Ananya Podder

Romance Classics Inspirational

4  

Ananya Podder

Romance Classics Inspirational

স্বর্গীয়

স্বর্গীয়

11 mins
528


কিছুক্ষন ভেবে নম্বরটা ডায়ালই করে বসলো শ্রীপর্ণা | তার কাছে আর অন্য কোনো রাস্তা নেই | স্বরাজকে বাঁচাতে গেলে তাকে আর এক মুহুর্ত ভাবলেও চলবে না | বার তিনেক রিং হতেই ওপার থেকে পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল, "হ্যালো... "


শ্রীপর্ণা কিছুটা সংকোচের সাথে উত্তর দিলো, "আমি শ্রীপর্ণা বলছি | "


ফোনের ওপারে তখন সাময়িক নিস্তব্ধতা | তারপর ডক্টর ভাস্কর দত্ত জবাব দিলেন, "ফোন করলে তাহলে তুমি?? আমি সত্যিই ভাবিনি, তুমি ফোন করবে আমায় !! "


"দেওয়ালে পিঠে ঠেকে গেছে আমার | ফোন তো করতেই হোতো আমাকে | বলুন, কোথায় কখন আসতে হবে আমাকে ?? "


"আমার নিউ টাউনে একটা ফ্ল্যাট আছে | সেটা বন্ধই পড়ে থাকে সবসময়, সেখানে চলে এসো তুমি | "


শ্রীপর্ণা উদাসীন ভাবে বলল, "তারিখ, সময় বলে দিন | চলে আসবো আমি | "


"পরশু এসো সন্ধ্যের পরে | তোমাকে তো আবার বিকেলে পাওয়া যাবে না | ওই সময়টা তো আবার ভিজিন্টিং আওয়ার্স | এক কাজ করো, ভিসিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেলে তুমি নার্সিংহোমেই থেকো, আমার চেম্বারে বসে থাকবে | আমার ড্রাইভার তোমাকে আমার গাড়িতে করেই পৌঁছে দেবে আমার ফ্ল্যাটে | "


"বেশ "... বলেই ফোনটা রেখে দিলো শ্রীপর্ণা |


কিছু মুহুর্ত পরেই আবার ফোনটা বেজে উঠল | ওপার থেকে ভাস্কর একটা ক্রুর হাসির সাথে বলল, "সেদিন যখন আসবে, তখন কিন্তু সুন্দর করে সেজে আসবে শ্রী | তোমার চোখে মুখে যেন কোনো চিন্তার ছাপ না থাকে | তাহলে কিন্তু তোমাকে ডাকার কোনো মানে থাকবে না আমার |"


"আপনার কোনো চিন্তা নেই ডক্টর ভাস্কর | আপনি যেভাবে আমাকে দেখতে চান, সেভাবেই সেদিন পৌঁছে যাবো আপনার কাছে |"


দুদিন বাদে একটা লাল শিফন শাড়ী পরে চেহারায় হাল্কা মেকআপ করে একটা লম্বা বেণীতে রজনীগন্ধার মালা লাগিয়ে যখন স্বরাজের সাথে দেখা করতে এল শ্রীপর্ণা, তখন তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল স্বরাজ | আজ যেন স্বর্গের অপ্সরা লাগছে শ্রীপর্ণাকে !! অপরূপ চেহারার সাথে একঢাল লম্বা চুল শ্রীপর্ণার লাবণ্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে | ঈশ্বর তার ভাগ্যে শ্রীপর্ণার ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন বলে ঈশ্বরকে সবসময় ধন্যবাদ জানায় স্বরাজ | নাহলে কোথায় শ্রীপর্ণা, আর কোথায় স্বরাজ !! এ যে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা !!


শ্রীপর্ণা আর. এম.ও. ডক্টর বিশ্বাসের সাথে কথা বলে স্বরাজের কাছে এসে বসলো | স্বরাজ বলল, "আজ বহুদিন বাদে তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে শ্রী,, কি বলবো তোমায় !! আমার সেবা করতে করতেই তোমার শ্রী হারিয়ে গেলো | মাঝেমধ্যে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় | মনে হয়, তোমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনে সর্বনাশই ডেকে এনেছি আমি |"


শ্রীপর্ণা দুধের গ্লাসে হরলিক্স মেশাতে মেশাতে বলে, "আমাকে জিজ্ঞেস করো রাজ, আমি তোমার সাথে কতটা সুখে আছি | যদি না এই... "


"যদি না এই টিউমারটা আমার ব্রেনের মধ্যে গজিয়ে উঠত, তাহলে বোধহয় আজকের এই দিনটা আমাদের দেখতে হোতো না, তাই না শ্রী ?? "


"ছাড়ো তো এসব কথা | অসুখ সবার হয় | তার জন্য লড়তেও হয় সবাইকে | আর ডক্টর ভাস্করের মতো মানুষ যখন তোমার অপারেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন আর চিন্তা কিসের আমাদের !! ডক্টর ভাস্কর দত্তকে সবাই ভগবান বলে ডাকে | উনার হাতে জাদু আছে নাকি!! শতকরা নব্বই ভাগ অপারেশন উনার হাতে সাকসেস পায় | তাহলে আর ভয় কিসের আমাদের ?? "


স্বরাজ হরলিক্সে চুমুক দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে বলল, "আমার অপারেশন উনি কেন বিনা পারিশ্রমিকে করছেন, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না | আমাকে বাঁচিয়ে উনার লাভটা কি হবে ?? "


"জীবনের সব হিসেব খাতায় কলমে কষে মেলানো যায় না রাজ | হয়তো তোমার অপারেশনটা করে জীবনের কোনো একটা চ্যালেঞ্জ জিতে যেতে চান উনি | আমাদের ওসব ভেবে কি লাভ | "


শ্রীপর্ণার দিকে তাকিয়ে এবার স্বরাজ বলল, "আজ কোথাও যাবে তুমি শ্রী ?? এতো সুন্দর করে সেজেছো যে আজ !! "


শ্রীপর্ণা একটু সচকিত ভাবে উত্তর দিলো, "হ্যাঁ, আজ আমার এক স্কুলের বন্ধুর বিয়ে আছে | বৌভাতের পরেরদিনই আমার সেই বন্ধু বিদেশ চলে যাচ্ছে নিজের স্বামীর সাথে, হয়তো আর কখনো দেখা হবে না | তাই ওর বিয়েতে উপস্থিত থাকার অনুরোধটা আর ফেলতে পারলাম না গো | তোমার এখান থেকেই সোজা ওখানে যাবো | "


স্বরাজ স্ত্রীয়ের হাতে হাত রেখে বলল, "আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, আজকের সন্ধ্যেটা যেন তোমার খুব আনন্দের সঙ্গে কাটে | খুব সুন্দর একটা সন্ধ্যে যেন আজ তুমি কাটাতে পারো | "


ডক্টর ভাস্করের কথামতো তার ড্রাইভার শ্রীপর্ণাকে নিয়ে এল ডক্টর ভাস্করের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে | বিশাল আবাসনের মধ্যে বিশাল বিশাল ইমারত | ইমারতগুলো যেন এখানে থাকা মানুষগুলোর সামাজিক উচ্চতাকে প্রকাশ করার জন্যই তৈরী হয়েছে!!"


শ্রীপর্ণাকে ডাক্তারের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে তার ড্রাইভার চলে যায় | কারণ, শ্রীপর্ণার বাড়ি ফেরার কোনো সময় নির্দিষ্ট নেই আজ | আজ যতক্ষণ খুশি ডক্টর ভাস্কর নিজের কাছে শ্রীপর্ণাকে বেঁধে রাখতে পারেন, যত খুশি আদর করতে পারেন শ্রীপর্ণাকে, যতখুশি আদর পেতে পারেন শ্রীপর্ণার কাছ থেকে | স্বামীর অপারেশন এই ভগবানতুল্য ডাক্তারের হাতে করানোর শর্ত একটাই, শ্রীপর্ণাকে উজাড় হয়ে নিবেদন করতে হবে ডক্টর ভাস্করের কাছে | একদিনের স্বামী-স্ত্রী হয়ে ফুলসজ্জার বাসর রঙীন করতে হবে |


শ্রীপর্ণা ভাস্করের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দেখলো তার পছন্দের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন দিয়ে পুরো ফ্ল্যাটটা সাজানো | একবার এক ম্যাগাজিনে এই ডিজাইনটা দেখে শ্রীপর্ণা তার বাবাকে বলেছিল, "কোনোদিন যদি পয়সা করতে পারি, তবে এভাবেই সাজাবো আমার বাড়িটা | "


শ্রীপর্ণার বাবা সুবিনয়বাবু বলেছিলেন, "এভাবে ঘর সাজাতে অনেক খরচ রে | এতো পয়সা তুই কোথায় পাবি ?? "


শ্রীপর্ণা ম্যাগাজিনটা থেকে পাতাটা ছিঁড়ে বলেছিল, "এটাকে বাঁধিয়ে আমার ঘরে রেখে দেবো আমি | আমি যদি নাও পারি, তবে আমার বর সাজিয়ে দেবে আমার ঘরকে ঠিক এই ভাবেই | "


শ্রীপর্ণার পুরোনো স্মৃতি ভাঙে যখন ভাস্কর বলে ওঠেন, "বোসো শ্রী, দাঁড়িয়ে কেন?? এই ফ্ল্যাটটা আমার যতটা, ততটা তোমারও | এই ফ্ল্যাটটা নিয়েই ছিলাম তোমার জন্য, তোমাকে নিয়ে থাকবো বলে | তাই তোমার বেডরুমে ঝুলিয়ে রাখা ম্যাগাজিনের পাতার একটা ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো | কিন্তু তুমিই তো আমাকে এমন সারপ্রাইজ..... "


শ্রীপর্ণা আকুতির সাথে বলল, "বিশ্বাস করুন, আপনাকে ঠকানোর কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না | আমি আমার বাবা মাকে প্রথম থেকেই বলেছিলাম যে আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় | কিন্তু আমার বাবা আমার কোনো কথা শোনেননি | আপনার মতো একজন নিউরোসার্জন বিনে পয়সায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধারও করবেন, আবার সেই মানুষটার স্ত্রীয়ের অপারেশনও করবেন নিখরচায়, এমন অফারের লোভ আমার বাবা সামলাতে পারেননি | তাই আমার হাজার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আপনার সাথে আমার বিয়েটা ঠিক করে ফেলেন উনি | কিন্তু আমি যে স্বরাজকে কথা দিয়েছিলাম, আমি ওর হবো বলে | আপনার তো কত কিছু আছে জীবনে | নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, পরিবার, সব আছে আপনার | আপনি চাইলেই যে কোনো মেয়ে আপনাকে এক কথায় বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে | কিন্তু স্বরাজের যে আমি ছাড়া কেউ ছিল না | একটা অনাথ ছেলে আমায় ভালোবেসে নিজের একটা ঘর, একটা পরিবার তৈরী করতে চেয়েছিলো | আপনার প্রতিপত্তি, সামাজিক সম্মানকে পাওয়ার জন্য ওকে কি করে ঠকাতাম বলুন ?? "


"তাই জন্য আমাকেই ঠকাতে হোলো তোমার !! যে কোনো মেয়ে নাকি আমার বৌ হতে রাজী হয়ে যাবে !! তুমি হয়েছিলে কি রাজী আমার বৌ হতে ?? তোমরা সবাই যুক্তি করে আমাকে ঠকিয়ে ছিলে | বিয়েই যদি করবে না, তো তোমার মায়ের অপারেশনের আগেই জানাতে পারতে আমাকে সে কথা | জানাওনি তো ?? ভয় পেয়েছিলে, তাই না ?? যদি তোমার মায়ের অপারেশনটা বিনা পয়সায় না করি আমি !! এতো স্বার্থপর হতে পারলে তুমি !! আমাকে ব্যবহার করে আমার ভালোবাসার সাথে খেলা করতে একটু অস্বস্তি হয়নি তোমার !! "


"বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে ঠকাতে..... "


শ্রীপর্ণার মুখের কথা থেমে যায় ডক্টর ভাস্করের হাতের ইশারায় | "থাক শ্রী সেসব কথা | আজকের সন্ধ্যা আর রাতটা আমার স্ত্রী হয়ে কাটাও তুমি | দেখো, তোমার পছন্দমতো সাজানো এই ফ্ল্যাট | এই ফ্ল্যাটে যা আছে সব তোমার | এই ফ্ল্যাটের মালিক আমিও আজ তোমার | আজ আমাকে আপন করে নাও | একটা সন্ধ্যে আমাকে এমন ভাবে ভালোবাসো, যেভাবে রোজ স্বরাজকে ভালোবাসো তুমি | আজ নিজের হাতে আমাকে সেভাবে খাইয়ে দাও, যেভাবে রোজ তোমায় স্বরাজকে খাওয়াতে দেখি | "


শ্রীপর্ণা মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকে | সে উপলব্ধি করে, ভালোবাসায় কতটা আঘাত পেলে এমন নির্মম প্রতিহিংসার খেলায় মেতে উঠেছে ভাস্কর !!


সেদিন রাত্রে ভাস্করের রান্নাঘরের বাসনপত্রগুলোর শ্রীপর্ণার হাতের ছোঁয়ায় উদ্বোধন হয় | শ্রীপর্ণা দই কালিয়া রান্না করে, সাথে মাটনের ঝোল আর গরম ভাত | এই সব পদগুলোই ভাস্কর দত্তের খুব প্রিয় | বিয়ের আগে একবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ভাস্করকে খাইয়ে ছিলেন শ্রীপর্ণার বাবা মা | আজ ফ্রিজ খুলে সেই জিনিসগুলো দেখে শ্রীপর্ণা ভাস্করকে আর জিজ্ঞেস করেনি, "আপনার কি পছন্দ বলুন, তাই রান্না করছি |"


খাওয়ার টেবিলে একগ্রাস ভাত মেখে যখন ভাস্করের মুখের কাছে ধরেছিলো শ্রীপর্ণা, তখন ভাস্করের ছলছল চোখদুটো তার দৃষ্টি এড়ায়নি | তবে শ্রীপর্ণার হাতে ভাস্কর আর খায়নি | মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, "আমি তো স্বরাজ নই, যে, তোমাকে অভুক্ত রেখে নিজে খেয়ে নেব | আজ তুমি খাও, আমি দেখি তোমায় | "


শ্রীপর্ণার গলা দিয়ে নামছিল না ভাতের গ্রাস, তবুও তাকে আজ খেতে হবে | আজ যে সে ডক্টর ভাস্করের হাতের পুতুল | যন্ত্রের মতো তার ইশারায় আজ সারা সন্ধ্যে আর রাত তার সাথে কাটানোটাই হোলো স্বরাজের অপারেশনের ফিজ !! আজ নিজেকে যতটা পারবে নগ্ন করে দেবে শ্রীপর্ণা | আজ তার শরীর, মন, চরিত্রকে নিষ্পাপ রাখার চেয়েও বেশি দামী স্বরাজের বেঁচে থাকা |


খাওয়ার পরে ভাস্কর শ্রীপর্ণাকে নিয়ে যায় শোবার ঘরে | তাকে ঘরে নিয়ে যেতেই শ্রীপর্ণা দেখে তার এক বিশাল ছবি বিছানার মাথার কাছের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো | বিছানায় শ্রীপর্ণাকে বসিয়ে তার দু কাঁধে হাত রাখে ভাস্কর | ভয়ে, লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে শ্রীপর্ণা | মনে মনে সে ক্ষমা চায় স্বরাজের কাছে, তার শরীরটা এভাবে ভাস্করের কাছে বিলিয়ে দিচ্ছে বলে | দুচোখ দিয়ে তার জল বেরিয়ে আসে |


ভাস্কর শ্রীপর্ণার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, "চোখ খোলো শ্রী, তোমার আব্রু আমি নষ্ট করবো না | ভয় পেও না প্লিজ আমাকে | এই ঘর, এই বিছানা, এই ঘরের সবকিছু সাজিয়ে ছিলাম শুধুমাত্র তোমার জন্য | স্বরাজের অপারেশনের পারিশ্রমিক হিসেবে আমি চাই, তুমি আজ রাতটা এই ঘরে কাটাও | এই ঘরটা একটা রাতের জন্য হলেও তোমায় অনুভব করুক একটু | "


শ্রীপর্ণা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ভাস্করের দিকে | তারপরে অস্ফুটে বলে ওঠে, "আপনি আমাকে... "


"দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো শ্রী | অনেক রাত হয়ে গেছে | ".... কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান ডক্টর ভাস্কর |


এরপরে কেটে গেছে আরও সাত আট মাস | ডক্টর ভাস্করের হাতের গুণে স্বরাজের মাথার টিউমার একেবারে গোড়া থেকে নিপাত গেছে | অপারেশনের পরে নার্সিংহোমের বাকি বিলটুকুও ডক্টর ভাস্কর নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন | ডক্টর ভাস্করের এমন জনদরদী ভূমিকায় কেউ প্রশ্ন তোলেনি, কারণ, এমন জনদরদী কাজ ডক্টর ভাস্কর দত্ত মাঝেমধ্যেই করে থাকেন | অকৃতদার মানুষ হলে যা হয় আর কি !!


স্বরাজ এখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে | আগের মতোই চাকরি করছে সে | তার পরিবারে এখন খুশির হাওয়া বইছে, কারণ, শ্রীপর্ণা মা হতে চলেছে | মৃত্যুর সাথে লড়াই করে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই মনে হয়েছে, সংসারে কম বেশি অভাব থাকবেই | তবে জীবনকে আরও সুন্দর করে উপভোগ করতে তাদের জীবনে একজন নতুন কারোর আসার প্রয়োজন আছে | তাতে ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে |


একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে স্বরাজ | ঠিক এমন সময় নিজের বলেনো গাড়িটা নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ান ডক্টর ভাস্কর দত্ত | গাড়ির দরজা খুলে স্বরাজকে বলেন, "উঠে আসুন স্বরাজবাবু, আপনাকে আমি বাড়ি অবদি পৌঁছে দিচ্ছি |"


সেদিন গাড়িটা ডক্টর ভাস্কর নিজেই চালাচ্ছিলেন, তাই ডক্টর ভাস্করের পাশের সিটটাতেই বসলো স্বরাজ |


ডক্টর ভাস্কর বললেন, "এখন কেমন আছেন বলুন?? "


"আপনার দয়াতেই তো সুস্থ হলাম ডক্টর ভাস্কর | নাহলে আপনার মতো এতো দামী ডাক্তারের কাছে অপারেশন করানোর দাম আমাদের ছিল নাকি !! আপনার অপার করুণায় আবার এ জীবন ফিরে পেলাম আমি | "


ডক্টর ভাস্কর কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন, তারপরে বললেন, "আপনি বিশ্বাস করেন স্বরাজবাবু, পৃথিবীতে বিনা পয়সায় প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় !! আপনি আমাকে যতটা ভগবান ভাবছেন, আমি কিন্তু ততটা ভগবান নই | জানি, আপনার শুনলে খারাপ লাগবে, তবু একটা কথা আপনার জেনে রাখা ভালো | আপনার সাথে শ্রীপর্ণার বিয়ে হওয়ার আগে আমার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল | ওর মায়ের অপারেশন, ট্রিটমেন্ট সবকিছু আমিই করেছিলাম কারণ ওকে বিয়ে করবো বলে | কিন্তু আমায় ফাঁকি দিয়ে শ্রী আপনার সাথে পালিয়ে যায় | তাই সময়ের আবহে যখন আপনার জন্য শ্রী ছুটে আসে আমার কাছে, তখন সেই সুযোগের সদব্যবহার করি আমি | একটা পুরো রাত আপনার স্ত্রী আমার ঘরে কাটায় | আপনার অপারেশন করার জন্য সেটাই দাম ধরেছিলাম আমি | হতে পারে, আপনার ঘরে যে সন্তান আসছে, সে আমারই দানের ফল | "


স্বরাজ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো, তারপর ঠোঁটের কোণে একটা স্নিগ্ধ হাসি এনে বলল, "আমার সন্তান আপনারই দানের ফল, ডক্টর দত্ত, সেটা আমি জানি | আপনি আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ না করে তুললে আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতাম না, আবার সংসার চালানোর মতো অবস্থায় পৌঁছতে পারতাম না, আবার ভালোবেসে শ্রীয়ের মধ্যে মিশে যেতে পারতাম না | আমি জানিনা, আপনার সাথে শ্রীয়ের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিনা, তবে এটুকু জানি এমন কোনো সম্পর্ক হলেও সেই সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা ছিল না | সেটা শ্রীয়ের তরফ থেকে আমার অপারেশনের জন্য আপনাকে দেওয়া ফিজ ছিল | আমি জানি, নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার সেই মুহূর্তেও শ্রীয়ের মন জুড়ে শুধু আমিই ছিলাম | তাই, আমার স্ত্রী আমার চোখে আজও নিষ্কলঙ্ক | তার শরীরকে আপনি অপবিত্র করতে পারেন ব্ল্যাকমেল করে, কিন্তু তার মনকে আপনি ছুঁতে পারেননি | তাই, যে সন্তান আসছে সে আমার ভালোবাসার সন্তান, সে কখনোই আপনার নয় | "


স্বরাজের বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ডক্টর ভাস্কর বললেন, "আজ বুঝলাম, কেন শ্রীপর্ণা আমাকে বাদ দিয়ে আপনাকে ভালোবেসে ছিল | কেন আপনাকে বাঁচাতে আমার কাছে নিজেকে সমর্পন করতে চেয়েছিলো | সত্যিই আপনাদের ভালোবাসা ঐশ্বরিক, সেখানে আমার মতো মানুষের ভালোবাসার কোনো দাম নেই | আমি আপনার মতো ঈশ্বর হতে পারিনি, তাই মানুষ হয়ে নিজের মনের ইচ্ছে পূরণ করেছিলাম | যে ঘরটা পরম যত্নে শ্রীপর্ণার জন্য সাজিয়েছিলাম, সেই ঘরে একটা রাত জেদ করে আটকে রেখেছিলাম শ্রীপর্ণাকে , কিন্তু শ্রীপর্ণার শরীর আমি স্পর্শ করিনি | ওকে যে আমিও ভালোবাসি | কি করে নিজের ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করতাম বলুন !! শ্রীপর্ণার ভালোবাসা খাঁটি, সেটা আমি বুঝে গেছিলাম, কিন্তু আপনি শ্রীপর্ণার কতটা যোগ্য, সেটাই যাচাই করলাম | দেখলাম, আপনার চেয়ে আর কেউ বোধহয় শ্রীপর্ণার ভালোবাসার দাবিদার হতে পারে না !! চলুন, নেমে পড়ুন, আপনার বাড়ি এসে গেছে | শ্রীপর্ণা আপনার জন্য হয়তো অপেক্ষা করে আছে | "


"আপনিও আসুন না আমাদের ছোট্ট ঘরে | কথা দিচ্ছি, ডক্টর দত্ত, আপনার আদর যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না | "


ডক্টর ভাস্কর একটু হেসে বললেন, "না স্বরাজ, আপনার ওই ঘরে স্বর্গীয় অনুভূতি আছে | সেখানে আমার মতো একজন সামান্য মানুষের না যাওয়াই ভালো | আপনারা দুজন খুব ভালো থাকুন | আপনাদের আগত সন্তান আপনাদের জীবন আরও স্বর্গীয় করে তুলুক, এই কামনাই করি | "


স্বরাজকে ঘরের দরজায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন ডক্টর ভাস্কর দত্ত | তিনি স্বরাজের ঘরকে স্বর্গ বললেও সেই স্বর্গে যে দেবী বাস করে, তাকে তো তিনিও ভালোবাসেন | তার ভালোবাসাও কম নিষ্পাপ নয়, কম সুখ নেই শ্রীপর্ণাতে নিবেদিত তার ভালোবাসতেও | তিনি যে দেখতে পাবেন না তার স্বর্গের দেবীকে আর কোনো দেবতার কাছে সমর্পিত হতে | কি করে দেখবেন!! তিনি তো মানুষ, মানুষের এতো উদারতা থাকে না যে !! তাই নিঃশব্দে এমন পালিয়ে যাওয়া | এমন পালিয়ে যাওয়াতেই বোধহয় নিস্পত্তি মিলবে জীবনে যত দুঃখ আছে তার | আশেপাশে মানুষ তাকে যতই দেবতা বলে ডাকুক না কেন, স্বর্গের দেবী এ জনমে তার ভাগ্যে নেই | তিনি এ জীবনটা অভিশপ্ত দেবতা হয়েই রয়ে যাবেন, তবে বুকে বয়ে বেড়াবেন শ্রীপর্ণার জন্য স্বর্গীয় ভালোবাসা!!


সামনের অনির্দিষ্ট পথে ছুটে চলল ডক্টর ভাস্করের গাড়ি | সামনে যে এখন অনন্ত পথ পড়ে আছে একা একা চলার জন্য !!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance