Debdutta Banerjee

Drama

3  

Debdutta Banerjee

Drama

এক অন্য রকম রূপকথা(প্রথম পর্ব)

এক অন্য রকম রূপকথা(প্রথম পর্ব)

6 mins
16.8K


ট্রেনটা মাত্র একমিনিটের জন্য থেমেছিল এই অজ পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট ষ্টেশনটায়। তিন্নি তাড়াতাড়ি নিজের ছোট সাইড ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়তেই বিশাল সরীসৃপের মতো এঁকেবেকে ডিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে গেল পরবর্তী গন্তব্যে। তিন্নি ভালভাবে ষ্টেশনের এ মাথা ও মাথা তাকিয়ে দেখল সে ছাড়া আর এক আদিবাসী দম্পতি আর এক বৃদ্ধ নেমেছে। এ যেন এক রূপকথার দেশ। চারদিক সবুজ। ও পাশের ঝাঁকড়া শিমুল গাছটার কাছে একটা হাতল ভাঙ্গা বেঞ্চ, সেদিকে এগিয়ে গেলো তিন্নি। ব্যাগটা রেখে মা কে একটা ফোন করে দিল প্রথমেই। এ বার কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে আরেকবার পড়লো। 

ততক্ষণে ষ্টেশন ফাঁকা, কোনো স্টল বা রেলের লোক-ও চোখে পড়লনা। বাইরে বেরিয়ে এসে তিন্নি দেখল একটা জারুল গাছের নিচে দুটো টুকটুক আর একটা ভাঙ্গাচোরা রিক্সা দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে তিনজনেই চাতক পাখির মতো চেয়ে রয়েছে। ও বৃদ্ধ রিক্সা ওয়ালাকেই বলল -" চ‍্যাটার্জী প্যালেস যাবে?"

বৃদ্ধ ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বলল -"বসুন। "

ও উঠে বসতেই বৃদ্ধ প্যাডেলে চাপ দিল। বলল -" আপনি কার কাছে যাবেন ও বাড়ির? ছোট দিদিমণির কাছে ? নাকি বড়মার কাছে এসেছেন?"

-" তুমি ও বাড়ির সবাইকে চেন বুঝি?" তিন্নি কৌশলে ওর থেকে কিছু জানতে চাইছিল।

-" ঐ তো চারজন বাসিন্দা, অবশ্য এককালে বড় চাটুজ্যের ডাকে বাঘে গরুতে এক-ঘাটে জল খেত। আজ আর সে সব দিনকাল নেই। বড়বাবু শয্যাশায়ী, বড়মা ঠাকুর ঘরেই থাকেন শুনেছি। ছোট বাবু তো বহুদিন আগেই পাপের শাস্তি ভোগ করতে চলে গেছেন ও পারে। বৌটা মেয়েটাকে নি়য়ে পড়ে রয়েছে। সে কোনো সাতে পাঁচে নেই। মেয়েটা হয়েছে এ বাড়ির উপযুক্ত, যেমন বাপ তেমন মেয়ে।" বলেই জিব কাটল বৃদ্ধ। বলল -" আপনারে কি বলতে কি বললাম। ওদের বলবেন না। আমি গরীব খেটে খাওয়া মানুষ। "

-" আরে না না, আমি দু- দিনের অতিথি, কাল সকালেই চলে যাবো। আমি কিছুই বলবো না । তুমি বলো। কি বলছিলে যেন?"

তিন্নির অভয় বাণীতে বৃদ্ধ ভরসা পেয়ে বলে " আসলে ছোটবাবু তো মানুষ ছিল না। বড় লোকের বিগড়ানো ছেলে, মদ্যপান আর জুয়া খেলা, কুসঙ্গে পরে চলেই গেল। আর সেই শোকে বিছানা নিলো বড়বাবু। মেয়েটা কারো শাসন পায়নি বলে বখে গেছে। এখন চাটুজ্যেদের নাম যশ আর টাকা সব ধুলায় লুটাচ্ছে।"

সকালের রোদে তেমন তেজ নেই। আসে পাশে প্রচুর সবুজ গাছ আর ডোবা, পুকুর। একটা বড় বাঁশ ঝাড় পার করে আম বাগানের মেঠো পথে চলছে রিক্সা। তিন্নির ভালোই লাগছিল। দুরে একটা বহুদিন-কার পুরানো রঙ চটা , জায়গায় জায়গায় ইঁট বের করা বিশাল বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বট অশথ্থর চারা গজিয়েছে।সামনের বড় সিংহ-দরজার মাথায় একটা মুখ ভাঙ্গা জন্তুর আদল। অন‍্যদিকটা ভেঙ্গে পড়েছে। লোহার দরজার একটা সাইড অবশিষ্ট। তাই আর খোলা বন্ধের ব্যাপার নেই। মোরাম বিছানো পথে শুকনো পাতার আলপনা, দু ধারে এককালে সৌখীন বাগান ছিল তার চিহ্ন। কোথাও ভাঙ্গা ফোয়ারা, ওধারে ডানা ভাঙ্গা পরী। এই কি সেই রূপকথার বাগান! জঙ্গলের মধ্যে অযত্নে কয়েকটা লাল গোলাপ ফুটে রয়েছে। আপন মনে কিছু বাগানবাহার ফুটেছে। শ্যাওলা পড়া বাঁধানো ছোট্ট জলাশয়ে কয়েকটা শাপলা। আরো নানারকম ফলের গাছ অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালের সাক্ষির মতো। 

গাড়ি বারান্দার মাথায় মাধবীলতার ঝাড়। রিক্সা গিয়ে দাঁড়াতেই তিন্নি নেমে পড়লো। একটা একশো টাকার নোট রিক্সাওয়ালাকে দিতেই সে বলল খুচরো নেই। তিন্নি বলল -"এটা আমি তোমায় দিলাম। ফেরত চাই নি।"

-" তা হয় না দিদিমণি, আমার ভাড়া চল্লিশ টাকা, আমি তাই নেবো। "

অগত্যা তিন্নি দুটো কুড়ি টাকার নোট দিয়ে একশোটা ফেরত নিলো।

সামনের বড় কাঠের কারুকার্য করা দরজা হা করে খোলা। কিন্তু কোনো লোক চোখে পড়ল না তিন্নির। এ ভাবে কারো বাড়ি ঢোকেনি কখনো, তাই ভাবছিল কি করবে। কোনো বেল্ কোথাও চোখে পড়লো না ।

এমন সময় এক মাঝবয়সী লোক বেরিয়ে এলো ওধার থেকে, চোখে প্রশ্ন। তিন্নি নিজেই হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে পরিচয় দিলো নিজের। লোকটা একটু অবাক হয়েছে মনে হলো। ওকে বৈঠকখানায় বসিয়ে ভেতরে চলে গেল একাই। তিন্নি চারপাশটা ঘুরে দেখছিল । নানা রকম পুরানো শো-পিস আর ছবি দিয়ে সাজানো বিশাল বৈঠক খানা, চার জোড়া সোফা ছাড়াও ডিভান, চেয়ার সব রয়েছে। শুধু বেশ পুরানো বোঝা যায়। এ যে ছোটখাটো এক রূপকথার রাজবাড়ি, মা ভুল বলেনি কিছুই। একপাশে বংশের সবার তৈলচিত্র। সেসব দেখতে দেখতেই পিছনে এক বৃদ্ধার গলা -" অবশেষে তুমি এলে, তাও একা। রমা এলো না?"

তিন্নি ঘুরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাকে দেখছিল, একসময় অসামান্য রূপসী ছিলেন, বয়স থাবা বসালেও রূপের ছটা ম্লান হয় নি এতটুকু। তিন্নি একটু ইতস্তত করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই বৃদ্ধা বুকে টেনে নিলেন। বললেন -" এভাবে তোমাকে দেখবো কখনো ভাবি নি। আসলে ......"

কান্নায় ওনার গলা বুজে এসেছিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন ,-" আমার সাথে এসো। ভিতরের বারান্দার পরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আবার একটা হল। ওধারে প্যাসেজের দু পাশে মোট চারটা ঘর। অন‍্যদিকেও মনে হয় তাই। উঁচু ছাদ, সুদৃশ্য ঝাড় লন্ঠন ঝুলছে। তিন্নি দেখেই যাচ্ছে শুধু। শেষের ঘরটায় ওকে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধা বললেন-" এটা তোমার ঘর। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও, পরে কথা হবে। কিছু দরকার হলে এই বেলটা বাজাবে। কেউ এসে যাবে। আর আমায় সবাই বড় মা বলে, তুমিও তাই ডেকো। " 

উনি চলে যেতেই তিন্নি দেখল একজন কাজের লোক ওর ব্যাগটা দিয়ে গেল। আর এক মহিলা এক-গ্লাস সরবত রেখে গেল। 

ওরা চলে যেতেই তিন্নি বড় জানালাটার ধারে এসে দাঁড়ালো। সামনে সেই বাগান , গেট পার করে আম বাগান। ওধারে আরো কিছু বাড়ি রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এ পাশের জানালা দিয়ে এক বিশাল পুকুর চোখে পড়লো। ঠিক রূপকথার গল্পের মতো, মা এর কাছে শোনা গল্পটা এ ভাবে সত্যি হবে কখনো ভাবে নি। খুব ইচ্ছা ছিল এ বাড়ি দেখার। আজ সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। 

ও ফ্যানটা চালিয়ে বিছানায় বসতেই একটা গাড়ির আওয়াজ পেলো। একটা সুইফট ডিজায়ার গড়ি বারান্দায় দাঁড়াতেই একটা কুড়ি একুশের যুবতীকে নামতে দেখল ও। ড্রাইভিং সিট থেকে এক যুবক নেমে এলো। দুজনেই ঢুকে গেলো বাড়িতে। 

তিন্নি অল্প দাঁড়িয়ে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। একটু পরেই স্নান করে ফ্রেশ হয়ে ও বাইরে এলো। এক পরিচারিকা ওকে দেখতে পেয়ে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। বিশাল পালঙ্কে এক বৃদ্ধ শুয়ে। বড়মা বসা পায়ের কাছে, ওকে দেখে বললেন -" এসো মা, এই তোমার দাদু, উনিই তোমায় ডেকেছেন।"

তিন্নি দেখল মার কাছে একদিন যার গল্প শুনেছে সেই প্রতাপ নারায়ণ চ‍্যাটার্জী আজ বয়সের ভারে বিছানায়। যে দাদু একদিন তাকে দেখতে যাননি সে মেয়ে বলে, আজ ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছেন অসহায় ভাবে।হাত জোড় করে তিন্নি বলল -" মা বলেছেন কেউ শুয়ে থাকলে প্রণাম করতে নেই।"

বৃদ্ধ জড়ানো গলায় বললেন,-" কোমরের নিচ থেকে শরীরটা অসার। বাঁ হাতটায়-ও জোর নেই মা। তুমি আমার কাছে এসে বসো। " তিন্নি ওনার কাছে এগিয়ে গেলেও বসলো না। 

-" বৌমা এলো না?" বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তরে তিন্নি বলল, -" মা জানে না আমি এখানে এসেছি। মা কে বলিনি। "

-" কেন? চিঠি তো আমি বৌমাকেই দিয়েছিলাম।"

-" মা ছিল না সেদিন। চিঠিটা আমার হাতে পড়ায় এবং আপনার নাম দেখে কৌতূহলবশে সে চিঠি আমি খুলে পড়ি এবং নিজের ইচ্ছায় এখানে আসি। মা জানলে আসতে দিতেন না হয়তো।" 

বৃদ্ধ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন -" কেন তোমায় ডেকেছি তুমি জানো ?" 

-" না, জানি না। তবে জানতে চাই। যে নাতনির মুখ গত চব্বিশ বছরে একবার-ও দেখেননি তাকে আজ জরুরী তলব কেন?"

-" বলবো, খেয়ে এখন বিশ্রাম করো, বিকেলে কথা হবে।" বৃদ্ধ চোখ বুজলেন।

বড়মার সাথে ওধারে খাওয়ার ঘরে গেল তিন্নি। এক মহিলা ওকে দেখে চলে গেল ওখান থেকে। বড়মা বললেন, -"ও এ বাড়ির ছোট বৌ।"

 অনেক পদের মধ্যে তিন্নি শুধু একটু ডাল, ভাত আর একটা তরকারী খেলো। মা্‌ছ, মাংসে হাত দিলো না। মুখে বলল সে শনিবার নিরামিষ খায়।

একটু পরেই দুমদাম করে সেই মেয়েটি সেই যুবক কে নিয়ে ওখানে এলো। বৃদ্ধা বললেন -" এ দিয়া, আমার ছোট নাতনী।আর দিয়া এ তোমার দিদি সাঁজবাতি, ডাকনাম তিন্নি।"(চলবে)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama