#চলকে পড়া প্রেম
#চলকে পড়া প্রেম
ছোটগল্প
কলমে: বুলা বিশ্বাস
বিষয়: প্রেম
শিরোনাম:
#চলকে পড়া প্রেম
-----------------------
অঝোর বারিধারায়, বর্ষাতি জড়িয়ে, উজানের ঘরে টুক করে ঢুকে পড়লো, চিন্ময়ী। উজানইতো ওকে ডেকেছিলেন।
বাউণ্ডুলে উজান চিন্ময়ীদের ভাড়াটে। তবে উনি যে বাড়িতে থাকেন, সেটা ওর শ্বশুরেরই আর একটা বাডি, যেখানে শুধু ভাড়াটেরাই থাকেন। চিন্ময়ীদের বাড়িটার থেকে এই বাড়িটা দু'মিনিট হাঁটা পথ। রাস্তার এপার আর ওপার।
ভাড়াটেরা যখন চিন্ময়ীর শ্বশুরকে ভাড়া দিতে আসেন, তখন কখনও যদি রবিশঙ্করবাবু না থাকেন, রমলাদেবীর মত প্রায় সব ভাড়াটেই চিন্ময়ীকে বলেন, 'বৌমা, তুমি ভাড়াটা নিয়ে রাখো। তোমার শ্বশুর আসলে দিয়ে দিও'খন। দরজা খুলে তাই অনেক সময়, চিন্ময়ীকে ভাড়াটেদের ভাড়া নিতে হয়। সেই সূত্রেই উজানবাবুর সাথে চিন্ময়ীর আলাপ।
উজানকে সবাই মাস্টারমশাই বলেন। উনি সক্রিয় রাজনীতি করেন। চাকরিবাকরি করেন না। ছাত্র পড়ান। দুঃস্থ ছাত্রদের থেকে টাকা পয়সা নেন না। সংসার করেন নি। কোনোদিন রান্না করেনতো, কোনোদিন করেন না। উজান আবার চিন্ময়ীর স্বামী পলাশের বন্ধু। পলাশ চাকরিবাকরি করে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু উজান ইচ্ছে করেই সে পথে পা দেন নি। নিঃস্বার্থভাবে পার্টির কাজ কর্ম করেন। এই করোনা চলাকালীনই বহু অসহায় লোকের জন্য করেছেন। বাড়িতে থাকতে খুব একটা ভালো লাগে না। ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালো লাগে। ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়েন, সাথে কাজ থাকলে তা সেরে নেন।
চিন্ময়ীর অবস্থাটা উনি বোঝেন। পলাশ আর ওর বাবা চিন্ময়ীর উপর মাঝেমাঝেই মানসিক নির্যাতন করে। কখনও আবার বাবার প্ররোচনায়, পলাশ চিন্ময়ীর গায় হাত দেয়। অনেক সময় ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় উজান চিন্ময়ীকে মারধোরের আওয়াজ পেয়েছেন। এমনকি চিন্ময়ীর কান্নাও শুনেছেন। উজানের খুব খারাপ লাগে। প্রতিবাদ করার জন্য মুখটা নিশপিশ করে ওঠে, কিন্তু পারেন না।
চিন্ময়ীর দোষ হলো, ও খুব ভালো লেখিকা। কমার্স গ্র্যাজুয়েট হয়ে ও যেভাবে সাহিত্যচর্চা করে, যেভাবে প্রকাশকেরা, সম্পাদকেরা ওর লেখার প্রশংসা করেন, যেভাবে ও বিভিন্ন জায়গা থেকে সাম্মানিক পায়, পলাশ তা সহ্য করতে পারে না। সবাই যখন ওকে ডেকে বলে, তোমার স্ত্রী, সত্যই গুণবতী। ওর লেখা আমাদের মুগ্ধ করে। এটা উজানও বলে। পলাশ হীনমন্যতায় ভোগে। চিন্ময়ীকে এসব বন্ধ করতে বলে। চিন্ময়ী তা অস্বীকার করলে, ওকে ওরা অত্যাচার করে।
উজানও লেখালেখি করে। চিন্ময়ীর লেখার প্রশংসা করে উজান যখন চিন্ময়ীকে, আরো আরো ভালো কিছু লেখার জন্য উস্কাতে থাকে, চিন্ময়ীর উজানের এই মহান মনটাকে ভালো লেগে যায়। ও বলে, 'মাস্টারমশাই, আপনার কি মজা। যখন যেখানে মনে হয়, বেরিয়ে পড়তে পারেন। আমারও খুব ইচ্ছে হয়,আপনার মত বেরিয়ে পড়ি।'
উজান বলেন, 'যাবে আমার সাথে?'
চিন্ময়ী খিলখিল করে হেসে ওঠে।
উজান বলে, হাসলে যে খুব! দেখবে একদিন আমার পঙ্খীরাজ করে তোমায় তুলে নিয়ে যাবো!'
চিন্ময়ী আরো হাসে, আর মনে মনে বলে, 'উজানবাবু, আমিওতো তাই চাই। নেবেন আমাকে? বাড়িতে আমার যে বড় দম বন্ধ হয়ে আসে!'
সেদিন চিন্ময়ী ঘরে চুপ করে বসে ছিল। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। পলাশ অফিসের কাজে একদিনের জন্য বর্ধমানে গেছে। চিন্ময়ীর উজানের সাথে বড় কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো ও উজানকে ফোন করছে, কিন্তু উজান কিছুতেই ফোন ধরছে না। চিন্ময়ী ভাবে হয়তো ওর পার্টির কোনো মিটিং চলছে। চিন্ময়ী আর ফোন করে না।
রাত তখন আটটা। উজান চিন্ময়ীকে ফোন করে। বলে,'ফোন করেছিলে কেন?'
চিন্ময়ী বলে, 'বড্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো যে!'
উজান বলে, 'একবার আসতে পারবে?'
চিন্ময়ী আবার হাসে। বলে, 'এই বৃষ্টিতে?'
মনে মনে ভেবে নেয়, এভাবে বেরোনোতে অনেক বিপদ হতে পারে। চিন্ময়ী বর্ষাতি পড়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে। বিপদেইতো ও পড়তে চায়! ওতো মুখ ফুটে বলতে পারে না, 'উজান, আমি তোমায় ভালোবাসি।'
ও ঘরে ঢুকতেই, উজান চমকে ওঠে। উজান দূরে সরে বসে।
চিন্ময়ীর সাথে ভাড়া দিতে যাওয়া আর একপাড়ায় থাকা এইভাবেই আলাপ। চিন্ময়ী টিফিনকৌটো করে একটু খাবার এনেছিল, উজানের জন্য। 'এই নিন। শাশুড়ি এটা আপনার জন্য পাঠালেন!' বলে মুচকি হাসলো।
উজান সবই বুঝলো। বললো, 'গতকাল, কী হয়েছিল? আবার ঝামেলা করেছে ওরা?'
চিন্ময়ী জানলাটার কাছে সরে দাঁড়িয়ে, চোখের জলটা মুছে নিয়ে বললো, 'ছাড়ুনতো ওসব কথা। ও হতেই থাকে, উজানবাবু।'
'আবার 'বাবু' কেন? 'উজান' হতে পারে না? শোনো এবার তুমি তোমার বাপের বাড়ির লোককে সব জানাও। এভাবে সহ্য করলে পিছিয়ে পড়বে।'
'কাল আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
'কাল একটু এন আর এসে যেতে হবে। একজনের জন্য ব্লাডের ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদিন ওখানেই কাটবে।'
'আমাকে নেবেন আপনার সাথে?'
'শোনো চিন্ময়ী, আগে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও। কখন দেখবে, তুমি আমার কাছে চলে এসেছো। আমার মত কাজ করছো।'
চিন্ময়ী বলে,'ধ্যুর, আপনার সাথে আর কথা বলবো না।' বলে একছুটে উজানের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
জানলা দিয়ে উজান ওর ফিরে যাওয়া দেখতে থাকে। আর মনে মনে ভাবে, 'আমার সাথে তোমার জীবনটাকে জুড়তে যেও না। তুমি শিল্পী, তুমি স্রষ্টা। তোমার স্থান, আমার থেকে অনেক উঁচুতে।'
--------------
কলমে: বুলা বিশ্বাস
ফোন নাম্বার: 7980205916
মেল আইডি:
bulabiswas60@gmail.com