝা হয়ে থাকতে | আমি এখন থেকে তোমার হাতে হাতে কাজ করবো | "
অদিতির মা তবুও শুনেছিলেন না, চামেলীকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন এগারো ক্লাসে | কিন্তু শেষ পর্যন্ত চামেলী তার পড়াটা এগিয়ে নিয়ে যায়নি, কারণ, এর কিছুদিনের মধ্যেই অদিতির মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে |
মামা, মামী আর অদিতিদিদিকে সামাল দিতেই সংসারটাকে আগলাতে শুরু করে চামেলী | চামেলীর থেকে অদিতি বছর খানেকের ছোটো হলেও অদিতিকে সে দিদি বলেই ডাকে |
অদিতির মা ক্যান্সারের সাথে বহু বছর লড়াই করে যখন মারা যান, তখন অদিতি এম. এ পাশ করে গেছে | অদিতির মা নিজে একজন স্কুল টিচার ছিলেন, তাই মায়ের চাকরিটা বছর খানেকের মধ্যেই অদিতির হয়ে গেলো | অদিতিও তার মায়ের মতনই হাই স্কুলের দিদিমণি হয়ে গেলো |
অদিতি চাকরিতে যোগ দেওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই হঠাৎ ঘুমের মধ্যে অদিতির বাবাও চলে গেলের চিরনিদ্রার দেশে | বাড়িতে তখন শুধু চামেলী আর অদিতি | সেই সময় অদিতির মামারা মৈনাকের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন | বাবা মা নেই তো কি হয়েছে, সামনে দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধুমধামের সঙ্গে ভাগ্নীর বিয়ে দিলেন তারা |
বিয়ের পরে মোটামুটি বছর আটেক ভালোই কাটলো অদিতি আর মৈনাকের সংসার | কিন্তু সম্পর্কটা ভাঙতে শুরু করলো ওদের দুজনের মাঝে তৃতীয়র উপস্থিতির কারণে |
এই তৃতীয় কোনো মানুষ নয়, এই তৃতীয় আজকের সমাজে স্টেটাস দেখানোর মতো একটি খুবই প্রয়োজনীয় বস্তু, যার নাম মদ | প্রথম প্রথম মৈনাকের সুরাপানে অদিতি আপত্তি করলেও বিরোধীতা করতো না | কারণ, মৈনাকের সুরাপান তখনও তার সীমা অতিক্রম করেনি |
কিন্তু সময়ের আবহে মৈনাকের নেশা গেলো বেড়ে | অদিতির মেয়ে মুক্তো বাবার তৈরী করা এই অস্বস্তিকর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলো না | মুক্তো যত বড়ো হতে থাকে, ততই প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে বাবার প্রতি | ফলে, অশান্তি দ্বিগুন হারে বাড়তে থাকে |
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে অদিতি | কিন্তু নেশার কবল থেকে বেরোতে পারে না মৈনাক | বলা যায়, তাকে বেরোতে দিলো না তার বন্ধুবান্ধবের দল এবং মৈনাকের দুর্বল মানসিকতা | মুক্তোর মেধা এবং জীবনবোধ যথেষ্ট ইর্ষণীয় ছিল | তাই মুক্তো যেন সুস্থ পরিবেশে বড়ো হয়ে উঠতে না পারে, তার বহুল প্রচেষ্টা মৈনাকের বন্ধুরা করেছে | আজকের সমাজে নিজেদের সন্তানকে ছাপিয়ে অন্য কারোর সন্তান দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেলে মনের মধ্যে তো ঈর্ষা জমবেই | তাই বন্ধুরা যখন দেখতো, সাত আটদিন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ মৈনাক মদ ছুঁচ্ছে না, তখন মেসেজ করে, ফোন করে মৈনাককে দুর্বল করে তুলতো মদের প্রতি, বারবার ফোন করে বলত, "চল ভাই, আজ একটু মদ খাই আমরা | "... মৈনাকও একটা সময়ের পরে বশ্যতা স্বীকার করতো নেশার সামনে | স্ত্রী, মেয়ের সামনে বহুবার কথা দিয়েও কথার খেলাপ করেছে সে |
এদিকে বাবার এরকম মদ্যপ জীবন মুক্তোকে ক্রমশঃ বিদ্রোহী করে তুলছিলো মুক্তোকে | অদিতি বুঝলো, মৈনাকের বন্ধুরা কেউই চায় না, যে মৈনাক ওর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে সুখে থাকুক | কারণ তাদের কারোরই দাম্পত্য বোঝাপড়া মৈনাক আর অদিতির মতো ছিল না |
স্বামীকে অনেক করে বুঝিয়েও যখন হোলো না, তখন অদিতি মৈনাককে বলল, "একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে চলো | উনি তোমাকে মেডিসিন দেবেন, কিছু এক্সারসাইজ দেবেন, দেখো, বেরিয়ে আসতে পারবে এই নরক থেকে | "
কিন্তু মৈনাকের পৌরুষে বাধছে ডাক্তার অব্দি পৌঁছতে | তার সাথে আছে বন্ধুদের প্ররোচনা | অদিতি আর কোনো হিসেব মেলাতে পারলো না, বাধ্য হয়ে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল নিজের বাড়িতে | বর্তমানে এই বাড়িতেই অদিতি, মুক্তো আর চামেলী থাকে |
নিমন্ত্রণের চিঠি বিলোনোর দিন পনেরো বাদে একটি ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে গেলো | কি সেই ঘটনা যে ভাইরাল হয়ে গেলো !!
বিষয়টা হোলো এইরকম -- সবাই কোনো দুজন মানুষের বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী এই ধরণের অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ করে, কিন্তু এই প্রথম সমাজের সবাইকে চমকে দিয়ে কেউ দুটো মানুষের বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য অনুষ্ঠান করছে | সেখানে সাজানো গেটে বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে "অদিতি ডিভোর্সড মৈনাক " | নিমন্ত্রিতদের তালিকায় সপরিবারে আছে মৈনাক ও তার বিশাল বন্ধুমহল | সাথে অদিতির স্কুলের কলিগরা, আরও কিছু বন্ধুবান্ধব, ও আত্মীয়স্বজনও আছেন |
এখন প্রশ্ন হোলো, এমন একটা বিটকেল অনুষ্ঠানে এরা এলেন কেন ?? এমন অনুষ্ঠানে কেউ আসে নাকি ?? আসলে নিমন্ত্রণ পত্রে অদিতি লিখেছিলো, "আমার একটা বড়ো প্রমোশন হয়েছে | তাই সেই সুখের মুহুর্তটা আপনাদের সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই | তাই একটা সন্ধ্যা আমার বাড়িতে আপনাদের আমন্ত্রণ রইল | "
নিমন্ত্রণ পত্রের কারণ কারোরই অসঙ্গত মনে হয়নি | সবাই ধরে নিয়েছেন, অদিতি বোধহয় হেড টিচারের পরীক্ষায় পাশ করে গেছে | তারই ট্রিট দিচ্ছে সে | কারণ, খুব ছোটো ছোটো কারণেও ট্রিট দেওয়া অদিতির চিরকালের স্বভাব |
কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে নিমন্ত্রিত স্থানে পৌঁছে সবাই স্তম্ভিত!! এই বিশেষ দিনটাতেও অদিতি সুন্দর করে সেজেছে | সবাইকে আপ্যায়ন করে বলেছে, "আপনারা আমার বিয়েতে সবাই নিমন্ত্রিত ছিলেন | আমার বিয়েটা ভেঙে গেছে | সমাজ বেশিরভাগ সময়েই একটি বিয়ে ভাঙার পিছনে মূলত স্ত্রীকেই দোষ দেয় | কিন্তু আজ এখানে উপস্থিত মৈনাকও হয়তো স্বীকার করবে, এই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পিছনে আমার বিশেষ কোনো হাত নেই | আমরা দুটো মানুষ সময়ের আবহে দুরকম পরিস্থিতিতে চলতে শুরু করেছি | আমাদের চিন্তা ভাবনা, আমাদের জীবনে চলার পথ সব টুকুই যখন আলাদা হয়ে গেছে, তখন আমরা এক ছাদের তলায় আর একসাথে থাকতে পারিনি |
আপনারা হয়তো আশ্চর্য হচ্ছেন এমন একটা কারণের জন্য আপনাদেরকে আমন্ত্রণ করেছি বলে | কিন্তু একটা বিয়ের যদি রিসেপশন হতে পারে, তাহলে একটা ডিভোর্সের কেন রিসেপশন হবে না ?? সেটাও তো জীবনের একটা অংশ !! সেটাও তো একটা প্রমোশন !! একটা অসুস্থ সম্পর্কের মধ্যে থেকে দিনের পর দিন কষ্ট পাওয়ার থেকে ভালো নয় কি নিজের শর্তে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করা !! ডিভোর্সি তকমাটা একটা মানুষের জন্য নতুন একটা উপাধি | যিনি যেচে এই তকমাটা নিজের নামের সাথে জুড়ছেন, তিনি সব কিছু ভেবেই নিচ্ছেন নিশ্চয়ই |
আমিও তাই করেছি | মৈনাকের জীবনের ধারার সাথে তালে তাল মেলাতে পারছিলাম না আমি আর মুক্তো | তাই মৈনাকের জীবন থেকে সরে এসেছি আর এই সিদ্ধান্তে আমরা মা - মেয়ে দুজনেই খুব খুশি |
তাই ভাবলাম, ভবিষ্যতে যাতে আপনারা কেউই আমার ডিভোর্স নিয়ে দুঃখী না হন, কোনো চৰ্চা করে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট না করেন, তার জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম | সবাই খুব আনন্দ করুন, পেট ভরে, মন ভরে খান | আর বিশেষ করে মৈনাকের বন্ধু যারা আছো, তাদেরকে বলছি -- আজকের এই বিশেষ দিনটা এসেইছে তোমাদের মহানুভবতার জন্য | আজ তোমরা সবাই খুব আনন্দ করো | দেখো, বন্ধুর বিয়ে ভাঙার পার্টি কেমন হয় !! এমন পার্টিতে তো আগে কখনো অংশগ্রহণ করোনি | তাই, যত পারো, মজা লুটে নাও | "
অদিতির এই লম্বা স্পিচটা আর কেউ নয়, স্বয়ং মুক্তো ভিডিও করেছিল সবার আড়ালে | তারপরে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে লিখেছিলো, "এমন ব্যতিক্রমী ভোজ দিতে গেলে শুধু অর্থ থাকলেই হয় না, থাকতে হয় মনের জোরও যা আমার মায়ের আছে | আমি তোমার জন্য গর্বিত মা, খুব গর্বিত | আমি খুব খুশি যে আগামী দিনগুলো আমি তোমার নাম নিয়ে এগিয়ে যাবো | পাশে আছি, সাথে আছি সবসময় | অনেক আদর আর ভালোবাসা ..... " |
সেদিন সেই অনুষ্ঠান বাড়িতে উপস্থিত মানুষদের সাথে সমাজের অনেকেই জানলেন, ডিভোর্স মানে কোনো লজ্জা নয়, ডিভোর্স একটা মুক্তি, আর সেটাকেও মন চাইলে উদযাপন করাই যায় !!