চিরযৌবন
চিরযৌবন
"ওই শুনছো, কি গো ঘুমিয়ে পড়লে?"
জিজ্ঞেস করে সুলতা তার স্বামী রঞ্জনকে। রঞ্জন ঘুমের ঘোরেই বলে "কি হয়েছে? ঘুমিয়ে পড়ো না।"
সুলতা হঠাৎ পঁচিশ বছর আগের মতো, যখন সবে সবে বিয়ে হয়েছে, তখনকার মতো গলা জড়িয়ে ধরে স্বামীর। রঞ্জন বিরক্তের চেয়ে বেশি অবাক হয়। সাধারণত স্ত্রীকে দেখছেন প্রতি রাতে এই নাই,সেই নাই এর ফিরিস্তির তালিকা দিতে। আজ কি হলো।
"ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন? "
রঞ্জন আলো ছাড়া ঘুমোতে পারে না দেখে সুলতা ঘর অন্ধকার করে ঘুমোনোর স্বভাবটা পরিবর্তন করেছে। এখন এমন হয়েছে আলো ছাড়া শুলে মনে হয় অন্ধকার গিলে নিতে আসছে তাকে।
হঠাৎ রঞ্জন স্ত্রীর কপালে হাত রেখে গায়ের তাপমাত্রা পরখ করতে যেতেই সুলতা স্বামীর হাতখানি ধরে নিয়ে বললো "ধুর বাবা কি করছো?"
" না মানে দেখছি শরীরটা ঠিক আছে নাকি?"
" আমার আবার শরীর খারাপ হতে যাবে কেন? যত রাজ্যের বোকা বোকা কথা।"
রঞ্জন বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বললো "তবে ভুলভাল বকছ কেন?"
সুলতা স্বামীর গলা ছেড়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল
" কি ভুলভাল বকলাম?"
" ভুলভাল কথাটা ঠিক না, বলতে হয় অন্য সুরে কেন গান গাইছো?"
" এইজন্য বলে কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয়না, ভালো করে কথা বলছি সহ্য হচ্ছেনা না তোমার..."
" কি??? আমাকে কুকুর বললে?"
" ধুর কে কুকুর বলেছে তোমায়? কুকুর মোটেও বলিনি। ওটা একটা উপমা।"
" আর কোনো উপমা ছিল না.."
" মনে পড়েনি, ধুর যেটা বলতে চাইছিলাম সেটাই বলা হলো না।"
এবারে রঞ্জন ঢোক গিলে, কি না কি বলবে স্ত্রী।
সুলতা আদুরে গলায় বলে " বলছি একটা কথা বলি?"
রঞ্জন চুপ করে থাকে, চুপ থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ।
সুলতা হাতের নখ খুটতে খুটতে বলে " পরশু কি?"
রঞ্জনের কপালে ঘাম জমে যায়। সুলতার জন্মদিন, ওদের বিবাহবার্ষিকী আর ওদের প্রথম দেখা মনে করতে থাকে, এই মাসে তো কোনটাই না। ঠিক মনে পড়ে না এই মাসে ঠিক কি ঘটেছিল, তাও আবার ওই দিনে।
সুতলা উঠে বসেছে ততক্ষণে," কি চুপ করে আছো যে?"
" কি বলব?"
" ধুর তুমি না সত্যি বুড়ো হয়ে গিয়েছ।"
"কি উত্তর দেবো, কথাটা তো ভুল না। পঞ্চাশ পেরিয়েছে বছর দুই হলো। তবে আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট হলেও ওকে দেখে বোঝা যায়না। সন্তান নেই আমাদের, তাই হয়তো শরীরে প্রভাব পড়েনি সুলতার।" মনে মনে কথাগুলো ভেবে চুপ করে থাকে রঞ্জন।
রঞ্জনকে চুপ থাকতে দেখে আবার খোঁচায় সুলতা, "কি উত্তর দিচ্ছোনা যে?"
" কি উত্তর দেবো, দুপুর রাত্রে না ঘুমিয়ে KBC শুরু করলে চুপ থাকবো না তো কি করব?"
" এতোটুকুতেই KBC.. " বলে মুখ ভাড় করে সুলতা।
" আচ্ছা বলেই দাও না কি পরশু কি? জানোই তো আমার এসব বার দিন সাল মনে থাকে না। তাই তো মাধ্যমিকের পরে আর ইতিহাস পড়ার সাহস পায়নি।" আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলে রঞ্জন।
সুলতা হেসে ফেলে বলে "তা জানি তো, এতো বছর ধরে যে মানুষের সাথে সংসার করছি তা জানবো না? আচ্ছা সে সব ছাড়ো তুমি ছুটি নেবে সেদিন।"
অকারণ ছুটি নষ্টের এক্কেবারে পক্ষপাতি না রঞ্জন। কখন দরকার পড়ে যায় কে জানে? তাদের দুইজনের বাড়িই দূরে দুই জেলায়, যেতে গেলে একটা দিন প্রায় শেষ আর তাই কোনো দরকারে বাড়ি গেলে ছুটি নেওয়া পড়েই যায়।
" কি চুপ আছো বললে না?"
" সে দেখা যাবে, এখন ঘুমোও।"
সুলতা বেজার মুখে পাশ ফিরিয়ে শুলো। মৃদু স্বরে গুনগুন করতে শুরু করলো, "কি বেরসিক মানুষ, আমি বলে এরসাথে সংসার করছি।"
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরী হয়ে গেল। উঠে স্ত্রী মুখ গম্ভীর দেখে প্রমাদ গুনলো রঞ্জন। সুলতার বড্ড খারাপ স্বভাব, রাগলে কথা না বলে কাজ করে যায়। রঞ্জন বুঝতে পারলো তাকে ঘুম থেকে না ডেকে দেওয়ার কারণ। বাড়িতে মাত্র দুটো প্রাণী তারমধ্যে একে অপরের সাথে কথা না বললে কি চলা যায়? কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। অফিসে বের হয়েও মনটা ভালো হলো না, সারাদিন মাথায় চাপ দিয়েও আগামীকাল তাদের জীবনের কি বিশেষ দিন রয়েছে মনে করতে পারলো না। তবুও বলে করে অর্ধেক দিনের ছুটি মঞ্জুর করালেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি মেলা বড় মুশকিল। রঞ্জনের সাথে সুলতার বিয়ে মা ঠিক করেছিলেন। উনার সখীর মেয়ে সুলতা, কলকাতায় পড়তে এসেছিল, পাস করেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি চাকরি পেতেই একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেন ওদের মা। ইচ্ছে ছিলনা রঞ্জনের এতো দ্রুত বিয়ে করার৷ বিয়ের পরেও সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বিয়ের বছর দেড়েক পরেই সুলতা গর্ভবতী হয়। বাড়ির সবাই খুশী, রঞ্জন প্রথমে খরচ আর ভবিষ্যৎ সরকারি চাকরির প্রস্তুতির কথা ভেবে খুঁতখুঁত করলেও বাবা হবার আনন্দে সেটা মন থেকে দূর হতে সময় লাগেনি। সুলতাকে প্রথম মাস থেকে নিয়ে যাবার জন্য দুই পরিবার জোর করলেও রঞ্জনের এখানে একা সব সামলাতে অসুবিধা হবে ভেবে সে যায়নি প্রায় পাঁচ মাস, কিন্তু শেষ কয়মাস বাড়ির কেউ বারণ শোনেনি নিয়ে গিয়েছিল সুলতাকে। সবই ঠিক ছিল, সুলতা রঞ্জন উভয়ের বাড়ি গ্রামীণ এলাকায়, কিন্তু রঞ্জনের বাড়ি তুলনামূলক ভালো জায়গায় থাকায়, সেখানেই সুলতাকে রাখা হয়।। ঠিক সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করিয়েও ডাক্তার আর নার্সের ভুল চিকিৎসার কারণে মেয়েকে হারায় রঞ্জন, সুলতা মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে। ডাক্তার জানিয়ে দেয় আর কোনো দিনও মা হতে পারবেনা। তারপর থেকে রঞ্জন জীবনে যে উচ্চাশা ছিল সব ত্যাগ করে দেয়। সবসময় মনে হতে থাকে কি হবে করে? কার জন্য করবে। সুলতার ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু রঞ্জন এতোটাই ভেঙে পড়েছিল যে সুলতাকে নিজের কষ্টকে ভুলতে হয়েছে। তবুও এতো করেও আর রঞ্জনকে কোনো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসাতে সক্ষম হয়নি সুলতা। এই একই প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে রয়ে গিয়েছে রঞ্জন, বাইরে বদলি সাথে সাথে পদন্নোতি হতো, রঞ্জন রাজি হয়নি। তাই কতৃপক্ষ রঞ্জনকে এখানেই রেখে যতটা সম্ভব পদোন্নতি করে দিয়েছে। বছর তিন হলো দুই কামরার ছোট ফ্ল্যাটটা কিনতে পেরেছে।
বাড়ি ঢুকতেই সুলতা এসে প্রতিদিনের মতো ব্যাগখানা থেকে টিফিন বাটি বের করে নিয়ে যায়, আসার সময় এক গ্লাস জল এনে সামনে রাখতেই রঞ্জন সুলতার হাত ধরে ফেলে।
" আহ্ কি হলো?"
" পাশে বসোনা।"
সুলতা গোমড়া মুখে স্বামীর পাশে বসে পড়ে। রঞ্জন জল শেষ করে জুতো খুলতে খুলতে বলে " আগামীকাল ছুটি পেয়েছি.. "
সুলতা উজ্জ্বল মুখে বললো "সত্যি? "
" হ্যাঁ তবে.."
" কি তবে!! "
" Half Day পেয়েছি, দিলোনা পুরো একটা দিন ছুটি। "
সুলতা রাগ করে উঠে যাচ্ছিলো, আবার কি ভেবে বসে বললো "তা বেশ এসো তাড়াতাড়ি। " বলে গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আজ রঞ্জন সত্যিই তাড়াতাড়ি ফিরেছে, ঘরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল, ঘরটা কেমন ঝকঝকে তকতকে, সাথে ঘরে ফুলের কি সুমিষ্ট গন্ধ। সুলতা কি সুন্দর করে সেজেছে।
" সু তোমাকে কি সুন্দর লাগছে। "
সুলতা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে বললো "ধ্যাৎ.. "
" সত্যি গো, তোমাকে ঠিক কনে বৌ লাগছে।"
সুলতা স্বামীর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো "এই পাঞ্জাবীটা পড়ে তৈরি হয়ে নাও।"
" এই বয়েসে এমন রঙ সু।"
" হু।" বলে সুলতা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
সুলতা আজকে ঘি রঙের জামদানী শাড়ি পড়েছে, যার উপর লাল রঙ্গের কাজ। রঞ্জনকেও সেই রঙের একটা পাঞ্জাবি দিয়েছে। খোপায় মালা দিয়েছে, কপালে সিঁদুরের টিপ। চোখে কাজল, এতেই দারুণ লাগছে সুলতাকে।
রঞ্জন পোশাক পড়ে বের হতেই দুইজনেই বাইরে বের হলো, দেখে কত ছেলে মেয়ে জোরায় জোরায় হেঁটে যাচ্ছে। আবার ছোট ছোট বাচ্চাও রয়েছে।
" কি গো দেখছো ওদের?"
" হুঁ" বলে মাথা দুলালো রঞ্জন। আবারও হঠাৎ না দেখা জন্মের আগেই চলে যাওয়া মেয়েটাকে মনে পড়লো, মাঝে মাঝেই মনে পড়ে রঞ্জনের, ও থাকলে কত বড় হতো, কি কি করতো, এসব।
" কি গো হুঁ বলেই চুপ করে গেলে।"
" কি বলবো?"
" আজ সরস্বতী পূজা..."
" জানি তো।"
" পরশু জিজ্ঞেস করলাম বলতে পারলে কই?"
রঞ্জন বোকার মতো চুপ করে রইলো। সুলতা একটা টেক্সি দাড় করিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে নিয়ে যেতে বললো।
সরবরে ধার দিয়ে হাঁটতে থাকলো সুলতা, রঞ্জনের মনে হলো ২৫ বছর আগের সুলতাকে দেখতে পাচ্ছে। প্রথমবার কলকাতায় আনবার পরে রবীন্দ্র সরোবর দেখাতে এনেছিল, এমন করেই সেজেছিল সুলতা, ও বিয়েতে পাওয়া পাঞ্জাবীর একটা পড়েছিল।
"কি গো ওমন করে কি দেখছো?"
সুলতার কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো রঞ্জনের।
" কি বললে না?"
" তোমাকে দেখছি।"
সুলতা লজ্জিত মুখে বলল " এই বুড়ির মধ্যে কি আর দেখবে? চারিদিকে দেখো কত পরী।"
" কি যে বলো, তুমি বুড়ি, আমি কি যুবক নাকি?"
" তোমার চোখে আমি আজও দেখি আমার সর্বনাশ। "
রঞ্জনের মুখেও কেমন রক্তিম আভা ফুটে উঠলো, "তোমাকে আজ কাব্য পেয়েছে নাকি সু?"
" সেবার কিন্তু তোমার পেয়েছিল।"
রঞ্জন বললো " আর কি বয়েস আছে সু? সেবারও এমন কিছু একটা ছিল, দলে দলে ছেলে মেয়েরা এসেছিল, আমি তোমার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন সবকিছু কি সহজ সুন্দর ছিল তাই না?"
" এখনও সব আছে তুমি আছি, হয়তো আমাদের দেহের বয়স হয়েছে, ভালোবাসার বয়স হয়নি, হবে না। ভালোবাসা যে চিরযৌবন। "
" সু.."
" কি?"...
" পরের জন্মে বিশ্বাস করো? "
" করি, কি করিনা, ঠিক জানিনা, কেন গো?"
" যদি থেকে থাকে আমরা আবার দুইজনের জন্য জন্মাবো।"
সুলতা স্বামীর কথা শুনে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, ওর মুখ সুখের দীপ্তিতে উজ্জ্বল। স্বামীর মুখে খুশী তার দৃষ্টি এড়ালো না, অনুভব করলো এ কথাগুলো স্বামীর মুখের না মনের কথা।
সুলতা কি বলতে গেল, রঞ্জন সুলতার মুখে হাত দিয়ে বললো "ওই দেখো সূর্য তার স্ত্রীর কাছে দিনশেষে ফিরে যাচ্ছে, ওর খুশী উজ্জ্বল মুখটা দেখো, কোনো কথা বলোনা। " সুলতা স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করে সূর্যের দিকে তাকালো। গোধূলির কনে দেখা আলোকে স্বামীকে যেন নতুন করে চিনলো।
ওদের অলক্ষ্যে কত যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীরা দুই প্রৌঢ় প্রৌঢ়ার চিরযৌবন ভালোবাসা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলো।