moniva sadhu

Children

3  

moniva sadhu

Children

ঝিল্লির দুপুর

ঝিল্লির দুপুর

6 mins
813


--- ঠাম্মির কথা শুনবে,ঠাম্মিকে একদম বিরক্ত করবে না,দুপুরে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ভাত খেয়ে নেবে।ঠিক আছে? এখন চটপট হাঁ করে খেয়ে নাও,উ:আটটা বেজে গেলো,আমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোতে হবে।এখনো স্কুলবাস এলোনা কেন? আর সন্দীপটাও হয়েছে তেমনি,একটু যদি উঠে হেল্প করে!! নিজের অফিস তো বেলা দশটায়," তন্দ্রা ঝিল্লির মুখে গোবিন্দভোগ চালের ভাত আলুভাত আর ডিমসেদ্ধর সাথে দলা করে খাওয়াতে খাওয়াতে বকে যাচ্ছিল।শাশুড়ি সুপ্রভা রান্নাঘরে,কাজের মেয়ে বেলার সাহায্যে রান্নায় ব্যস্ত,ছেলে-বৌমা দুজনেই খানিক পরে খেয়ে অফিস যাবে।সকালটা চূড়ান্ত ব্যস্ততায় কাটে।

  তন্দ্রা ঝিল্লিকে খাইয়ে ওর ব্যাগে টিফিনবক্স,জলের বোতল পুরে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে শাড়ি পালটাতে যায়,চটপট চেঞ্জ করে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ে,"বেলাদি,যা হয়েছে দিয়ে দাও।" বেলা তাড়াতাড়ি ভাতের থালা সাজিয়ে দিয়ে যায়,এইবার সন্দীপ হাই তুলতে তুলতে শোবারঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।ঝিল্লির স্কুলবাস হর্ণ মারে।সন্দীপ মেয়েকে বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়ে।বাস চোখের আড়াল হতেই সন্দীপ তন্দ্রার সাথে দরকারি কথা সেরে বাথরুমে ঢোকে।

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে "মা,আমি বেড়োচ্ছি"বলেই তন্দ্রা পায়ে চটি গলিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ির গেট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।এখান থেকে গাড়িতে তার অফিস প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ,বেসরকারি অফিস,বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা,নটা বেজেই যায়।সন্দীপ ব্যাঙ্ক কর্মচারী, তার ব্যাঙ্ক বাড়ির কাছেই।কিন্তু হলে কি হবে,বাড়ি ফিরেই তার পাড়ার ক্লাবে তাসের আড্ডায় যাওয়া চাই।এইনিয়ে বাড়িতে কম অশান্তি হয়েছে? কিচ্ছু লাভ হয়নি।

মুশকিল হয়েছে ঝিল্লির,তার স্কুল বেলা এগারোটায় ছুটি হয়ে যায়,চারবছরের ঝিল্লি পড়ে আপার নার্সারিতে। একমাথা চুলে ফর্সা,গোলগাল পুতুল পুতুল চেহারার ঝিল্লির দুপুর আর কাটতে চায়না। ঝিল্লি স্কুল থেকে ফেরার আগেই বেলা ঘরদোর পরিষ্কার করে, বাসনমেজে চলে যায়।ঝিল্লি ঠাম্মির কাছেই স্নান করে নেয়।তারপর পাশে বসে গল্প বলতে বলতে ঝিল্লিকে খাইয়ে সুপ্রভা নিজেও খেয়ে নেয়, বাকি খাবার ফ্রিজে তুলে সুপ্রভা নাতনিকে নিয়ে নিজের শয্যায় আশ্রয় নেয়,বয়েস হচ্ছে,সাতসকালে উঠতে হয় বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে।ঝিল্লির ঘুম আসেনা,বিছানায় খানিক এপাশওপাশ করে উঠে পড়ে।কখনো নিজের ড্রইংখাতা আর রঙপেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে,কখনো বা জানলার গরাদ ধরে বাগানের পাখি,কাঠবেড়ালি আর দুষ্টু মিনিবেড়ালের কাণ্ডকারখানা দেখে।

সবচেয়ে বিরক্তি লাগে স্কুলে ছুটি পড়লে,সারাদিন সময় আর কাটেনা।,মা-বাবার তো যখনতখন অফিস ছুটি হয়না,তবু তারমধ্যেই ঝিল্লির জন্যই ছুটি নিয়ে সবাই মিলে কাছেপিঠে এদিকসেদিক বেড়িয়ে আসে।মাঝেমাঝে ঠাম্মি যেতে না চাইলে মা বাবা ঝিল্লিকে নিয়েই বেড়িয়ে পড়ে,ভোরে বেড়িয়ে রাতেই ফিরে আসে।

তখন গরমের ছুটি চলছে,বেশ গরম পড়েছে,বেলাদির কাজও বেড়েছে।নিয়মকরে বাগানে মাটির ভাঁড়ে জল ভরে রাখতে হয় পাখিদের জন্য।সেদিন সুপ্রভা ঘুমিয়ে পড়তেই ঝিল্লি জানলার ধারে চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে বই খুলে বসে আছে আর ভাবছে মা-বাবা দুজনের চাকরি করার কি দরকার ছিল। একজন তো বাড়িতে থাকতেই পারে।কতবার মাকে বলেওছে।মা-বাবা দুজনেরই এককথা,"তুই তো এখন ছোট্টমেয়ে, বুঝবি না,একজনের রোজগারে ভালোভাবে থাকা যায়না।এইযে ঝিল্লিসোনাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া,পূজোয় দামি ড্রেস কিনে দেওয়া,জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি দেওয়া,শরীর খারাপ হলে ভালো ডাক্তার দেখানো, ভালো স্কুলে পড়াশুনো করা সবের জন্যই অনেক টাকাকড়ি লাগে।একজনের চাকরিতে সেটা হয়না।"

--বেশ,আমি নাহয় জন্মদিন,জামা,বেড়ানোর জন্য আবদার করবোনা।তাহলে? ঝিল্লি মায়ের মুখের দিকে তাকায়।

---- তা হয়না।লেখাপড়া শিখে আজকাল কেউ ঘরে বসে থাকেনা।বড় হও নিজেও বুঝবে।তন্দ্রা মেয়েকে বলে।

--- আগে তো ছোট থেকে বড় হই তখন নাহয় বড়বেলার কথা ভাববো।সারাদিন একা ঘরে আমার ভাল্লাগে না।

--- বেশ তোমায় অনেক গেমস এনে দেবো আর এবারে গানের স্কুলে ভর্তি করে দেবো।প্রতি রবিবার আমিই নিয়ে যাবো "বৈতালিক"এ।দেখবে,কতো ছেলেমেয়ে কি সুন্দর গান গাইছে।

সেও দেখতে দেখতে বেশ কয়েকমাস হয়ে গেলো,এখন ঝিল্লি "আগুনের পরশমণি "রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে।

বিকেলে হারমোনিয়াম নিয়ে এঘরে বসেই প্রাকটিস করে।এটাই ঝিল্লির পড়ার ঘর,দোতলায় কেউ থাকেনা বলে ঠাম্মির পাশের ঘরেই এই ব্যবস্থা।আজকে জানলার ধারে বসতেই দেখে একটা কোকিল এসে জলভর্তি বড় মাটির পাত্রে চুবে বসে আছে।একদল ছাতারে পাখি ক্যাচোরম্যাচোর করে সেখানে আসতেই কোকিল জল থেকে উড়ে বাগানের আমগাছের ডালে গিয়ে বসলো।এরমধ্যেই আমগাছে ছোটছোট আম ধরেছে।

--- আর একটু বেশিকরে জলভর্তি ভাঁড় রাখতে পারেনা? নিজেরা তো এসি চালিয়ে ঠান্ডাঘরে দিব্যি আছে-- মরছি আমরা,এক তো সারাদিন এইদুটো পাখা নেড়ে নেড়ে উড়ে উড়ে নিজেদের খাবার জোগাড় করো,তারপর কুকুর-বেড়ালের নজর এড়িয়ে থাকো,তারমধ্যে এই অসহ্য গরমে জলের জন্য এবাড়ি- ওবাড়ি ঘুরে বেড়াও।

ঝিল্লি অবাক!! ছাতারেগুলোর কথা সে যে সব বুঝতে পারছে।

--- আমাদের বাচ্ছারা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই উড়তে শিখে যায়,আর এদের মেয়েকে দ্যাখ,একদম আতুপাতু করে রেখে দিয়েছে!কেন রে বাবা,নিজের কাজগুলো নিজে করলে ক্ষতি কি?ব্রাশ করিয়ে দিচ্ছে,খাইয়ে দিচ্ছে, স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে,জামা পড়িয়ে দিচ্ছে,ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে--- বাপরে বাপ!! আমাদের বাছারা কেমন নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করছে।এক ছাতারে আরেকজনকে বলে।

ছাতারেদের স্নান হয়ে গেলে পেয়ারাগাছের ডালে বসে একে অপরের ডানা ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে পাশাপাশি জড়াজড়ি করে এ ওর ঘাড়ে আদরে মাখামাখি হয়ে বসে থাকে,ততক্ষণে কোত্থেকে তিনটে শালিক এসে চোরের মতো অন্য এক জলভরতি পাত্রে স্নান করতে এসেছে।ওমা!! সঙ্গেসঙ্গে দুটো ছাতারে ঠোঁট উঁচিয়ে ঝগড়া করে শালিকদের তাড়াতে নিচে নেমে এলো।

বেচারি শালিক! স্নান না করেই দূরে সরে গেলো,অপেক্ষায় থাকলো কখন সুযোগ পায়।কয়েকটা কাঠবিড়ালি আমগাছ থেকে নিচে নেমে এলো,অকারণ কি ছুটোছুটিই না করে,বেশ কয়েকখানা পাকা পেয়ারা গাছের তলায় পড়ে আছে,টুক করে তুলে নিয়েই বসে বসেই কুটুরমুটুর করে কামড়ে খেতে শুরু করে দিলো।একজন আবার গাছে উঠে ডাল থেকে পেয়ারা নিয়ে খেতে লাগলো,বোধহয় ওর টাটকা ফল খাওয়ার অভ্যেস।

---- এবাড়িতে গাছে এতো ফল হয় অথচ বাড়ির মেয়ের মুখেই রোচেনা,শুধু চিকেন,প্যাটিস,বার্গার,বিরিয়ানি এসবেই লোলা সকসক করে।বইয়ে পড়ছে শরীরের জন্য ফল খেতে হয়,কিন্তু খায় ঐ মুখরোচক খাবার।এমনিই তো গোলগাল দেখতে,এরপর দেখবি ফুলে ঢোল হবে।খেলাধুলোও তো করেনা।আমাদের তো ছুটোছুটিতেই খাবার হজম হয়ে যায়।ওরে ঝিল্লি,কবে ফল গিল্লি? বলেই কাঠবেড়ালিদের ফ্যাচফ্যাচ করে কি।হাসি।তাদের সাথে ছাতারেপাখিরাও যোগ দিয়েছে।এইফাঁকে শালিকপাখিরা বেশকরে স্নান সেরে উড়ে পালিয়েছে।কোকিলের ডানা শুকিয়ে গিয়েছে,সামান্য পেয়ারা খেয়ে মনের সুখে কুহু কুহু করে গান ধরেছে।

দাঁড়কাক গম্ভীরস্বরে বলে উঠলো,"এই এক ন্যাকাপাখি জন্মেছে,কাজ নেই কম্ম নেই,আমাদের বাসায় ডিম পাড়ছে আর শুধু শিস দিয়ে বেড়াচ্ছে।আর আমরা সারাবছর ধরে নোংরা পরিষ্কার করে মরছি।লজ্জাও নেই,কি বেহায়া পাখি রে বাবা!"

কোকিল শিস দেওয়া থামিয়ে বলে,"ঐ হেঁড়েগলায় গানের কি মর্ম বুঝবি? আহা!এইকদিনে ঐ মেয়েটা কেমন সুন্দর হারমোনিয়াম বাজিয়ে "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"গায়।প্রতিভোরে আমি শুনি কিন্তু সুরটা কিছুতেই ঠিককরে তুলতে পারছিনা।"

ঝিল্লির এতোক্ষণে নিজের প্রশংসা শুনে মুখে একটু হাসি ফোটে।যাক বাবা!অন্ততপক্ষে কোকিল তো তার দলে আছে।কোকিলের কথায় ছাতারেরা তাকে এই মারে তো সেই মারে!

--- নিজেও যেমন,ঐ মেয়েও তেমন।এই গরমে আমাদের প্রাণ যায়যায় আর কি গান গাইছে? আগুনের পরশমণি --- তা বাইরে বেড়িয়ে দেখ সুয্যির কেমন তাপ!! ঠান্ডাঘরে বসে ওমন গান সবাই গাইতে পারে।

ঝিল্লির দুচোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে,সে কি করবে? গানের দিদিমণি যদি এই গানটাই শেখায়?ঠিক আছে, সামনের রবিবার নাহয় দিদিমণিকে অন্যগান শেখাতে বলবে।ঝিল্লি কিকরে জানবে তার গান মা-বাবা-ঠাম্মি ছাড়াও পাখিরাও মন দিয়ে শোনে?

---- এবারে বাসায় যাই,একটু বিশ্রাম না নিলে আবার কাল ভোরে উঠতে দেরি হয়ে যাবে।

মেনিবেড়ালটা কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল,আচমকা ফ্যাঁস করে আমগাছে উঠতেই কাঠবেড়ালিরা দুদ্দার করে পালালো।ছাতারে পাখিরাও উড়ে গেলো,যাওয়ার আগে কোকিলের দিকে ঠোঁট বেঁকিয়ে গেলো।মেনিবেড়াল গাছ থেকে নামতেই কাক তার গায়ে হাগু করে উড়ে গেলো।একা কোকিল তখনো বসেবসে একমনে গান গেয়েই যাচ্ছে।

--- আমি এবারে নিজে থেকেই গান প্রাকটিস করবো।কোকিল,তুই ঠিক সুর তুলে নিতে পারবি।

--- ও ঝিল্লিসোনা,টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি বিড়বিড় করছিস? বিছানা থেকে উঠে এখানে কখন শুলি?

আমার তো শুলেই চোখ লেগে যায়।ঝিল্লিকে কোলে করে তুলে নিয়ে সুপ্রভা বিছানায় শুইয়ে দেয়।সন্দীপের আসার সময় হলো।বেলা এসে দুপুরের এঁটোমাখা কয়েকখানা বাসন মেজে টুকিটাকি আনাজপাতি কেটেকুটে দিয়ে বাগানের গাছে জল দিয়ে গাছের নিচে পড়ে থাকা পেয়ারা,আম কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে।সন্দীপ এসে জলখাবার খেয়ে ক্লাবে চলে গিয়েছে।সুপ্রভা ঝিল্লিকে ডাকে,"এবারে ওঠ,মুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়ে একটু হারমোনিয়াম নিয়ে,বসতে হবে যে।" 

ঝিল্লি ধড়ফড় করে উঠে পড়ে, বিছানা থেকে নেমে চোখেমুখে জল দিয়ে বলে,"ও ঠাম্মি,হারমোনিয়ামটা খাটের তলা থেকে একটু বের করে দাওনা।"

--- আগে কি খাবে বলো?ম্যাগি না প্যাটিস?

-- ওসব খাবোনা,তুমি বরং একগ্লাস দুধ আর বিস্কুট দাও।

সুপ্রভা তো অবাক,ঝিল্লিকে দুধ খাওয়ানো নিয়ে রীতিমতো মারধোর করতে হয়।আর সেই মেয়ে কিনা নিজে থেকে দুধ খেতে চাইছে! যাকগে,দুধ তো জ্বাল দেওয়াই থাকে,রাতে সুপ্রভা নিজেও দুধ রুটি খায়।

ঝিল্লি শতরঞ্চি পেতে জানলার দিকে মুখ করে গান গাইতে শুরু করলো।

তারপর থেকে বাড়ির সবাইকে অবাক করে ঝিল্লি নিজের কাজ একটু একটু করে নিজেই করতে শিখে গেলো।

যখন আশেপাশে কেউ থাকেনা তখন জানলার ধারে এসে নিজের মনে বলে,"আমিও সব পারি।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Children