দেবদত্ত চট্টরাজ

Horror Thriller

4.0  

দেবদত্ত চট্টরাজ

Horror Thriller

মন্দের দেবী

মন্দের দেবী

71 mins
673



[পাঠকদের প্রতি: এই ধারাবাহিক এক উপজাতি গোষ্ঠী ও দেবীকে নিয়ে যা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। সেইজন্য এই গল্পের কোনরূপ চরিত্র,স্থান, কাল,পাত্র ইত্যাদির সাথে বাস্তবের কোনও মিল থাকলে তা হবে সম্পূর্ণরূপে কাকতালীয়।আমার কারুর ভাবাবেগ আঘাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।তাই আনন্দের সাথে সহজভাবে এই গল্পটি নেবেন বলে পাঠক/পাঠিকাদের কাছে আশা রাখি।]


{লোকগল্পে বারংবার উঠে আসে দুটি জিনিস, শুভ-অশুভ এবং অনন্তকাল ব্যাপী তাদের দ্বন্দ্ব। মানবসমাজ এই অশুভ শক্তি হতে পরিত্রান হেতু শুভ শক্তির সাধনায় লিপ্ত থেকেছে যুগ যুগান্ত ব্যাপী। শুধুমাত্র পরিত্রাণের কথা ভেবে। তবে সৃষ্টির এই পরিচালিত গণ্ডির বাইরেও রয়ে গেছে কিছু গোপন কথা। কিছু উপাস্য, যারা মঙ্গলদায়ী নয়। যাদের সাধনা হয় তাদের বক্রদৃষ্টি থেকে বাঁচার তাগিদে। গল্পের উপাস্য ঊর্ধি সেই রুপেই এক কল্পনা, যেখানে চিরন্তন এই নিয়মের বাইরে এক কঠোর প্রশ্নের মুখে সম্মুখিন করে সবাইকে আর জানতে চায় মন্দের থেকে বাঁচতে কি মন্দের উপাসনা করা সঠিক সিধান্ত হতে পারে । এই গল্প সেইরুপে বর্ণিত এক পিশাচীর গাঁথা- তার আরাধ্যা হওয়ার বাসনা যা আঘাত হানবে মানুষের মজ্জায়। এই গল্প শুভ নয় এই গল্প অশুভের- এই গল্প মন্দের। }


পর্ব ১



নমস্কার আপনারা দেখছেন জব্বর খবর,আমি আপনাদের হোস্ট সৌনক আজকে আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান "লোকচক্ষুর আড়ালের" নিরানব্বই তম এপিসোডে স্বাগত জানাই।আপনাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসার জোরে আমাদের এই অনুষ্ঠান এই বছর টেলিভিশন জগতে "সেরা ডকুমেন্টারি শো" বিভাগে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।তাই আমাদের একশো এপিসোডের আগে আজ আপনাদের জানাতে চাই আমরা একটি অনলাইন কম্পিটিশনের আয়োজন করেছি,যেখানে আপনারা আপনাদের জানা কোনও রহস্যময় এলাকার খোঁজ দেবেন যা এখনো সিংহভাগ মানুষের অজানা রয়ে গেছে।আপনাদের দেওয়া জায়গার মধ্যে লটারির মাধ্যমে আমরা খুঁজে নেব আমাদের একশো এপিসোডের গন্তব্য স্থল,আর শুধু তাই নয় সাথে যিনি আমাদের ওই জায়গার ঠিকানা দেবেন তাকে পুরস্কার দেওয়াও হবে।

তাই ঝটপট নিজের ফোন তুলে আমাদের ওয়েবসাইট www.amarjobborkhobor.com এ গিয়ে সবিস্তারে লিখে ফেলুন আপনার সেই জায়গার সন্ধান ,সাথে নিজের নাম ও ফোন নাম্বার দিতে ভুলবেন না কিন্তু।

চলুন তাহলে শুরু করি আজকের এপিসোড


আধ ঘণ্টা পর--------


সঞ্চালক- ওকে।কাট।


সৌনক হটাৎ বিষম খেলো কাট বলার সাথে সাথে খুক খুক খুক করে সে কাশতে শুরু করলো।


সঞ্চালক- কি হল রে? বিষম খেলি কি করে ।এই কে আছিস এক গ্লাস জলদে সৌনককে।


সৌনক ভয়ানক বিষম খেয়েছে কারণ কাশতে কাশতে তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে।এক গ্লাস জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে সে যেন প্রাণ ফিরে পেল।


সাদাব- কি ব্যাপার ভাই।আজ অনেক উদাস লাগছে।ঘরে কি ঝগড়া-টগড়া কর এসেছিস নাকি?


সৌনক- ধুর কি যে বলিস না।চল এখন শুটিং হয়ে গেছে, একটু বাইরে যাই।


সাদাব- তোমার আর কি ভাই।তুমি হলে গিয়ে হোস্ট,বলে দিয়ে খালাস। আর আমি হলাম ক্যামেরা ম্যান।তুমি কি কি ভুল করলে সেটা ঢাকা দিতে হবে ,তারপর তোমার ঐ হার্টথ্রব ইমেজটাও তো বজায় রাখতে হবে না কি।


সৌনক- শোন বেশি ফালতু বকিসনা।চল একটু বাইরে


সাদাব- আচ্ছা আসছি তুই যা।আমি একটু দেখে নিয়ে আসছি।


সৌনক স্টুডিও থেকে বেরিয়ে বাইরে গেল।একবার ঘড়িতে তাকাতেই দেখল সোয়া পাঁচটা বাজে।ভিতরে এসির থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই একটা প্রচণ্ড গরম বাতাসে যেন মুখ ঝলসিয়ে চলে গেল।


সৌনক- বাবারে।কে বলবে বিকেল বেলা।আর এই বছর যেন গরম শেষই হচ্ছেনা।কবে যে একটু শান্তি পাবো কে জানে।

(খুক খুক করে আবার কাশিটা শুরু হল)

উফফ বেশ ঝামেলা শুরু হয়েছে দেখছি।এই কাশিটা যেন যাচ্ছেইনা।এই নিয়ে দুজন ভালো ডাক্তার দেখানো হল। প্রায় পাঁচ ,সাত হাজার টাকার ওষুধ গিললাম তাও যেন এই কাশি পিছু ছাড়তেই চায়না।একটা সিগারেট ,প্যাকেটের থেকে বের করে সৌনক জ্বালাতে চাইলো।কিন্তু সে একটু পকেট হাতড়ে বুঝল লাইটারটা তো ভেতরেই ফেলে এসেছে।

তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে ভেতরে যাবে ওমনি......


ট্রিক .......মুখের সামনে তার লাইটারটা জ্বালিয়েছে সাদাব।


সাদাব- ভাই এবার সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা কর বুঝলি।আর ছাড়তে না পারলে অন্তত সেটাকে এক প্যাকেট ডেইলি থেকে কমিয়ে অন্তত একটা কর।এভাবে কেশেই চলেছিস প্রায় একমাস হল।আমি বলছি এসব হচ্ছে এই সিগারেটের জন্যই বুঝলি তো।


সৌনক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল

- কে আবার শিক্ষা দিচ্ছে দেখো।নিজে কমাতে পেরেছিস যে আমাকে শেখাচ্ছিস।


সাদাব- তোর ভালোর জন্যই বললাম।


সৌনক- ঠিক আছে ঠিক আছে।আচ্ছা শোন যে জন্য তোকে ডেকেছিলাম।বিভাসদা(শো এর সঞ্চালক) বলছিল এবার নেক্সট এপিসোডটায় আমাদের যে জায়গাটা সিলেক্ট হবে সেখানে নাকি যেতে হবে।শো এর একশো-তম এপিসোডটা উনি নাকি একদম ব্লক বাস্টার করতে চান।


সাদাব মুখবিকৃতি করে হেসে বলল এই হয় যখন ওই কমার্শিয়াল ফিল্মের পরিচালককে নিউজ শো পরিচালক করা হয়।যত্তসব ভাঁড়ামো।


সৌনক- আরে ভাই চিন্তা করছিস কেন।আমি আছি তো না কি?


সাদাব এবার হেসে বলল হ্যাঁয় তাই তো।তুই ও তো সাংবাদিক না হয়ে নায়ক হলেই পারতিস।


সৌনক আবার বিষম খেলো। খানিক সামলে নিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল কোনও ভালো ডাক্তারকে জানিস?


সাদাব- তুই তো ডাঃ দেবিপ্রসাদ বনিয়াকে দেখাচ্ছিলি না, কি হল?


সৌনক- আর কি হল। কাশি কমলো কৈ?


সাদাব- সকালে উঠে আদা জল খা আর সিগারেট ছাড়।


সৌনক হেসে হেসে উল্টে যাওয়ার অবস্থা তখন


সৌনক- বাব্বাহ। একদম ডাঃ দেবীপ্রসাদের পর ডাঃ সাদাব আলী হেঃ হেঃ।ক্যামেরার কাজের পাশাপাশি কি হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে গেলি আজকাল।


সাদাব খানিক বিরক্ত হয়ে বলল শোন আমি দেখছি কি করতে পারি।আমার যাওয়া কতটা হবে জানা নেই।

ওই রকম উল্টোপাল্টা জায়গা আমার যেতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।


সৌনক- অদ্ভুত কথা বলিস। আর জায়গা বাজে হবে কে বলেছে শুনি।


সাদাব- আজ অব্ধি কোন জায়গাটা আমাদের শো এ সুইজারল্যান্ডের মতো দেখতে দেখিয়েছি বলতো।সব তো হয় মরুভূমি,ফাঁকা বাড়ি, লোকের অভিশপ্ত জমি এসব।না না ওই সব জায়গায় আমার যাওয়ার দরকার নেই।আমি এই বেশ ভালো আছি।


সৌনক- যেতে তোকে হবেই।কারণ এই এপিসোডে আমরা এমন কিছু করে দেখাবো যাতে করে দুজনেই এই চ্যানেল থেকে কেটে পড়ে, আরও বড় কোনও নিউজ চ্যানেলে চাকরি জোটাতে পারি।

তোর মনে আছে গুরবিন্দর কে?


সাদাব উপরে নিচে ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলোনা।


সৌনক- আরে আমাদের এখানের যে আরেকটা চ্যানেল আছে না,ওর একটা শো'তে এইরকম হোস্ট ছিল তারপর আগের বছর সেই গুলবাড়ির মার্ডারটা দেখিয়ে বেস্ট হোস্ট হল আর কেটে পড়লো দিল্লী।এখন প্রায় দু লাখ প্রতি মাসে কামায়।


সাদাব দু লাখ প্রতি মাসে শুনে একটা ঢোক গিলে দুবার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল এরকম হয় নাকি।


সৌনক- আলবাত হয়।আর এবার আমাদের হবে।তুই শুধু মুখ খুলিসনা।বিভাসদা অনেক জ্বালিয়েছে আমাদের একবার এই একশো এপিসোডটা হিট হোক,আমি আর তুই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেটে পড়বো দিল্লি কেমন......


সাদাব তখনও দু লাখ ভেবে উজ্জ্বল চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।


সৌনক- কি রে?


সাদাব- হ্যাঁয়।ঠিক আছে আমাকে কি করতে হবে বল?


সৌনক- তুই শুধু অপর্ণার কাছে সমস্ত লোকের জায়গা দেওয়া হলে আমাকে জানাবি।আমি নিজে সেই জায়গাগুলো থেকে সেরা জায়গাটা খুঁজে নেবো।তারপর লটারিতে একটা গণ্ডগোল করে আমরা সেই লোমহর্ষক রহস্যময় জায়গাটাতেই যাবো ।কারণ এই একশো এপিসোড এই চ্যানেলের জন্য যাই হোক না কেন,আমাদের দুজনের জন্য দিল্লি যাওয়ার টিকিট।



পরের দিন সকাল বেলা

কেরিয়ারে একটা লম্বা ঝাঁপ দেওয়ার তাগিদে সৌনক সেই রাতে আর ঘুমোতেই পারেনি তাই সকাল হওয়া মাত্র সে দৌড়ল অফিসে।উদ্দেশ্য একটা লোমহর্ষক রহস্যের সন্ধান আর কিছু না।

যে ছেলেটি ইতিপূর্বে সকালে কোনোদিন অফিসে না আসার জন্য কুখ্যাত ছিল আজ তার সকাল না না সকাল বলা ঠিক হবেনা ভোরে বলাই ভালো।ভোর ছ'টায় অফিসে একদম তৈরি হয়ে আসা দেখে বিভাস ভৌমিকের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম।তিনি একগাল হেসে সৌনককে বললেন


- কি সৌভাগ্য আমার।আমার জীবন আজ সার্থক হল।এই কে কোথায় আছো একটা নারকেল নিয়ে এসো।আমি আজ অফিসের আর একবার উদঘাটন করবো। হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ


সৌনক বিভাসবাবুর এই পিছনে লাগা স্বভাবটা একদম পছন্দ করেনা।কিন্তু আজ ভিন্ন দিন।সে মনে মনে কুটিল ভাবে হেসে বলল যত খুশি মজা ওড়াও ভৌমিক।তোমার মাথায় পা দিয়ে আমি একলাফে দিল্লি যাবো।আর তুমি,হি হি হি এখনেই বসে বসে ওই ভুতের আর খুনের গুল-গপ্পো দেখাতে থাকবে।


সৌনক মনে মনে কথা গুলো বললেও মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি হাসল।কারণ এখন এই লোকটার মনে একটুকু সন্দেহ হতে দেওয়া যাবেনা ,যে আমি আজ কেন সকালে এসেছি।


সৌনকের চোখ তখন অপর্ণাকে খুঁজছে।কারণ এই অনলাইন কম্পিটিশনটা ওই দেখছে।সমস্ত ডেটা ওর কম্পিউটারে আছে।


তবে ওর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে ,সে শুধু ভাবছে ধুর এই সাদাবটা  কি যে করছে কে জানে? বলেছিলাম রাতে এখানে থাকতে কিন্তু না,ওর কাছে ঘুমটাই সব। রাগে গজগজ করছিল সৌনক।


বিভাসবাবু কিছুক্ষণ হাসার পর এবার একটু গম্ভীর হলেন বললেন কি ব্যাপার সৌনক। আজ ভোরে আসার কারণটা তো বুঝলাম না।তোমাকে তো আমি সন্ধ্যে বেলা আসতে বলেছিলাম তাই না।


সৌনক আমতা আমতা করে বলতে যাবে ওমনি সাদাব বেরিয়ে এলো একটা ঘর থেকে।


সাদাব- স্যার।আমি ওকে আসতে বলেছিলাম।কারণ আমার একটা পেন ড্রাইভ ওর কাছে রয়ে গিয়েছিল।


বিভাসবাবুর কপালে ভাঁজ পড়লো।


বিভাসবাবু সন্ধিগ্নের নজরে সৌনককে দেখে বললেন একটা পেন ড্রাইভ দিতে সৌনকবাবু এত ভোরে এত তৈরি হয়ে এলেন।


একটা নিস্তব্ধতার সৃষ্টি হল কয়েক মুহূর্তের জন্য।মনে মনে সৌনক ভাবল এই যা,আমি মনে হচ্ছে বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেললাম।


কিন্তু পরক্ষণেই হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লেন বিভাসবাবু।


বিভাসবাবু- তা বেশ বেশ।বন্ধুর জন্য তো করতেই হবে।সাদাব আমি খুব খুশি হলাম।অন্তত আমাদের স্টুডিওর হিরো কারোর কথার তো মান রাখে। আই মাস্ট সে আই এম রিয়েলই ইম্প্রেসেড।


এই বলে উনি স্টুডিও থেকে বেরিয়ে গেলেন।সৌনক আর সাদাব একটা হাঁফ ছাড়ল।দুজন দুজনের দিকে তাকাতেই সাদাব ইশারা করলো ভিতরে আশার।


এডিটিং সেকশনের শেষ কেবিনটা হল অপর্ণার।হেঁটে যেতে যেতে সৌনক বলল কি হল কিছু করতে পারলি?


সাদাব- না।জানিসই তো অপর্ণা কেমন মেয়ে?এমন হাবভাব দেখায় যেন ও এখানে একাই সততার প্রতিমূর্তি।


সৌনক- শুধু এটা বল সব এন্ট্রি কি নেওয়া হয় গেছে না বাকি?


সাদাব- হ্যাঁয়।ওটা আমি একদম কনফার্ম।তুই নিশ্চিন্তে থাক যা এন্ট্রি হওয়ার ছিল হয়ে গেছে।


সৌনক- হ্ম্ম।তাহলে আমাদের দরকার ওর ল্যাপটপটা তাই তো?


সাদাব মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।


সাদাব- কি করবি ভাই।


সৌনক- এই এপিসোডটার জন্য আমি আজ দু'বছর ধরে অপেক্ষা করছি,বিভাসদার এত অপমান সহ্য করেছি তাই আমি কোনোমতেই সেটা হাতছাড়া হতে দিতে পারবোনা।


সাদাব- আচ্ছা ওরা কি ঠিক করছে একবার দেখে নিলে হয়না।হতেও পারে ওরা যা ঠিক করবে সেটা ভালো হবে।


সৌনক- শুনলি না ওরা কি বলল।লটারি হবে।


সাদাব মাথা নিচু করলো।


সৌনক- আচ্ছা তুই বলছিলি না যে অপর্ণা আমাকে ভালোবাসে।


সাদাবের মুখ এই কথাটায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল।


সাদাব- ভাই।না। এমন কিছু করিসনা জেতার জন্য যাতে কারুর মনে আঘাত লাগে।


সৌনকের চোখ গুলো তখন কোনও হিংস্র নেকড়ের মতো জ্বলছে।


সৌনক- আমি কোনও ভালো ছেলে হয়ে একটা সাধারণ চাকরি করে মরতে চাইনা বুঝলি তো।আমার স্বপ্ন অনেক বড় আর সেটা এই ছোট চ্যানেলের ছোট শো পূরণ করতে পারবেনা।

আমার সব কিছু চাই টাকা,সম্মান,খ্যাতি সব সব।


সাদাব কিছুক্ষণের জন্য বদলে যাওয়া বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।


সাদাব- তুই শান্ত হ।এখানে কেউ শুনে ফেললে দুজনেই চাকরি হারাবো।


সৌনক তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন।


সৌনক- সাদাব তুই বাইরে যা।কারণ তুই মনে হচ্ছে এখানে থাকলে বাগড়া দিবি।আমি দেখে নিচ্ছি কি করতে পারি।


সাদাব আর কিছু বলতে পারলোনা।সে তখন বদলে যাওয়া বন্ধুর জন্য চিন্তায় আর কিছুটা টাকার লোভে সৌনকের কথা শুনে বাইরে বেরিয়ে গেল।


আর সৌনক এগিয়ে চলল অপর্ণার কেবিনের দিকে।আসলে সৌনক আগে মডেলিং করত কিন্তু রিপোর্টার হওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাকে টেনে আনে এই মিডিয়ার জগতে।ওর প্রতি যে অপর্ণার একটা দুর্বলতা আছে সেটা ও আগেই বুঝতে পেরেছিল কিন্তু এই সাদাসিধে গোছের মেয়েটার প্রতি সৌনকের কোনোদিন ইচ্ছে ছিলোনা।তবে আজ আছে।কারণ একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য তার মনে বাসা বেঁধেছে।আর সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য সৌনক সব কিছু করতে রাজি।


অপর্ণা হটাৎ ভোরে তার কেবিনে সৌনককে ঠেলে ঢুকতে দেখে খানিক চমকে ওঠে।


অপর্ণা- আ আ আপনি এত সকালে।কিছু দরকার আছে ?


সৌনক ভালোভাবেই জানে তাকে কি করতে হবে।

সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে অপর্ণার একদম পাশে বসে যায়।


এত ভোরে অফিসে কেউ নেই আর তারওপর সৌনকের প্রতি তার প্রথম থেকেই একটা আকর্ষণ আছে।তাই খানিক লজ্জায় অপর্ণার মুখ লাল হয়ে ওঠে।


সৌনক- কেন? আমি কি তোমার সাথে দেখা করতে আসতে পারিনা।আর হ্যাঁ আপনি বলোনা পর পর লাগে বরং তুমি বল বেশি ভালো লাগবে।


অপর্ণা এই কথাটা শুনে খুবই হতবাক হয়।সে ফ্যালফ্যাল করে সৌনকের দিকে তাকিয়ে থাকে।


সৌনক বাঁকা হাসি হাসে আর মনে মনে ভাবে টোপ গিলেছে তাহলে। এভাবেই এর মন গলিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে আমাকে।


সৌনক- অপর্ণা আজ কিন্তু তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।


সৌনকের চরিত্রের যে একটি দোষ আছে তা প্রায় কমবেশি সবাই জানে,সবাই মানে সবাই অপর্ণাও।কিন্তু ওই যে কাউকে ভালোলাগলে ,ভালোবাসার মানুষটির সব দোষগুণ নিজের কাছে মাফ হয়ে যায়।অপর্ণা তার ব্যতিক্রম ছিলোনা।


কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে সৌনকের তার প্রতি যে ভালোবাসার উদয় হয়েছে এটা তার মনে কিছুটা খটকার সৃষ্টি করে।


অপর্ণা লাজুক ভাবে জিজ্ঞাসা করে

- তুমি এভাবে এখন এখানে কি শুধুই আমার জন্য এসেছ?


সৌনক চোখের পলক না ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে রইলো।লজ্জায় অপর্ণা চোখ সরিয়ে নিজের ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলো।


সৌনক- ও তারমানে আমার শুধু কাজ না থাকলে আশা যাবেনা তাই তো।ঠিক আছে চললাম আমি।

এই বলে উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে দরজা খুলে সে বেরিয়ে গেল।সৌনকের বুক তখন ঢিপঢিপ করছে যে যদি অপর্ণা তাকে তার ল্যাপটপ না দেখতে দেয় তো সব পরিশ্রম মাটি হয়ে যাবে।


এদিকে যার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অপর্ণা এতদিন অনুভব করছে সে নিজে থেকে তার কাছে এসেও এভাবে চলে যাচ্ছে দেখে তার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।


অপর্ণা কিছু ঠিক না করতে পেরে অবশেষে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে ডাকল সৌনক


উল্টোদিকে সৌনক যেন এই জিনিসটার অপেক্ষাতেই ছিল,সে করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অপর্ণার গলা শুনে দাঁড়ালো।হাসি হাসি মুখে সে পিছু ফিরে চেয়ে দেখছে অপর্ণা ওর কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে।সুদর্শন ,সৌম্য কান্তি এই যুবকটির মন যে কতটা কুটিল তার বিন্দুমাত্র আভাস অপর্ণা তখন পায়নি।


অপর্ণা লাজুক ভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল এসো আমার কেবিনে। শিকারকে একলা পেলে যেমন হায়েনা কুৎসিত হাসি হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় শিকারের দিকে ঠিক তেমনি ধীর পায়ে চোখে মুখে ভাবলেশহীন মূর্তি ধারণ করে সৌনক এগিয়ে চলল অপর্ণার দিকে।


দুজন একলা কেবিনে বসে কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছেনা।তার চেয়ে বড় কথা হল দুজনের মন ভিন্ন নজরে একে অপরকে তখন দেখছে।অপর্ণা আজকে সৌনকের এই ব্যবহারে অল্প বিস্মৃত হলেও সে যে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এটা জেনে মনে আহ্লাদ অনুভব করছে ,তেমনি সৌনকের মনে তখন ঝড় উঠেছে কারণ সে ও তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের মাঝে তখন একটাই ধাপ আর সেটা হল অপর্ণা।


সৌনক- তোমাকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা।


অপর্ণা এমনিতে খুবই স্পষ্টভাষী মেয়ে, সে কাউকে তোয়াক্কা করেনা কিন্তু সৌনক যে ভিন্ন সবার চেয়ে।

অপর্ণা বুঝতে পেরেছে ও কি বলতে চায় তাও বলল কি বলতে চাও বল?


দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে এই একান্তে কাটানো সময়টা যদি কেউ দেখত তাহলে সে বুঝত সৌনক শুধু ভালো সাংবাদিক তা নয় ,ওর এই মেকি ভালোবাসা দেখানোর অভিনয়টা সত্যি তাজ্জব করার মতো।


সৌনক- অপর্ণা তুমি সত্যি সবার চেয়ে আলাদা জানতো।আর সেই কারণেই আমার তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।


অপর্ণা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও এইভাবে আজ সৌনক যে ওকে প্রপোজ করবে সেটা একদমই ভাবতে পারেনি।


সে শুধু স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সৌনকের দিকে।


সৌনক- আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি অপর্ণা।কিন্তু আমি..........(অসম্পূর্ণ ভাবে কথাটা শেষ করে সৌনক মাথা নামিয়ে জানালার দিকে তাকাল)


অপর্ণার তখন মন নিজের নিয়ন্ত্রণে আর নেই।সে বলে উঠলো কিন্তু কি সৌনক?


সৌনক মনে মনে আশ্বস্ত হল যাক তাহলে অপর্ণা কাত হয়েছে? এবার কি বলি


সৌনক ভেবে চলেছে সে কি ভাবে ওর ল্যাপটপ দেখবে আর অপর্ণা ভাবছে সৌনকের তাকে ভালবাসতে অসুবিধে কোথায়।


তবে এই অসস্তিজনক নিশ্চুপ পরিস্থিতির অন্ত করলো সৌনক নিজেই।

সৌনক অপর্ণার হাত ধরতেই অপর্ণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।


সৌনক- আমি আগে অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করো কাউকে আমি নিজের বলে ভাবতে পারিনি।ওরা যতজন ছিল সবকটা ছিল স্বার্থপর কেউ আসলে আমাকে বুঝতেই চাইনি আমি কি চাই।আসলে কি বলতো ওরা আমাকে ভালোই বাসতোনা। কিন্তু আমি জানি তুমি বাসো তাই না।


অপর্ণার লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেল।সে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারলোনা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল


অপর্ণা- আমি খুবই সাধারণ মেয়ে।আমি জানিনা তুমি আমাকে কি দেখে পছন্দ করলে।কিন্তু আমার বিশেষ কোনও গুন নেই যা তোমার মতো ছেলেকে আকর্ষিত করবে


সৌনক এই কথাটার অপেক্ষাতেই যেন ছিল, সে এক মুহূর্ত দেরি না করে লুফে নিলো এই কথাটা।


সৌনক- আছে আছে।তোমার সবচেয়ে ভালো গুন হল তুমি আমাকে ভালোবাসো আর কিছু না।বিশ্বাস করো এর বেশি আমি কিছু চাইনা।


অপর্ণা খানিক ইতস্তত বোধ করতে লাগলো।এদিকে সৌনকের মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে কারণ সময় তখন সাড়ে সাতটা।আর আধ ঘণ্টায় অফিসে সবাই চলে আসবে আর সেটা হলে কিছুতেই অপর্ণার কাছ থেকে ওর ল্যাপটপ দেখা সম্ভব হবেনা।


সৌনক মনে মনে ভাবতে লাগলো কি করে সে বলবে যে ওর ল্যাপটপটা ওর চাই।এখুনি অপর্ণার মনে কিঞ্চিৎ ওর প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি করেছে আর এখুনি ওর কাছে চাইলে যদি ও কিছু খারাপ ভাবে।

কিন্তু..............


কিন্তু কোথায় আছে না দুর্জনের ছলের অভাব নেই।একথা একদম মিথ্যে নয় কারণ সৌনক তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে একটা চমৎকার উপায় বের করলো


সৌনক- কিন্তু অপর্ণা আমি এভাবে তোমাকে সারাজীবন রাখতে পারবোনা।


একমুহূর্ত আগে অব্ধি যে সৌনক ছিল শুধু মাত্র ক্রাশ আজ হঠাৎ করে তার মুখে সারাজীবন সাথে থাকার কথা শুনে অপর্ণা হতবাক হয়ে গিয়েছিল।খানিক সামলে নিয়ে সে বলল


- কি অসুবিধে শুনি?


সৌনক চিন্তায় ভেঙে পড়ার অভিনয় করে বলল

আমি এই ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকতে চাইনা।আমি চাই আরও বড়ো কিছু করতে ,দেশে বিদেশে খ্যাতি চাই আমার।নিজের নাম, যশের কথা বলতে বলতে সে ভুলেই গিয়েছিল তাকে আসলে বলতে কি হবে।নিজেকে সামলে নিয়ে সৌনক বলে উঠলো তবে নিজের জন্য নয় শুধু, আমি চাই আমাদের দুজনের জন্য।


অপর্ণার চোখে তখন একরাশ স্বপ্নের মায়াজাল বুনেছে সৌনক।যা থেকে এই সরল মনের মেয়েটির বেরোনো বেশ মুশকিল।


সৌনক- আর আমাদের এই স্বপ্ন পূরণ একমাত্র তুমি করতে পারো।


মন্ত্রমুগ্ধের মতো অপর্ণা তখন সৌনকের সব কথা শুনছে।সে তখন আনন্দে আত্মহারা।


অপর্ণা- আমাকে কি করতে হবে বল?


সৌনক- পরের এপিসোড আমাদের দুর্দান্ত করতে হবে অপর্ণা।আর তাই এই এপিসোড আমাদের কোনও লটারি করলে চলবেনা।


অপর্ণা- তুমি কি বলছ বুঝতে পারলাম না।


সৌনক একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর পনেরো মিনিট।


সৌনক- তোমাকে সব ঘটনা গুলো পড়ে আমাকে সেরা ঘটনাটা তুলে দিতে হবে।তাও মিথ্যে লটারি করার ভান করে।


অপর্ণা এই কথাটা শুনে যেন চমকে গেল।পুরো জীবনে ও কোনোদিন ওইরকম অসৎ কাজ করেনি।


অপর্ণা নিজের হাতটা সৌনকের কাছ থেকে ছাড়িয়ে বলল অসম্ভব।


সৌনকের অবস্থা তখন শিকার করেও শিকারের স্বাদ না পাওয়ার মতো।সে নিজের মনকে কোনোমতে শান্ত করলো যদিও ওর মন ততক্ষণে এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছে যে একমুহূর্তের জন্য ওর মনে হল যে অপর্ণাকে মেরে ওর ল্যাপটপ হাতিয়ে নিলে কেমন হয়?


অপর্ণা মাথা নামিয়ে বলল আমাকে ক্ষমা করবে সৌনক।আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি কিন্তু একাজ আমি করতে পারবোনা।


সৌনক- আমি কি আমার জন্য করতে বলছি তোমাকে।এসব আমাদের ভালোর জন্য।


অপর্ণা আর উত্তর দিলোনা।সে পুনরায় তার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রইলো যদিও যা সব একটু আগে হল তারপর ওর মনে কাজ করার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র নেই বললেই চলে।


সৌনক কিন্তু হালছাড়ার পাত্র নয়।সে সমানে অনেক রকম ভাবে প্রেম দেখিয়ে, ছল করে অপর্ণার মন গলাতে চাইলো কিন্তু ওর সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল অপর্ণা।


রাগে গজগজ করতে করতে সৌনক বেরিয়ে গেল রুম থেকে।আর এবার সে সত্যি চলে যেতে চাইলো।কারণ ঘড়িতে তখন আর পাঁচ মিনিট বাকি বাকিদের আসতে।


হন্তদন্ত হয়ে নীচে নামতে নামতে গেটের কাছে সৌনকের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মারল সাদাব।


প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে সাদাব তখন থেকে দাঁড়িয়ে ছিল।তবে সৌনককে এভাবে রেগে-মেগে আসতে দেখে বুঝতে পেরেছে যে অপর্ণার কাছে বিশেষ কিছুই সুবিধে করতে সে পারেনি।


সাদাব- বলেছিলাম।ওই মেয়ে হল সুপুরির মতো বুঝলি তো।কিছুতেই ভাঙবেনা।যাই করে নে।


সৌনক- ধুর তেরি।যুধিষ্ঠিরের নারী রূপ মনে করে নিজেকে।কি যে ভাবে কে জানে।এত করে বোঝালাম কিন্তু না,উনি এই এজেন্সির বিরুদ্ধে কিছু করবেন না।থাকো তাহলে এখানে কুনোব্যাঙ হয়ে।


সাদাব- ভাই কুনোব্যাঙ তো আমরা দুজনেও।ওর কাছে বেস্ট প্লট না পেলে দায়সারা গোছের একটা এপিসোড হবে।মেয়েরা তোকে মেসেজে কিউট,হ্যান্ডসাম এসব বলবে।আর ছেলেরা বলবে ফাটিয়ে দিয়েছো গুরু।ব্যাস।

আর এই ভাবেই শেষ হবে তোর দিল্লি যাওয়া।


শেষের কথাটা শুনে যেন সৌনকের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো।

সৌনক- খবরদার ওই কথা মুখেও আনবিনা।যাবো আমি নিশ্চয়ই আর সেটা যেভাবেই হোক না কেন।


নীচে সৌনক আর সাদাব তখন বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে তখনই পিছন থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো


- সৌনক একবার আসবে।


পিছু ফিরে তাকাতেই সৌনক আর সাদাব অবাক।দেখছে অপর্ণা ডাকছে।


সৌনক দ্রুত এগিয়ে গেলো অপর্ণার দিকে। কিন্তু সে খুবই বিরক্ত


সৌনক- বল


অপর্ণা কিছু না বলে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো


সৌনক- আরে বলবে কিছু না এমনি ডাকলে।শোনো আমার অনেক কাজ আছে আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি।তুমি তো আমার ভালো চাওনা,তো থাক।আমি এখন এখানে পঁচে মরি আর তুমি খুশি হও কেমন?


অপর্ণা চোখদুটো ভিজে এলো


অপর্ণা- প্লিজ এরকম বলোনা।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।


সৌনক- ধুর ছাই।অমন ভালোবেসে কি হবে শুনি,যে নিজের ভালোবাসার উত্থান দেখতে পারেনা সেটা আবার সত্যিকারের ভালোবাসা নাকি।


অপর্ণা লজ্জায়,অপমানে কিছু বলে উঠতে পারলোনা।কিন্তু অপর্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তখন সৌনক বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছে ।


বহুকষ্টে অপর্ণা বলল- আচ্ছা আমি আমার ল্যাপটপ তোমাকে দিলে তুমি খুশি হবে তো?


মুহূর্তের মধ্যে সৌনকের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।মনে ওর পুনরায় আশা জেগে উঠেছে তখন


ঘাড় ঘুরিয়ে ছুটে গিয়ে অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরল সৌনক।


সৌনক- সত্যি বলছ তুমি।


অপর্ণা- হ্ম্ম।


পিছনে তখন সাদাব এই দৃশ্য দেখে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।সৌনক যে অপর্ণাকে মিথ্যে প্রেমের ছলনা করে পাপ করছে সেটা সে ভালোভাবেই জানে।কিন্তু তার মন সেটা ভেবে চঞ্চল নয়।সে শুধু ভাবছে এই পাপের ভাগীদার হিসেবে সে কতটা পাপী।








মন্দের দেবী (পর্ব-২)

©লেখক- দেবদত্ত





অফিসে ধীরে ধীরে এবার বাকিরা আসতে শুরু করেছে।তাছাড়া আজ সন্ধ্যে বেলায় ঘোষণা হবে একশো এপিসোডের জায়গাটা কোথায়।তাই বিভাসবাবুর কড়া নির্দেশ আছে যেন কেউ আজ দেরি না করে।

পুরো অফিসে একটা হৈ হৈ রব।


এই অবস্থায় অপর্ণার কাছে ল্যাপটপ নিয়ে আলাদা করে কাজ করা খুবই অসুবিধে,তারপর অফিসে কাঠি করার লোকের তো আর অভাব নেই।

এদিকে সৌনক অফিসে প্রায় প্রতিটি মেয়েকেই ও কখনো না কখনো কিছু কাজের জন্য প্রেম প্রতারণা করেছে।তাই বর্তমানে ওর বন্ধুর চাইতে শত্রুর সংখ্যা খানিক বেশি।


সাদাব- সৌনক এভাবে কেউ দেখে ফেললে জাস্ট কেলো হয়ে যাবে।বিভাসদা তোকে বের করুক না করুক আমাকে তো করবেই।


সৌনক মুখভঙ্গি করে বলল চুপ করে থাক, কিছুই হবেনা।আমরা করতে যাবো কেন?


সাদাব- তাহলে


সৌনক শয়তানের মতো কুটিল ভাবে হেসে বলল অপর্ণার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে থাকতে আমরা কেন চাপ নেব ভাই।কাজ ওকে দিয়েই করাবো।ফাঁসলে ও ফাঁসবে।তুই দেখতে থাক।


সাদাব খুব ঘাবড়ে গেল,কিন্তু সৌনককে প্রতিবাদ করার মতো জোর ওর নেই।


অপর্ণা ততক্ষণে নিজের কেবিনে ল্যাপটপটা আনতে গেছে ।কিছুক্ষণেই ও বেরিয়ে এলো কিন্তু ওর মুখে একটা গ্লানির ছাপ।যেন জীবনে এই প্রথম বার ও কোনও ভুল করছে।


অপর্ণাকে আসতে দেখে সৌনক পুনরায় হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে গেলো।


সৌনক- এনেছ?


অপর্ণা গম্ভীর ভাবে ইতস্তত করতে করতে বললো আমরা এটা ঠিক করছি তো সৌনক?


সৌনক কিন্তু পাক্কা অভিনেতা।অপর্ণার কাছ থেকে ল্যাপটপটা না নিয়ে ওর হাত ধরে বলল যা করছি শুধু আমাদের জন্য করছি,একার জন্য হলে করতাম না।তুমি ভয় পেয়োনা।


তবে এই কথাটা বলে সৌনক এদিকে সেদিকে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাতে লাগলো।সাদাব বা অপর্ণা দুজনেই বুঝতে পারছে না যে কি হয়েছে?


অপর্ণা- কিছু বলবে?


সৌনক অপর্ণার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অনেক খানি ভেবে বললো আমার থেকে তুমি বেশি ভালো জানো যে কোন গল্পে আমার এই এপিসোড হিট হতে পারে।তুমি আমার জন্য সেরাটা বেঁছে দেবেনা অপর্ণা।


সৌনকের নিরীহ প্রেমিকের চোখদুটো তখন অপর্ণার বোধবুদ্ধি লোপ পাইয়েছে।


অপর্ণা মুখে কিছু না বললেও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।আর তিনজন এগিয়ে গেলো বেসমেন্টের দিকে একটা ফাঁকা ঘরে।কারণ সবার চোখ এড়িয়ে যে কাজটা করতে হবে।

এপিসোড বাছাই

সপ্তাহে মাঝে মাঝে সাফাই কর্মীরা বাদে,বেসমেন্টের এই ঘরটায় বিশেষ কেউ আসেনা। তাই সবসময় ঘরটায় একটা গুমোট হয়ে থাকা পরিবেশ হয়ে থাকে।

সাদাব এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বালাতেই দ্যাখে, পুরো অফিসের ভাঙা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও অন্য আবর্জনায় ঘরটা ভর্তি হয়ে আছে।তবে তারই মধ্যে একটা ভাঙা টেবিল ও চেয়ার দেখা যাচ্ছে।চেয়ার একটাই থাকায় সেটায় অপর্না গিয়ে বসলো। আর বাকিদুজন দাঁড়িয়ে থাকলো ওর পাশে।

দীর্ঘদিন চারিদিক দিয়ে বদ্ধ থাকায় রাশি রাশি ধুলো জমে আছে ইতস্তত।

সৌনকের আবার সেই খুক খুক করে কাশিটা শুরু হয়েছে।


সাদাব- তুই বাইরে যা, একটু জল খেয়ে আয়।এখানে ধুলোর জন্য তোর কাশিটা বাড়ছে।যা জলদি.......


সাদাবের কথাটা সৌনকের মনে ধরলো.... সে বেরিয়ে যেতে যেতেই বললো তোরা দেখতে থাক আমি

আসছি।


সৌনক একমাত্র মনে হয় সাদাবের কথায় শোনে।ও বেরিয়ে যেতেই অপর্ণা বললো।

- তোরা এত ভালো বন্ধু কি করে হলি রে?সৌনক তো কারোর কথাই শোনেনা।


সাদাব কিন্তু তার বন্ধুটিকে ভালোভাবে চেনে।চোখের সামনে সে দেখতে পাচ্ছে যে অপর্ণার দুঃখের দিন খুব সামনে।কিন্তু কি করে বলবে সে।সৌনক যে তার এই অফিসে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।শুধু প্রিয় বলা ভুল হবে

আসলে এই অফিসে ও সাদাবের প্রথম বন্ধু।গ্রাম থেকে যখন সাদাব প্রথম এই অফিসে এসেছিল সবাই ওর কথা বলার ধরণ কিংবা পোশাক নিয়ে টোন টিটকারি মারতো।কিন্তু সৌনক কোনোদিন মারেনি।অফিসের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে তারসাথে এত ভালো ইংরেজি বলে কিন্তু সাদাবের কাছে সে ছিল একদম তারই মতো একজন সাধারণ ছেলে।কোনোদিন সে সাদাবকে এটা পর্যন্ত বুঝতে দেয়নি যে ও একজন টেকনিশান মাত্র আর সৌনক এই চ্যানেলের স্টার।


মনের মধ্যে দুটো চিন্তা তখন ঘুরপাক খাচ্ছে সাদাবের।একবার মনে হচ্ছে বলে দি..... অপর্ণা মেয়েটা খারাপ না।ওর মনে আঘাত দেওয়া ঠিক হচ্ছেনা।

আবার পরক্ষনে সৌনকের উজ্জ্বল মুখটা মনে পড়ছে যখন ও বলছিল," আমার কেরিয়ার এবার দিল্লিতে হবে,এখানে নয়"।

মানসিক টানাপোড়নে তখন সাদাব নিরুত্তর হয়ে হয়ে অন্য চিন্তায় মগ্ন।


অপর্ণা - কি রে কিসের এত চিন্তা করছিস?


সাদাব- না মানে.........কিছুনা ছাড়।


অপর্ণা মুচকি হেসে বললো আমি জানি তুই কি বলবি?


সাদাব এবার খানিক অবাক হলো।ও অপর্ণার দিকে চাইতেই দেখে,অপর্না ওর দিকে ঘুরে তাকিয়েছে।


অপর্ণা- আমি সৌনককে আজ দেখছিনা রে।অনেক বছর ধরে আমিও কাজ করছি।তুই এটাই বলতে চাস তো ,যে আমি যেন মনে কষ্ট না পাই .....কারণ সৌনকের এসব মিথ্যে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না।


সাদাব চমকে উঠলো।


সাদাব- মানে তুই জানিস?


অপর্না পুনরায় ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে বললো জানি।তবে এটাও সত্যি যে আমি ওকে ভালোবাসি।আর তাই এটা জেনেও আমি এসেছি এখানে যাতে ওর জীবনটা অন্তত ভালো হোক।আমি নিজে এটা ভেবেই খুশি হব যে, অন্তত ওর স্বপ্নপূরনে খানিক আমারও অংশীদারিত্ব আছে।কি বলিস.........( অপর্না হেসে উঠলো)


সাদাব এই কথাটার জন্য একটুকুও প্রস্তুত ছিলোনা।সে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।


দুজনের মধ্যে তখন একটা অপ্রস্তুতজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।তবে এরই মধ্যে ঘরে ঢুকলো সৌনক


সৌনক- কি রে এভাবে জড়ভরতের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন?কিছু কাজ শুরু হলো নাকি গল্পই চলছে......


সাদাব তখন কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা,কয়েক মুহূর্ত আগে অপর্ণার কাছে কথা গুলো শোনার পর ওর বলার আর কোন ভাষা নেই।


অপর্ণা কিন্তু বেশ সাবলীলভাবে হেসে বললো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এসো.......


সৌনক এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াতেই অপর্না তার কনফিডেন্সিয়াল লগইন আর পাসওয়ার্ড দিয়ে কম্পিটিশন পোর্টালটা খুলতেই দেখা গেল সর্বসাকুল্যে ৩৬৭ টা মেল এসেছে।


সাদাব- এ কি রে ৩৬৭ টা মেল তাও এক রাতেই।এত কিভাবে খুঁজে দেখবো?


অপর্ণা মুচকি হেসে একবার সৌনকের দিকে তাকিয়ে বলল আমি দেখে দেব ভেবোনা।


সাদাব আবার মাথা নিচু করলো,কিন্তু এবার সাদাবের বদলে যাওয়া মুখ সৌনকের চোখ এড়ালোনা।


সৌনক সাদাবের দিকে তাকিয়ে ঈশারা করতেই সাদাব হেসে ঘাড় নাড়লো যে সে ঠিক আছে।আর তারপর তিনজনেই মনোনিবেশ করলো অপর্ণার ল্যাপটপে।


প্রথম মেল

নমস্কার সৌনকদা আমি হরেকৃষ্ণ ভূঁইয়া মেচেদা থেকে বলছি। এখানে মাছখেঁকো ভুত আছে।তুমি এসে এখানে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারোতোমার অনুরাগী হরেকৃষ্ণ


সৌনক- এটাকে আগে ডিলিট কর।ফালতু যত্তসব।


বাকিরা সৌনকের কথা শুনে হেসে উঠলো


দ্বিতীয় মেল

হেলো সৌনক,আমার নাম শতাব্দী চ্যাটার্জি।আমি গিরিডি থেকে বলছি।এখানে আমাদের একটা পৈতৃক ভিটে বাড়ি আছে।ভুতের কোনো ফিল্মের জন্য একদম আদর্শ।আপনি যদি এখানে কোনো কাল্পনিক ভুতের কল্পনা করে টেলিকাস্ট করেন তো আমাদের কোনো অসুবিধে নেই।আসলে আমি আপনার খুব বড় ফ্যান।আপনাদের এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করবো।

আপনি অবশ্যই আসবেন


সৌনক কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেলটা ক্লোজ করে অপর্না পরেরটা খুললো.............তবে তৃতীয়টাও একই,কোনো পার্থক্য নেই।

এই করে করে প্রায় সত্তরটা মেল পড়ে ওরা বুঝলো বেশিরভাগ প্রতিযোগী আসলে ভুয়ো।কোনো অদ্ভুতুড়ে কান্ড তাদের জানা নেই শুধু সৌনকের ভক্ত এই যা।


সৌনক খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো।


সৌনক- ধূর।একটাও জুতের মেল নেই।এই নিয়ে কি এপিসোড হবে শুনি।একশো এপিসোড এই রকম কোনো মেল জিতে গেলে কেরিয়ারের রাম রাম সত্য হ্যায় হয়ে যাবে।

সৌনক অস্থির হয়ে একটা সিগারেট জ্বালাতে যাবে ওমনি অপর্ণা বলে উঠলো তুমি সিগারেট খেয়োনা, আমার অসুবিধে হয়।কিছু না বলে সৌনক সিগারেটটা পুনরায় পকেট পুরে ফেললো।


সাদাব- ভাই এসব কি?

আমাদের তো ভালো এপিসোডের আশা বেশ কম দেখছি।


সৌনক কিছুই বললোনা,মনে মনে বেশ গালাগাল দিচ্ছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।


তবে অপর্ণা কিন্তু প্রানপনে খুঁজে চলেছে তখনো।আর সাদাব অবাক হয়ে দেখছে যে সত্যি এই মেয়েটা সৌনককে খুবই ভালোবাসে।সব জেনেও অপর্ণা যেভাবে কাজ করছে সেটা যদি সৌনক জানতে পারত তাহলে বুঝত ও আসলে কি হারাচ্ছে।


এদিকে বেলাও বেড়ে চলেছে তখন।অপর্ণার চেষ্টার কোনো খামতি নেই,কিন্তু একটা ভালো পার্টিসিপেন্ট না পেলে ওই বা কি করতে পারে?

সৌনক অধৈর্য্য হয়ে বেশ কয়েক বার অশ্লীলভাষায় গালাগাল দিলো,তবে সেটায় তাদের কপাল ফেরেনি।


প্রায় ঘন্টা খানেকের পরিশ্রম পণ্ড বলেই মনে হচ্ছিল ওদের। তখনই একটা মেল চোখে পড়ে অপর্ণার।মেলটা অন্য সব মেল গুলোর থেকে আলাদা কারণ............


মেল টার টাইটেল অভিশাপের গ্রাম


নমস্কার সৌনকবাবু,আমাকে ,আপনার ও আপনার চ্যানেলের একজন অন্ধভক্ত বলতে পারেন।আমি মাসরা জাতির একজন লোক,আমার নাম ভিকু মাসরা। আমরা দিবাডিয়া গ্রামের মানুষ।


জায়গার ঠিকানা- কলকাতার থেকে বিমাণ্ডুলিতে বাসে করে এসে,মানসিন গ্রামের বাসে চাপবেন।সেখান থেকে ততরাং পুকুরের কাছে নেমে পুকুরের পাড় দিয়ে সোজা হেঁটে এলেই আমাদের ছোট্ট গ্রামটিতে পৌঁছবেন।আপনারা এলে সোম, বুধ,শুক্র বারেই আসবেন কারণ এখানে এই তিনদিনে বাস চলে।


জায়গা বর্ণনা- তিনশো বছর ধরে একটি অভিশাপকে আমরা বয়ে চলেছি।আমরা আসলে সেই অভিশাপকে নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি এই এত বছর। যাতে সেটা শহরে ছড়িয়ে না পড়ে।আপনারা আসার আগে আমাকে একবার জানিয়ে দিলে আমি আপনাদের ততরাং থেকে নিয়ে আসবো।আপনাকে একান্ত ভাবে অনুরোধ করব এখানে আসার জন্য,কারণ আমি চাই অন্তত শহরের লোকজন চিনতে পারুক এই মাসরা উপজাতির লোকেরা তাদের কত উপকার করেছে।


আপনি এলে বাধিত হবো।

ভিকু মাসরা ০৩২৪৪ ২৪৫৬৬৮ (টেলিফোন)।




মেলটা পড়ে আমরা তিনজনেই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম।আমাদের তিনজনের মধ্যে প্রথম মুখে কথা ফুটল সৌনকের।


সৌনক- ইন্টারেস্টিং....... ভেরি ইন্টারেস্টিং।আচ্ছা লোকটা মেল করেছে একটা ক্যাফে থেকে তাই না।


অপর্ণা একটু ভালোভাবে দেখে বললো হ্ম্ম।মানসিন দাস ক্যাফে।সেন্ডার মেল হলো dascafe24@gmail.com


সাদাব- ভাই লোকটার এই বাজারেও মোবাইল নেই।তারমানে ওইখানে কি ফোনের নেটওয়ার্ক আসেনি।


সৌনক- হতে পারে।তবে এই লোকটার মেলটা আমাকে বেশ রোমাঞ্চিত করছে বুঝলি।আমার এটাও মনে হয় ,এই টেলিফোনটা আসলে ওই ক্যাফের।জানিনা কতটা সত্যি হবে তবে বেশ নতুনত্ব আছে।ভিকু মাসরা বাঃ নামখানা বেশ কিন্তু।

একেই ফাইনাল করে দাও অপর্ণা ডার্লিং।


অপর্ণা লজ্জা পেল আর সৌনক সাদাবের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ মারলো।



আর এই ভাবে শুরু হলো সেই যাত্রার,যা বদলে দেবে সবার জীবন।অভিশাপ শুধু নয় এখানে,লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া এক লোকদেবী।শহুরেমানুষ যা থেকে রয়ে গেছে সম্পূর্ন বঞ্চিত।গল্পের ভীত হলো আস্থা,অনাচার আর এক ভয়ঙ্কর দেবী।আদলে তাকে কি দেবী বলা উচিত না নাকি নয়,সেটাই হলো এই গল্পের মুখ্য প্রশ্ন।এপিসোড কিছুদিনের মধ্যেই আসছে তৈরি থাকুন,আর হ্যায় সুস্থ থাকুন।রোগ জ্বালা থেকে মুক্ত থাকুন।কারণ এই দেবী রোগ পছন্দ করেন।





মন্দের দেবী (পর্ব ৩)

© লেখক- দেবদত্ত

সন্ধ্যে ৭টা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি।সৌনকের মুখে মেকআপের শেষ টাচ চলছে আর কয়েক মুহুর্ত পরেই জানা যাবে একশো এপিসোডের সেই চির অপেক্ষিত জায়গা। বিভাসবাবু আজ মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো স্টুডিও মাতিয়ে রেখেছেন।


বিভাসবাবু- সবাই তৈরি হও জলদি।এত ঢিলেমি করলে আমি দূর করে দেব বলে রাখলাম।

এই সাদাব এই, এখনো লেন্স দেখছো তুমি।না ,না এই রকম অপেশাদার লোকজনকে নিয়ে আমি কিভাবে এতগুলো এপিসোড করলাম ভগবান ই জানেন।


সাদাব খুব বিরক্ত হয়ে বলল তা আপনি বুঝি একা হাতেই সব এপিসোডগুলো করলেন।


বিভাসবাবু- এই তুই মুখ সামলে কথা বল বুঝলি।বেশি মুখে মুখে তক্কো করলে না লাথি মেরে স্টুডিও থেকে দূর করে দেব বলে রাখলাম।


সাদাব- তা একবার লাথিটা মেরেই দেখুন না।


হটাৎ করে পরিস্থিতিটা এরকম গরম হয়ে উঠবে বলে কেউ আশা করেনি।কিন্তু বিভাসবাবুর মাথার তখন ঠিক নেই।সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন সাদাবের গালে


বিভাসবাবু- তবে রে হতভাগা।টেকনিশিয়ান টেকনিশিয়ানের মতো থাকবি সঞ্চালক হতে জাসনা।সালা আমি কাজ না দিলে পেটে ভাত পেতিসনা।অপদার্থ একটা।


সাদাব অপমানে তখন থরথর করে কাঁপছে।চোখগুলো ফেটে জল বেরোবে বলে মনে হলো।


নীলাকাশ- একদম স্যার ঠিক করেছেন।এই সাদাবের আজকাল না খুব বেশি বাড় বেড়েছে।নিজেকে একটা কেউকেটা ভাবে। ক্যামেরাম্যান অনেক দেখেছি স্যার কিন্তু এত অসভ্য দেখিনি।আপনার মুখে মুখে তর্ক করে।দেখুন ,দেখুন কেমন বেহায়া।একটা সরি অব্দি বলছেনা।


সৌনক এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলো।


সৌনক- এই নীলাকাশ কি ভাবিস রে তুই নিজেকে।তুই কে ওর ব্যাপারে যা খুশি বলার।


নীলাকাশ আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই বিভাসবাবু থামালেন।


বিভাসবাবু - আহঃ সৌনক ,তুমি আবার এর মধ্যে কেন আসছো বলোতো?


পিছন থেকে কেউ একটা বলে উঠলো আহারে জগাই কে বলেছে বলে মাধাই এর রাগ হলো বুঝি।সাথে সাথে পুরো স্টুডিও হাসির কলরবে ফেটে পড়লো,শুধু তিনজন ছাড়া।(ভাবছেন তৃতীয় জন কে, 

সে আসলে আর কেউ না অপর্ণা।)


যাই হোক একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির থেকে পুনরায় শুটিং শুরু হলো,সৌনক সাদাবের দিকে চোখ যেতেই দেখলো সাদাবের চোখগুলো ছলছল করছে।আর ওর বাঁ গালটা, চড়ের জন্য টকটকে লাল হয়ে গেছে কিন্তু ছেলেটার পেশাদারিত্ব দেখে সম্মান করতে ইচ্ছে করে,কারণ এত কিছুর সত্ত্বেও সে ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে বললো রেডি ফর শুট


সাথে সাথে বিভাসবাবু বললেন একশন


- নমস্কার,আমি সৌনক আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান "লোকচক্ষুর আড়ালে" আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই।বন্ধুরা আজ সেই দিন ,যার জন্য আপনারা কাল থেকে অপেক্ষা করছেন।এই মাত্র ২৪ ঘন্টায় আপনারা আমাদের প্রায় পাঁচশোর বেশি মেল করেছেন,আর সেই মেলগুলোর মধ্যে থেকে আজ আমরা লটারির মাধ্যমে বেঁছে নেব আমাদের একশো তম এপিসোড।তাহলে আপনারা তৈরি তো?


বিভাসবাবু ইশারা করলেন ভি এফ এক্স টিমকে, যেন তারা গ্রাফিক্সের দ্বারা লটারি প্রক্রিয়াটি দেখায়।


সৌনক- বন্ধুরা তাহলে আমরা শুরু করছি লটারির প্রসেস।এক,দুই,তিন গো.........................

টিভির পর্দায় তখন দেখা যাচ্ছে কিভাবে লটারি হচ্ছে আর তার মধ্যে থেকে একটি মেল সিলেক্ট হয়ে উঠে এলো


-বন্ধুরা আমরা পেয়ে গেছি আমাদের আজকের বিজেতাকে।চলুন তাহলে দেখা যাক কে আসলে জিতলেন এই প্রতিযোগিতাটি....


টিভির ওপারে তখন এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা চলছে কিন্তু এই অপেক্ষার ফল যে কি তা জানে শুধু তিনজন।সৌনক লটারি হওয়া মেলটা ক্লিক করতে খুলে এলো ওর আগেই পছন্দ করা মেলটা।


মুখে দ্বিগুন হাসি এনে সৌনক বললো আজকের আমাদের বিজয়ীর নাম ভিকু মাসরা ঠিকানা দিবাডিয়া গ্রাম। ভিকু মাসরা আপনাকে জানাই অনেক অনেক অভিনন্দন।আপনার দেওয়া ঠিকানাতেই আমাদের ১০০ তম এপিসোডটি স্যুট হবে।


তাহলে বন্ধুরা আজকের মতো এই স্পেশাল এপিসোডটি এখানেই শেষ করছি।পরের অনুষ্ঠান দিনভর সংবাদ কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে তাই আপনারা কোথাও ছেড়ে যাবেন না।আপনাদের আমাদের এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।শুভ রাত্রি,ভালো থাকবেন...


নাম প্রকাশের সাথে সাথে হৈ হুল্লোড় ও কলরবে ফেটে পড়লো পুরো স্টুডিও আর তারসাথে পুরো বাংলা।চারিদিকে দর্শকেরা তখন বিজেতার নাম আর ঠিকানা শুনে নিজেদের মধ্যে কথা বার্তায় ব্যাস্ত।


বিভাসবাবু- ওকে কাট।

নিজে কাট বলার পর তিনি এগিয়ে গেলেন সৌনকের দিকে,দিবাডিয়া এই জায়গাটা কোথায়?নামটা তো প্রথমবার শুনলাম বলে মনে হচ্ছে।


সৌনক একগাল হেসে বলল হেঃ হেঃ ও অসুবিধে হবেনা বিভাসদা।আমরা ঠিক চলে যাবো


বিভাসবাবু- হ্ম্ম তা ঠিক আছে।তাহলে তুমি আর সুপ্রিয় তাহলে চলে যেও।


সৌনকের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো

- মানে? বিভাসদা ,সাদাব যাবে আমার সাথে সুপ্রিয় নয়।


বিভাসবাবু খানিক চুপ থেকে বললেন ওই ছেলেটি একদম বেহেট।বেহেট বুঝেছো কি জিনিস।একফোঁটা কাজ করেনা উল্টে চেটেঙ্গ চেটেঙ্গ কথা।ওর চেয়ে সুপ্রিয়কে নিয়ে যাও ভালো ছেলে


সৌনক এবার চোয়াল শক্ত করে বললো না বিভাসদা।আমার সাথে গেলে সাদাব যাবে।


বিভাসবাবু অবাক হয়ে সৌনককে বেশ কয়েকবার মাথা থেকে পা অব্দি দেখলেন।


বিভাসবাবু- কি ব্যাপার বলো দেখি তোমাদের?কিছু গোপন অভিসন্ধি আছে নাকি যা ও না গেলে হবেনা।আমার তো বেশ সন্দেহ হচ্ছে।


সৌনকের বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো, কিন্তু ও যেভাবে হোক নিজেকে সামলে হো হো করে হেসে বললো কোনো গোপন অভিসন্ধি নেই বিভাসদা।তুমি কিসব যে বলোনা।


আড়ালে বিভাসবাবুকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল ও গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।ও ক্যামেরার কাজ সবচেয়ে ভালো জানে সেটা তুমিও জানো।আর আজ যা হলো তারপর ওকে আমার ওপর ছেড়ে দাও,আমি ঠিক ওকে বুঝিয়ে দেব।তাছাড়া ওর সাথে তোমার অসুবিধে হতে পারে আমার নয়।


বিভাসবাবু খানিকক্ষণ ভেবে বললেন ঠিক আছে তুমি যখন বলছো, তখন তাই হবে।দেখো যত জলদি সম্ভব তাহলে বেরিয়ে পড়বে....


সৌনক নিশ্চিন্ত হলো।


শ্যুটিং শেষ হতেই সৌনক দেখলো সাদাব গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।সে বুঝতে পারলো, আজ সাদাবের মন ভার হয়ে আছে।থাক কাল ওর রাগ ভাঙানো যাবে এখন ঘর যাওয়া জরুরি।অর্ধেক কাজ শেষ এবার বাকিটা ঠিকঠাক হলেই কেল্লা ফতে।


°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°সৌনক বাড়িতে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে নিজের ফ্ল্যাটে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরের দিকে দেখছে।কি অপূর্ব লাগছে আজ এই জায়গাটা।মনের ভেতর একটা প্রচন্ড আনন্দ অনুভব করছে সে।কারণ আজ স্বপ্নপূরণের রাত।নিজের জীবনটা এই কয়েকটা দিনের মধ্যেই বদলে যেতে চলেছে।কিন্তু এমন সময় একটা কথা মাথায় এলো,

আচ্ছা আজ যেন কি বার।মঙ্গল না না, বুধবার না,

ছুটে গিয়ে সৌনক ফোনটা খুলে দেখতেই বুঝলো আজ হলো বৃহস্পতিবার।এই যা......লোকটা বলেছিল সোম, বুধ,শুক্র বার আসতে।তাহলে তো কালকেই বেরোতে হবে।নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।ঠিক দুদিনেই শ্যুটিং সেরে ফেরত চলে আসব।একদম এটাই ঠিক হবে


সিগারেটে ঘন ঘন টান দিতে লাগলো সৌনক,কিন্তু হটাৎ আবার সেই বিশ্রী কাশিটা শুরু হল।খুক খুক করে একটানা কাশিটা হতেই থাকে।সিগারেট টা অগত্যা ফেলে দিয়ে একটু জল খেলো।


সৌনক- উফঃ পারা যায়না।এই এপিসোডটা করেই একটা লম্বা ছুটি নেব আর চেন্নাইয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবো।ঠিক আর ফেলে রাখা উচিত হচ্ছেনা।


তখনই টিরিং টিরিং টিরিং করে ফোনটা বেজে উঠলো।

এত রাতে আবার কে? তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলেই দেখে সাদাব


সাদাব- হেলো।


সৌনক- হ্যা ভাই বল।এই এত রাতে কি ব্যাপার?


সাদাব- মনটা ভালো লাগছিলোনা রে? তাই ফোন করলাম


সৌনক- তা বেশ করেছিস।


সাদাব- তুই একদম ঠিক ছিলি রে।আমিও থাকতে চাইনা এরকম উদন্ড লোকের কাছে।আমিও চলে যাবো দিল্লি।


সৌনক হো হো করে হেসে উঠে বললো তবে মহারাজের মন মানলো শেষে।আমি তোকে আগেই বলতাম এই বিভাসের মতো অপদার্থ লোক যেখানে আছে সেখানে কোনো কাজ জানা লোক থাকতে পারবেনা।নিজের মূল্য বুঝতে শেখ।


সাদাব চুপ করে রইলো


সৌনক- যাই হোক ওসব কথা থাক,আসল কথা শোন। আজ বৃহস্পতিবার ,তো কাল আমরা বেরিয়ে পড়বো নাহলে সোমবার করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার আগে একবার ভিকুর নাম্বারটা ফোন করে দেখে নিতে হবে


সাদাব- কিন্তু আমাকে যে কিছু জিনিস কিনতে হতো,সেটার কি হবে?


সৌনক- কি জিনিস?


সাদাব- ওই কিছু জামা কাপড় এটা সেটা....লম্বা ট্যুর কিনা।


সৌনক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, আমরা দিবাডিয়া যাচ্ছি,ব্যাংকক না।ওতো সাজার কিছু নেই।


সাদাব খানিক লজ্জা পেল সৌনকের কথায়, না না আসলে তা বলিনি।কিন্তু ওই আর কি অল্প কিছু ও তুই ভাবিশনা আমি কিনে নেব সকালে।


সৌনক- ঠিক আছে।কাল সকালে নয়টার মধ্যে তৈরি থাকিস তাহলে।আমি টিকিট বুক করে ফেলছি দুটো স্টেট বাসে বিমাণ্ডুলি যাওয়ার,কেমন?


সাদাব- বেশ।আচ্ছা আজ তাহলে রাখি


সৌনক- গুড নাইট



°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°


পরের দিন সকাল নটার মধ্যে সৌনক হাজির হয়ে দেখে সাদাব আগেভাগেই এসে গেছে।


সৌনক হেসে হেসে এগিয়ে গেলো সাদাবের দিকে,

কি ভাই যাওয়ার আনন্দে কি ঘুমাওনি নাকি?


সাদাব মুচকি হেসে বললো না।আসলে একটু জিনিস কেনার ছিল তাই সকালে বাজার চলে গিয়েছিলাম।তারপর ভাবলাম দেরি হয়ে যাবে তাই তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলাম কিন্তু এসে দেখি তুই আসিসনি।তো আর কি করা যায়।


সৌনক সাদাবের পিঠে কিল মেরে বললো চল তাহলে যাওয়া যাক।


বাসে চেপে দুজনে নিজেদের সিটে বসতেই সাদাব বললো আচ্ছা তুই ভিকুর নাম্বারটায় ফোন করেছিলি?


সৌনক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদাবের দিকে কিছুক্ষন...


একদম ভুলে গিয়েছিলাম তো? দাঁড়া এখুনি করছি


এই বলে সৌনক ফোন লাগালো........বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ফোন ধরে বেশ গম্ভীর গলায় বললেন হেলো কে বলছেন?


সৌনক- আমি সৌনক,জব্বর খবর চ্যানেল থেকে বলছি।এই ফোন নম্বরটা কি ভিকু মাসরার?


ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন মনে হলো ফিসফিস করে কাউকে কিছু বললেন।তারপর কিছুক্ষন পর ভদ্রলোক বললেন ভিকু মাসরা।হ্যা সে তো দিবাডিয়াতে থাকে।তা আপনারা কি জন্য ফোন করছেন....


সৌনক পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতেই ভদ্রলোক হটাৎ করে ফোনটা দিলেন কেটে।


সৌনক এই ব্যাপারটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।সে ফোন ধরে রেখেই একটা গালি দিতেই সাদাব বলে উঠলো আহঃ বাসে আছিস এভাবে আজেবাজে কথা বলিসনা।কি হলো সেটা বলবি তো।


সৌনক- আর কি বলবো.............অশিক্ষিত মূর্খের দল।একটা ভদ্রতা শেখেনি।আমার তো মনে হচ্ছে এত পরিশ্রম সব বেকার হলো বুঝলি।


সাদাব হতাশ হলো কথাটা শুনে।


সৌনক- তবে যাবো আমি নিশ্চই।সে ততরাং এ ভিকু এসে আমাদের নিয়ে যাক কি না যাক।আমি এই গল্পটা টেলিকাস্ট করে দম নেব।


সাদাব চুপ করে সৌনকের দিকে তাকিয়ে রইলো।এদিকে বাসটা তিনবার জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে কলকাতা ছাড়িয়ে ছুটতে শুরু করেছে বিমাণ্ডুলির উদ্দেশ্যে।


মনে অনেক রকম অনিশ্চিত পরিস্থিতির কথা মাথায় আসছে।আচ্ছা ওখানে গিয়ে যদি ভিকুকে না পাওয়া যায় তাহলে,বলে উঠলো সাদাব


সৌনক একটা হাঁফ ছেড়ে বললো ওসব ভেবে লাভ নেই।আমাদের কাজ হলো একটা ফাটাফাটি এপিসোড ব্যাস।সেটা যেভাবেই হোক দেখতে হবে।তারজন্য দরকার হলে যা করা দরকার আমি করবো।এখন এসব ভেবে মাথা খারাপ করিসনা।


হু হু করে বাতাস এসে মুখে লাগছিলো সৌনকের কিন্তু ওর চোখগুলো একদম স্থির হয়ে আছে আজ।সৌনক শুধু ভেবে চলেছে যে কিভাবে সে হিট এপিসোড দিতে পারবে।


বিমাণ্ডুলি প্রায় ঘন্টা খানেকের রাস্তা।বাসের কন্ডাক্টর হাঁক দিলেন বিমাণ্ডুলি যাত্রী নিবাস।যারা আছেন নেমে যান।দুই বন্ধু নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে বিমাণ্ডুলি যাত্রী নিবাসের কাছে নেমে পড়লো।এই খানে জাতীয় সড়ক বেঁকে চলে যাচ্ছে শহরের দিকে।



বাস থেকে নেমেই সৌনক জোর গলায় বলে উঠলো কিসের যাত্রী নিবাস রে এটা।একটাও লোক নেই।ফাঁকা পুরো।আবার দেখো নাম রেখেছে যাত্রী নিবাস,যেন কতনা যাত্রী এখানে এসে রাত কাটাবে।


সাদাব- ভিকু বলেছিল বিমাণ্ডুলি থেকে মানসিনের বাস পাওয়া যায়।কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছেনা যে এই রাস্তা দিয়ে বাস যেতে পারে।এটাতো পুরো উবড় খাবড় পাথুরে রাস্তা।


সৌনক হাঁ করে তাকিয়ে ছিল রাস্তাটার দিকেই কারণ এই কথাটা ওর মাথাতেও এসেছে।


সাদাব- তাহলে এখন কি করবি? আর একবার ফোন করে দেখবি?


সৌনক- বুঝতে পারছিনা।কোনো লোকজন তো দেখছিনা নাহলে জিজ্ঞেস করে নিতাম।আচ্ছা চল একটু হেঁটে ভেতরের দিকে যাওয়া যাক।


সাদাব আর সৌনক এগিয়ে চললো মেঠো পথ ধরে।মানসিন গ্রামের ফলকটা দেখতে পেলেও কোনো জনমানবের চিন্হ কিন্তু দেখা যায়নি।


এভাবে বহুদূর হেঁটে যাওয়ার পর ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়লো।একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে পড়লো দুজনেই।


সাদাব- খুব ভুল হয়ে গেছে ভাই এইরকম অজ গ্রামে এসে।এখন মনে হচ্ছে চাইলেও ফিরতে পারবোনা।


সৌনক ঘাড় নাড়লো।এইরকম পরিস্থিতি আগে হলে হয়তো সৌনক এতক্ষনে বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যোগী হতো, কিন্তু আজ ওকে দেখে ভিন্ন লাগছে।ওর চঞ্চল স্বভাব কেরিয়ারের কথা ভেবে আজ বেশ ধীর স্থির আছে।

তবে সব কিছুরই সীমা আছে। কতক্ষনই বা এইভাবে জঙ্গলের মধ্যে উদ্ভ্রান্তের মতো বসে থাকা যায়।বাস আদেও আসবে কিনা সেটার তো ঠিক নেই।

আরো প্রায় কিছুক্ষন বসে থাকার পরেও যখন কোনো যানবাহন বা মানুষের চিন্হ পেলো না।তখন দুজনেরই মন ভাঙতে শুরু করলো।


সৌনক হটাৎ বলে উঠলো না আর এভাবে বসে থাকা যায়না।কি করবি, ফিরে যাবি?


সাদাব- আর একটি বার ফোন করে দেখ, কি বলে?


সৌনক- না।সে তো দেখলি ফোনটা আগের বার কেমন কথা না বলেই কেটে দিলো।আর নতুন করে কি বলার থাকে বলতো?


সাদাব কিছু উত্তর দিতে পারলোনা।


সৌনক উঠে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো চল ফিরে যাই।এই বলে পিছন ফিরে গটগট করে হাঁটতে শুরু করলো।বন্ধুর স্বপ্নভঙ্গ হতে চলেছে দেখে সাদাবের মনটা ভার হয়ে এলো।তারসাথে বিভাসবাবুর থাপ্পড়ের কথাটা মনে আসতেই ওর মনটাও বেশ উদাস।মনে মনে সাদাব ভাবলো না যেমনটা ভেবেছিলাম তা আর হলোনা।


সৌনক খানিকটা আগে আর সাদাব পিছনে পিছনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে।এমন সময় সৌনকের ফোনটা বেজে উঠলো


সৌনক- হেলো


- হেলো ক্যা সৌনক বাবু বোলচেন।


সৌনক- হ্যা,আপনি কে বলছেন?


-আমি ভিকু,ভিকু মাসরা।আমি এই মাতথক জানতে পারলম আপনারা আইসেছেন।তা আছেন কুথাকে...


সৌনকের মুখের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে দেখে সাদাব বুঝতে পারলো কোনো শুভখবর আছে


সৌনক- আমরা এখন মানসিন গ্রামে দাঁড়িয়ে আছি।তবে এখানে কোনো বাস নেই।


ভিকু- আপনারা কুছু ভাববেন নাই সৌনকবাবু। আমি চলে আইচি।মানসিনের টেলিফোন বুথে আছি, যাচ্ছি ক্যামন।আপনারা ওই যাত্রী নিবাসটায় গিয়ে দাঁড়ান।


সৌনক- আচ্ছা ঠিক আছে।


সৌনকের মুখে হাসি ফেরত এসেছে।তাই সাদাবের আর কারণটা আর বুঝতে বাকি রইলনা।


সাদাব- তা কোথায় দাঁড়াতে বললো?


সৌনক পরিতৃপ্তির সাথে বললো যাত্রী নিবাসে ফেরত চল।







মন্দের দেবী (পর্ব ৪)

© লেখক- দেবদত্ত



রোদের দাবদাহ এখানে কিছুটা কম।চারিদিকে গাছপালায় জায়গাটা পুরো সবুজ হয়ে আছে।বহুদিন পর শহুরে ভিড় থেকে দূরে এক শান্ত নিরিবিলি জায়গায় এসে সৌনক আর সাদাব একটা অসীম তৃপ্তি পাচ্ছিল।


সাদাব- যাই বল না কেন,আমার এই জায়গাটা বেশ লাগছে...


সৌনক একবার মুচকি হেসে সাদাবের দিকে ফিরে বলল রাত হতে দে, যা জঙ্গল দেখছি অপূর্ব পরিবেশের সাথে মশার উৎপাত যে খুব একটা কম হবেনা সেটা বুঝতেই পারছি।

সাদাব প্রত্যুত্তরে হেসে উঠলো


তবে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন ভিকু মাসরার যখন কোনো পাত্তা পাওয়া গেলোনা, তখন দুজনে নির্জন যাত্রী নিবাসটার দাওয়ায় বসে পড়লো।


সৌনক মুখে একটা সিগারেট নিয়ে সাদাবের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো নে তোল


সাদাব- না রে ছেড়ে দিয়েছি।


সৌনক এবার বেশ রসিকতার সুরে বলে উঠলো বিভাসদার চড়টা মনে হচ্ছে মাথাটাতেও আঘাত করেছে।


সাদাব- আহঃ।সবসময়ই একই জিনিস নিয়ে কেন ঠাট্টা করিস বলতো।


সৌনক সিগারেটে টান দিতে দিতে বললো তো কি করবো শুনি।কবি বা সাহিত্যিক তো নই যে গাছপালা দেখে একটা কিছু লিখবো বসে।আর এখানে ফোনটাও বেশ একটা কাজ করছেনা,তাছাড়া চার্জ শেষ হয়ে গেলে যদি না দিতে পারি।তাই তোকে নিয়ে খিল্লি করা ছাড়া আমার সময় কাটবে কিভাবে বলতো


সাদাব এবার হেসে ফেললো


সাদাব- কেন ভিকু মাসরার গল্প শুনে।


সৌনক তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো আর ভিকু।কোথায় যে গেছে কে জানে।এখনো তার টিকিটিও দেখতে পেলাম না।


এরপর অফিসের বিভিন্ন খোশগপ্পে দুজনে মেতে উঠলো।এমনসময়..................


অজ্ঞাতব্যক্তি- বাবুরা কুত থেকে আইসছেন?


সৌনক চমকেই উঠেছিল।এভাবে হটাৎ করে একটা লোক মুখ সামনে চলে আসবে একদম বুঝতে পারেনি তারা।


সাদাব- আমরা রিপোর্টার আছি।এই গ্রামে একটা শুট আছে।


লোকটা ফেলফেল করে শুধু তাকিয়ে রইলো সাদাবের কথাটা শুনে।


সৌনক সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আর বলল আচ্ছা এই দিবাডিয়া গ্রামটা কোন দিকে বলতে পারবেন।

লোকটা গ্রামের নামটা শুনে সব দাঁত গুলো বের করে খিলখিল করে হেসে উঠলো।


সৌনক (বেশ বিরক্তির সুরে)- এতে এত হাসার কি আছে শুনি?


অজ্ঞাতব্যক্তি- খেমা করবেন বাবু।আপনারা ভুল জায়গায় দাঁড়ায়ে আছেন।এদিকে না গিয়ে ওই আগে দেখুন একটা বট গাছ দেখতে পাচ্ছেন।


সৌনক দূরে তাকিয়ে বলল হ্যা পাচ্ছি


অজ্ঞাতব্যক্তি- তা ওই বট গাছের ধার দিয়া হ্যাটে হ্যাটে চলে যান।


সাদাব- ওই দিকটায় তো কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হচ্ছেনা।জঙ্গল আর ঝোপঝাড় তো পুরো।এই ভাই তুই দাঁড়া ভিকু মাসরা আসছে,ও এলেই চলে যাবো।



ভিকু মাসরার নাম শুনেই অজ্ঞাত লোকটা পুনরায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।


অজ্ঞাতব্যক্তি- ও আপনারা ভিকুর অতিথি আছেন।এ তাহলে তো আমার নিজের অতিথি আপনারা।আসুন বাবুরা আমি আপনাদের নিয়ে যাই।


বেশ অবাক লাগলো দুজনের।তবে সবার মুখেই শোনা যায় যে গ্রামের মানুষের অথিতিয়তা অনেক অনেক বেশি হয়।হতেই পারে এই লোকটাও গ্রামেরই লোক।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে একে অপরের দিকে ইশারা করে সৌনক বললো, একটু দাঁড়ান একটা ফোন করে বলে দি ভিকুকে?


ফোন নিয়ে একটু দূরে চলে গেল সৌনক।সাদাবের চোখ তখন শুধু লোকটার ওপর।লোকটা খুবই রোগাটে পরনে একটা হাটু অব্দি ধুতি আর মলিন সাদা পাঞ্জাবি।তবে যে জিনিসটা সবচেয়ে অবাক হওয়ার তা হলো লোকটার চাউনি। কেমন যেন অস্বস্তিকর।একটানা পলক না ফেলে লোকটা দেখে চলছে সৌনককে।আর মাঝে মাঝে একটা করে বিশ্রী রকমের ঢোক গিলছে আর হাসছে।হটাৎ করে লোকটা চোখ ফিরিয়ে সাদাবকে দেখে বললো


-কি দ্যাকছেন বাবু..


সাদাব একদমই চমকে উঠে।বলে কিছুনা,তুমি ওমন ভাবে কি দেখছো।


অজ্ঞাতব্যক্তি- কুছুনা।বহুদিন হলো এই গ্রামে কেউ বাইরের আসেনাই।আপনারা বুঝি শহরের লোক।


সাদাব- হ্যা।


ফোনে কথা বলতে বলতে সৌনকের আবার কাশিটা শুরু হয়েছে।খুক খুক করে সে কেশে চলেছে।


সাদাব ব্যাগ থেকে জল বের করে এগিয়ে দিল সৌনককে আর পিছন ঘুরে তাকাতেই ওর রক্ত হিম হয়ে গেল দেখলো লোকটা কেমন অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট চাটছে,যেন কিছু খুবই সুস্বাদু খাবার দেখেছে।


সাদাব রেগে মেগে এগিয়ে গিয়ে বলল এই শোন কি ব্যাপার বলোতো তোমার,কি হয়েছে টা কি?


কিন্তু অজ্ঞাতব্যক্তির তাতে কোনো ভুরুক্ষেপ নেই,তারপর হটাৎ করে মুখ ঘুরিয়ে সাদাবকে বললো আপনার বন্ধুর তো রোগ হয়েছে।


সাদাব- কি ফালতু বকছ। দূর হও এখান থেকে


অজ্ঞাতব্যক্তি খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো,খেমা করেন কত্তা।আসলে রোগ উনার খুব প্রিয়............তারপর কিছু না বলেই আবার হাসতে শুরু করলো।


সাদাব লোকটাকে কিছু বলবে তার আগেই সৌনক বলে উঠলো টেলিফোন বুথের মালিকের সাথে কথা হলো, সে বলল ভিকু বেরিয়ে গেছে ,একটু অপেক্ষা করতে বললো আমাদের।


অপরিচিত সেই লোকটা তখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।সাদাব এবার যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলল কি হলো তুমি এখানে দাঁড়িয়ে রইল কেন? বললাম তো যাবোনা।যাও এখন এখান থেকে।


অজ্ঞাতব্যক্তি কিন্তু খিকখিক করে আবার হাসতে থাকলো


সৌনক- পাগল না কি? এই বলছেনা যাও এখান থেকে?কানে কি কম শুনতে পাও।


কিন্তু এরইমধ্যে দূর থেকে একটা হুউউড়া, হুউউড়া শব্দ শোনা গেল,আর মুহূর্তের মধ্যে সেই লোকটা আঁ আঁ করে আর্তনাদ করতে করতে ছুটে চললো বটগাছটার দিকে।

এই ঘটনাটার জন্য দুজনে একদমই তৈরি ছিলোনা।তারা তাকাতেই দেখলো দূরে ভেসে আসা শব্দটা একটা লোকের,আর সে দ্রুত তাদেরই দিকে এগিয়ে আসছে।তবে লোকটাকে একদম সামনে থেকে দেখে তাদের বুকটা ছেৎ করে উঠলো।

অবিকল আগের লোকটার মতো দেখতে .......এতটা মিল কিভাবে হতে পারে। সৌনক আর সাদাব নিস্ফলক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে চেয়ে আছে, মুখ দিয়ে তাদের কোনো কথা বের হচ্ছেনা।

আর দেখে মনে হলো আগন্তুক বেশ উদ্ভিগ্ন,ছুটে যাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কথা বললো তারপর সৌনক আর সাদাবের দিকে তাকিয়ে সাবলীল ভাবে বললো আমাকে খেমা করবেন বাবুরা,ওই লোকটা কি বলছিল?


সৌনক- কে ছিল ওই লোকটা? আর তুমি কে?


আগন্তুক একগাল হাসলো তবে হাসিটাও আগের লোকটার মতোই,যেন মনে হচ্ছে কোনো আয়নার প্রতিচ্ছবি।


আমি আজ্ঞে ভিকু মাসরা।


সাদাব- তাহলে ঐ লোকটা কে ছিল,তোমার দাদা নাকি? অবিকল তোমার মতোই দেখতে


ভিকু ওর মুখটা সাদাব আর সৌনকের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো উনার চর বাবুরা।উ মানুষ লয়।


সৌনক হতভম্ব হয়ে বলল মানে? উনিটা কে?


ভিকু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো,চলেন বাবুরা আগে গ্রামে নিয়ে যাই আপনাদের।এখানে রাতবিরেতে থাকা মোটেই সুবিধের লয়।


সাদাব ভিকুর হাতটা চেপে ধরলো।


সাদাব- কিসের অসুবিধে না বললে যাবোনা। তাছাড়া কি প্রমান আছে যে তুমি ভিকু মাসরা?


ভিকু ওর লালচে দাঁতগুলো বের করে খেঁক খেঁক করে হেসে উঠলো।তারপর ধুতির কোঁচা থেকে একটা ব্লেড বের করে চিরে ফেললো নিজের হাত আর সেই কাটা হাতটা থেকে টপটপ করে রক্ত মাটিতে পড়তে শুরু করলো।


সৌনক আর সাদাব একযোগে বলে উঠলো পাগল নাকি তুমি?


ভিকু- বাবুরা এ কিছুনা? এই গ্রামে এমন অনেক জিনিস আপনারা দ্যাকবেন যা আজ অব্দি চোখে দেখেন নাই।তবে বলে রাখি রক্ত না দ্যাকে কাউকে বিশ্বাস করবেন লাই।এমন কি নিজের বন্ধু কেউ।(আবার বিশ্রী ভাবে সে হেসে উঠলো)


কয়েক মিনিটের মধ্যে মনে হলো সময়টা যেন কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।সূর্যের কিরণ হটাৎ করে ক্ষীণ হয়ে এসেছে।


ভিকু- চলেন বাবুরা চলেন।আর দাঁড়াবেন লাই।নাহলে আপনারাই ভোক্তা হয়ে যাবেন।


রক্তচাপ যে নিমেষে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে তা আর বলাই বাহুল্য।সাদাবের একবার মনে হলো বেশ তো ছিলাম শহরে,পালিয়ে যাই এখুনি।তবে সৌনক যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভিকুর পিছু নিয়েছে।অগত্যা মনের আশা মনেই রয়ে গেল সাদাবের।



ভিকু দ্রুততার সাথে আগে আগে এগিয়ে যাচ্ছে তার পিছনে সৌনক ও তার একটু পিছনে সাদাব।প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছলো একটা পুকুরের ধারে।পানপাতায় পুরো পুকুরের জল যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আর বিকেলের ক্ষীণ আলোয় পুকুরটাকে একদম একটা সবুজ মাঠের মতো দেখাচ্ছে।


সৌনক- আচ্ছা ভিকু,এটাই কি ততরাং


ভিকু ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে মাথা নাড়লো।


সাদাব একটু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সৌনকের কানের কাছে বললো ভাই আমাদের যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে তো।আর ওই লোকটাই বা কে ছিল তাহলে?


সৌনকের মনেও এই প্রশ্নটাই চলছিল তাই সে হালকা গলা ঝেড়ে বলল ভিকু ওই লোকটা কে ছিল তুমি বললেনা কেন?


ভিকু পুকুরের পাড় দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লো।


ভিকু- সব বলবো সৌনকবাবু।আপনি গ্রাম দিকে চলেন।এখন এখানে দাঁড়ায় থাকল্যে ঠিক হবেক নাই।উনি আমাদের সবসময় দ্যাকছেন?


সৌনক- এই উনিটা কে?


ভিকু নিজের জীব কামড়াল কিন্তু কোন উত্তর দিলোনা,বরং সে আরো বেশি জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করলো। আকাশের দিকে তাকাতে আরো বেশি অবাক লাগল সৌনকের,যেন এই কয়েক মিনিট আগেই রোদ ছিল আর এখুনি যেন সন্ধ্যে নামতে চলেছে।


সাদাব ,সৌনকের হাত ধরে টেনে বললো আমার কেন জানিনা এদের ঠিক লাগছেনা ভাই।এরা কোনো জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত নয় তো।ভয় দেখিয়ে যদি আমাদের কিডন্যাপ করে নেয়?


সৌনক এই কথাটা শুনে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো হ্ম্ম, সাদাব মন্দ বলেনি কথাটা।হতেই পারে।সাংবাদিক দের অপহরণ করে কাউকে যদি ছাড়াতে চায়।ঠিক........


সৌনক থেমে গেলো যেতে যেতে।সে বলে উঠলো ভিকু আমার কিন্তু তোমাকে ঠিক লাগছেনা? তুমি কিন্তু কিছুই আমাদের বলছোনা?


ভিকু যেতে যেতে বলে উঠলো নিশ্চিন্তে আমায় দ্যাখে আসতে থাকেন সৌনক বাবু। এই মাসরারা কোনোদিন কারোর খেতি করে নাই।বরং আপনারা যাতে করে ভালো ভাবে বাঁচেন তাই করে আয়সেছে।তবে বলে রাখি যদি এখানে দাঁড়ায়ে যান তো প্রাণে মরবেন।কেউ আপনাদের বাঁচাতে লারবেক?


ভিকু কথাটা বলে সামনে হনহন এগিয়ে চললো,তবে জায়গাটার চারিপাশে তাকিয়ে দেখে দুজনের একটা শিরশিরানী অনুভব হচ্ছে।


সৌনক বলে উঠলো সাদাব ,আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে এই নিস্তব্দ জায়গাটা আসলে কথা বলতে চায়, তবে কোনো মায়াবী শক্তির বলে সেটা অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

তোর মনে হচ্ছেনা এই গুমোট হয়ে থাকা নিস্তব্ধতাটা যেন গ্রাস করেছে প্রকৃতির স্বাভাবিক শব্দকে।সৌনক আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই একটা শব্দ শুনতে পেল, ঠিক যেন ঢাকের আওয়াজের মতো।

ডুম ডুম দুদুম, 

ডুম ডুম দুদুম,

ডুম ডুম দুদুম,

ডুম ডুম দুদুম। 

সাদাব- এটা কিসের শব্দ।


ভিকু আতঙ্কের সাথে বললো জলদি পা চালান বাবুরা,এই শব্দ শেষ হওয়ার আগে গ্রামে না ঢুকলে পারলে আর বাঁচবেন নাই।


ভিকুর মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে আর প্রশ্নের কোনো সুযোগ রইলনা।দুজনে ছুটে চললো ভিকুর পিছু পিছু।রাস্তা যে কত দূর তা তাদের জানা নেই।তবে যত বেশি অন্ধকার নেমে আসছে ততই একটা অনুভূতি ক্রমশ বাড়ছে।

আর সেটা হলো এই জঙ্গলটা যেন কথা বলতে চাইছে।তারসাথে একটা ফিসফিস আওয়াজ যেন গমগম করছে আর কান পেতে শুনলে কেন জানিনা মনে হচ্ছে কেউ যেন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ,আর বলছে আয় ভোক্তা হবি আয়।








মন্দের দেবী (পর্ব ৫)


©লেখক-দেবদত্ত

শেষের দিকের বেশ কিছুটা রাস্তা তাদের প্রায় অন্ধের মতোই চলতে হলো ,কারণ গাছপালা এখানে এতটাই ঘন যে আলোর চিন্হমাত্র পাওয়া যায়না।এককথায় বলা যেতে পারে ঢাকের শব্দের মতো সেই আওয়াজটাকে অনুসরণ করেই তারা এসে পৌঁছলো দিবাডিয়া গ্রামে।


তবে গ্রামে ঢুকেই তারা বুঝতে পারলো এই গ্রাম অন্য সব জায়গায় থেকে ভিন্ন।কেমন জানি অদ্ভুত ধরণের গঠন এই গ্রামটার,ঠিক গ্রাম বলাটাও ভুল হবে। মনে হচ্ছে যেন ওই খান কুড়ি কুঁড়ে ঘর গোলাকার ভাবে ঘিরে রয়েছে একটা ভাঙা ধ্বংসাবশেষকে।আর সেখানে ওই ধ্বংসাবশেষটাকে ঘিরে গ্রামের সব কচি -কাঁচা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ- বৃদ্ধা হাত জোড় করে একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে।

একটু দূরে চোখ যেতেই তারা দেখতে পেল একটা লম্বা চওড়া লোক বড় একটা ঢাকের মতোই বাদ্যযন্ত্রকে দুটো অদ্ভুত ধরণের কাঠি দিয়ে বাজাচ্ছে।নিখাদ সাদা রং এর দুটো কাটি,কিন্তু খুবই অদ্ভুত ধরণের গড়ন কাঠিগুলোর।

সৌনক আর সাদাব নিস্ফলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল সবার দিকে, এর আগেও তারা বহু জায়গায় রিপোর্টিং করেছে,কিন্তু এমন জায়গা ও মানুষের আদবকায়দা তারা আগে কখনো দেখেনি।


সাদাব- ভাই।এই ভাষাটা কি?বাংলা বলে তো মনে হচ্ছেনা।

কিন্তু সৌনক তখনো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে সামনের দিকে। সাদাবের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ওর কাছেও।সাদাব খোঁচা মারতে সে বলল,

-বুঝতে পারছিনা রে? দাঁড়া শেষ হোক ভিকুর কাছেই সব জানবো।


ভিকু দেখি তখন ওদের দুজনকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।


এই রকম বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একজন বৃদ্ধ,দেখে মনে হলো পুরোহিত গোছের বেরিয়ে এলো সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে।আর তখনই আবার সৌনকের বিষম লাগলো।সে আবার খুক, খুক খুক করে কেশেই চলেছে।


বৃদ্ধ উল্লসিত হয়ে ঘুরে তাকালো সৌনকের দিকে আর

ভোক্তা বলে জোরে চিৎকার করে উঠলো।আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সকলেই ওদের দিকে ঘুরে তাকালো।সাদাব এই সহসা পরিবর্তন দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু তার আগেই ভিকু ছুটে গিয়ে সৌনকের সামনে দাঁড়িয়ে বললো না উ আমার অতিথি আছে।ও ভোক্তা লয়।যা আমরা বলয়েচি তাই হবেক।তবে উনাকে ছেড়ে দিন।


সাদাব দেখলো সেই বৃদ্ধ নিজের জীব চাটছে তখন।ঠিক সেই রাস্তার লোকটার মতো।লোকটার ওমন ক্রুর দৃষ্টি দেখে সাদাবের একবার মনে হলো এই একশো এপিসোডটা যত দ্রুততার সাথে শেষ করা যাবে ততই মঙ্গল।


ভিকু এরপর চিৎকার করে ওদের ভাষায় কিছু একটা বলার পর দেখা গেল সবাই যে যার ঘরে চলে গেল।


ভিকু- আসেন বাবুরা।আপনারা মাফ করবেন।উয়ারা কিছু জানেক নাই তাই না বুঝে যা খুশি বলছিলো।


সৌনকের বিষম লেগে চোখ মুখ তখন লাল হয়ে গেছে।


সৌনক- ভিকু কি হয়েছে বলবে কি?


ভিকু একটু বাঁকা হাসি হেসে বললো আগে ঘরে চলুন কিছু খান তারপর না হয় বৌলবো...........



সাদাব- না না ওসবের কোনো দরকার নেই।আমরা খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছি।তুমি বরং বলো কি হয়েছে?


সৌনক বললো ঠিক।ভিকু চলো ওই যে খাট দেখছি পাতা আছে, চলো ওখানে বসেই শোনা যাক।


ভিকুর অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও ওরা ভিকুকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো নারকোল দড়ির খাটটায়।অগত্যা

ভিকু একবার এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বললো বাবুরা শুনুন তাহল্যে।


- আজ থেকে প্রায় কয়েক'শ বছর আগে অব্দি এই মাসরারা ছিল বাস্তুহারা উপজাতি।হরেক রকমের পশু গুলান লিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে ব্যারাত, কুথাকেও একজায়গায় স্থির হতক লাই।তারপর এমনি করতে করতে তারা এসে পৌছালো এই দিবাডিয়াতে.......(এই বলে একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো ভিকু)তবে এখানকে আসার পরই এক ভয়ানক রোগ দিক্যা দিলো।


সৌনক- কি রোগ?


- জানিক লাই বাবু ।তবে উ রোগে গ্রামস্যুদ্ধা উজাড় হয়ে জেছিলো।আমরা তো আর আপনাদের মতক লৈ।ও হাকিম,বদ্দি আমাদের চলেক লাই।


সাদাব- রোগ হলে তো ডাক্তারকে ডাকতেই হয় ভিকু?তা এই রোগটা কত বছর আগে হয়েছিল


ভিকু- আমি নিজে দেখি লাই বাবু, তবে ওই ধরুন বছর আশি আগে।আমার বাপটা দেখয়েছিলো?


সৌনক ফোনটা বের করে নোটপ্যাডে ছোট করে লিখতে শুরু করলো।


সৌনক- তুমি ইন্টারনেট মেল এসব শিখলে কি করে?


ভিকু হেঃ হেঃ করে হেসে উঠলো।ও আমি জানি লাই বাবু। তবে মানসিনে আমার এক বন্ধু থাকে সে এটা করে দিয়েছে আমার লগে।


সৌনক এই কথাটা শুনে খানিক ইতস্তত করলো।


সৌনক- তুমি কি জানো এই প্রতিযোগিতার জন্য তুমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে।কিন্তু তোমার বন্ধু করেছে বলছো তাহলে তো তুমি আমাদের চ্যানেলের শর্ত ভেঙেছ দেখছি? এখন তো বেশ মুশকিলে ফেললে তুমি।


সাদাব সৌনককে বলে উঠলো আঃ।তুই জায়গাটা একবার দেখ। এই সব মানুষ যদি পুরস্কার না পায় তাহলে টাকাটার কোনো মূল্য থাকেনা।এই যে ভিকু শোন এই বার থেকে বলবে তুমিই মেল করেছ কেমন।কাল ভিডিও যখন করবো তুমি সৌনককে বলবে তুমি নিজে মেল করেছিলে।অন্য কিছু বললে টাকাটা আর পাবেনা।


ভিকু আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো।কাল আর কি সুযোগ পাবো বাবুরা?


সৌনক ভ্রু কুঁচকে বললো কাল পাবেনা কেন?


ভিকু গলা নামিয়ে বললো দেখতেই পাবেন? তা শুনেন বাকি কথা

- তো সেই বৎসর অনেক লোক আমাদের মরে যাচ্ছিল রোগে।এমন রোগ আমাদের কেউ কোনোদিন দেখে নাই ইয়ার আগে।যার হছিল গায়ের সব চামড়া ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিল।কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের সমাজের হাতে গুনা কয়েক জন বেঁচে ছিল আর।এমন সময় আমরা দেখা পেলাম উনার


সৌনক- উনি তা কে বলোতো? অনেক বার শুনলাম এর নাম?


ভিকু গলা নামিয়ে বললো ধীরে বলুন সৌনক বাবু এত জোরে বলবেন নাই।

- তো আমরা রোগে প্রায় শেষ হওয়ার মুখে ছিলাম এমন সময় এক পাগল্যা সাধু এলেন আমাদের কাছে।আমাদের অবস্থা দেখে উনি এক বিশাল যজ্ঞ করলেন।আর যা দেখলেন তা দেখার পর উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।আমার বাপ,কাকারা ওই সাধুকে অনেক সেবা করে সুস্থ করে তুলল।আর আমাদের সেবায় উনি খুশি হয়ে খুলে বললেন এই রোগের কারণ,

উনি বললেন এই রোগ কোনো যা তা রোগ লয়।এই রোগ হলো ঊর্ধির আশীর্বাদ।


একসাথে সৌনক আর সাদাব বলে উঠলো এই ঊর্দ্ধি কি?আগে তো শুনিনি


ভিকু কিছু না বলে ধ্বংসাবশেষটার দিকে তাকালো।এই যে ভাঙা চুরা পাথরের ঘরটা দেখছেন এই ঘর হলো ঊর্ধির।ই কোনো দেবী লোয় বাবু।ই আসলে অপদেবী।পাগল্যা সাধু বলেছিল এই জায়গাটা আগে যারা ও তন্তর মন্তর করত তাদের জায়গা ছিল।আর তাদেরই কোনো এক ইস্ট দেবী ছিল এই ঊর্ধি।এই দেবী আসল্যে রোগ ছড়ায়।আর ইয়ার পূজা শুধু এই জন্য করতে হয় যাতে করে দেবী আশীর্বাদ না করে।.......এই বলে মুখের ভাষা হারালো ভিকু


সৌনক- হুম।অপদেবতার নাম শুনেছি তবে অপদেবীর নাম আজ অব্দি শুনিনি।আচ্ছা তো এই দেবীর খোঁজ পেলে কি করে?


ভিকু ঈষৎ হেসে বললো আমরা বাবু যেখানেই যেতাম সেখানেই বাঁশ আর কাঠ দিয়ে ঘর বানাতাম।এখান টায় সেরকমই কিছু কর্ত্যে গিয়ে মাটি খুঁড়ে এই দেবী মূর্তিটা বের হোয়্যে যায়।


সৌনক- আচ্ছা কেমন দেখতে ? মানে নিশ্চই কোনো মূর্তি আছে ভেতরে


ভিকু মাথা নাড়লো।জানিনাই বাবু।নিজের চোখে দেখি লাই।বাবার মুখে শুনয়েছিলাম যে মাটিতে নাকি একটা পাথর পুতা আছে।আর আধটা বেরাই আছে।কালো পাথরের মূর্তি আর একটা চোখ আঁকা।পিঠে একটা যেন বস্তা লিয়ে থাকে।


সৌনক চোখ গুলো বড়ো করে বললো আচ্ছা যে বৃদ্ধ লোকটি পুজো করছিল সামনে,তিনি কি এই ব্যাপারে কিছু জানেন।


ভিকু- আমাদের কোনো পুরোহিত হয় লাই।তবে এই দেবীর পূজা যে কেউ কর্ত্যে লারবেক,তাই আমরা সকলে মিলে ইনাকে এনেছি।ইনি আসলে পাগল্যা বাবার পরিচিত।


সৌনক- আচ্ছা।তো উনি আরো কিছু বলতে পারবেন কি এই ব্যাপারে?আর এই যে মূর্তিটা খোঁড়াখুঁড়ি করে বের হলো আর তার জন্য বলছো যে এত কষ্ট ।তো তোমরা এতদিন এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যাওনি কেন?


ভিকু,সৌনকের চোখে চোখ রেখে বললো হ বাবু ঠিক বলয়েছেন আপনি।

আমরা তারপর থেকে আর কুথাকেও যেতে পারি লাই।এই দেবীর জন্যে আমরাও আজ এত বছর এই গ্রামে আটক হয়ে আছি।

তারপর মাথা নিচু করে বললো তবে চেষ্টা যে করি লাই তা লয়।কিন্তু..............


সৌনক উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু কি?


ভিকু- যেতে পারি লাই।যেই গেছে আর বেঁচে ফিরে লাই।ঊর্ধির হাত থেকে পালানোর কোনো উপায় লাই বাবু।


সৌনক- কিভাবে বুঝলে কেউ বেঁচে ফিরে নি?


ভিকুর মুহূর্তের মধ্যে পূর্বের ঘটে যাওয়া কোনো দুঃস্বপ্নকে মনে করে শিউরে উঠলো।


ভিকু- আমার ভাইটা চেষ্টা কোরেছিলো বাবু।


সৌনক- তো?


ভিকু- ঘর থেকে পালানোর দিন সাতেকের মদদে উয়ার পঁচা গলা শরীরটা ততরাং এ পাই।


সৌনক আর সাদাবের গলা শুকিয়ে এলো কথাটা শুনে।অলৌকিক জিনিস নিয়ে দুজনে শো করলেও এসবে তারা মোটেও বিশ্বাস করতোনা।কিন্তু আজ এই ছমছমে পরিবেশটাই হোক কিংবা ভিকুর মুখে এই মাসরাদের ইতিহাস।তাদের মনে একটা ভয়ের সঞ্চার করছিলো।

তবে একটু স্বাভাবিক হয়ে সৌনক,ভিকুকে বলে উঠলো

-শোনো সবটাই তোমাদের মনের বিশ্বাস।এসব বাস্তবে কিছুই হয়না বুঝলে তো।


ভিকু সৌনকের হাতটা চেপে ধরে বলল আপনি জানেন লাই বাবু।সব যদি এতটাই সহজ হতো তাহলে আপনারা আমরা মরা ভাইটাকে দেখতে পেতেন নাই।


নিমেষে দুজনের যেন শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল।মানে কি বলতে চাইছো তুমি


ভিকু গম্ভীর ভাবে বলে উঠলো বাবু যে ঊর্ধির থেকে পালানোর চেষ্টা করে,সে রোগে মরে।তবে সে মরেউ শান্তি পায় লাই ,ঊর্ধির চর হয়ে রয়ে যায়।আর সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই এই গ্রামের সীমানার বাইরে ওইরকম ঘুরতে থাকে ভোক্তা খুজার জন্যে?


সাদাব অনেকক্ষন চুপ করে সব শুনছিলো এবার সে বলে উঠলো আচ্ছা এই ভোক্তা জিনিসটা কি?


ভিকুর চোখ গুলো ছলছল করে উঠলো।সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো ভোক্তা মানে ঊর্ধির আহার।


সৌনক চমকে উঠে বললো খাবার মানে।নরবলি দাও নাকি।


ভিকু হেসে উঠলো।না বাবু বলি দিতে হয়নাই।ঊর্ধি নিজের ভোক্তাকে রোগ দিয়ে আশীর্বাদ করে।আর ভোক্তার শরীর ধীরে ধীরে গলে ওই ঘরটার মাটিতে মিশে যায়।

কথাটা বলার পর ভিকু নিচের দিকে তাকিয়ে মুখ গুঁজে বসে রইল কিছুক্ষন।আর সৌনক আর সাদাব তখন একদম পাথরের মত নিথর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ভিকুর দিকে।


শরীরটা পুরো ছমছম করে ওঠে সৌনকের।সে একবার ভাঙ্গা ঘরটার দিকে তাকিয়ে বলে তাহলে এত বছর ধরে তোমরা এই ভাবে বেঁচে আছি নাকি?


ভিকু একবার ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলল হ্ম্ম।এই ভাবে আশিটা বছর আমরা কাটাইছি।ঊর্ধির জন্যে আমরা প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে ভোক্তা হয়েছি প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে, আর তার বিনিময়ে ঊর্ধি আমাদের সকলকে একসাথে আশীর্বাদ করে নাই।


সৌনক পুরো চুপ করে কথাগুলো শুনছিলো, হটাৎ ভিকু সৌনকের হাতটা ধরে বলে উঠলো তবে আমাকে এবার বাঁচান বাবু।কালকে অমাবস্যা আছে কিন্তু আমি চাই লাই আমরা ছেল্যা ভোক্তা হোক।উয়ার বয়স বড়ই কম।উয়ার জীবন যেন আপনাদের মতোই হয়ে উঠুক আমি শুধু এই টুকু চাই।আপনারা আমি যে টাকাটা পাবো সেটা লিয়ে লিন আর দয়া করে সাথে আমার ছেল্যাটাকে সাথে লিয়ে এখান থেকে চল্যে যান।


সৌনক ঘাবড়ে গেল, সে আমতা আমতা করে বলে উঠলো মানে আমি কি কিভাবে বাঁচাবো?


ভিকু- আপনি যেভাবে হোক আজকে সব ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে কালকে চলে যান শহরে।সেখানে সবাইকে দেখান আমাদের কষ্ট।আপনারাই আমার শেষ ভরসা সৌনকবাবু।তবে আপনি আমার ছেল্যাটাকে বাঁচান।

এই বলে ভিকু হাত ধরেই হো হো করে কাঁদতে শুরু করলো।

সৌনক একদৃষ্টে ভিকুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো আমি চেষ্টা করবো ভিকু।


সৌনক- এই দেবীর নাম কি দেওয়া চলবে?


ভিকু ইতস্তত করে বললো ঊর্ধির নাম শুনলে গ্রামের লোক ক্ষেপতে পারে।আপনি বরং অন্য কিছু বলে ছবি তুলুন,আর একটু সাবধানে কাজ করবেন যেন কেউ বুঝতে না পারে। যে আমাদের পূজা করে উ খুব বদমাইশ লোক আছে।আমার ছেল্যাটার প্রতি উয়ার খুব লোভ?


সাদাব- বুঝলাম না।একটা ছোট ছেলের প্রতি কিভাবে কারুর লোভ হতে পারে।


ভিকু সাদাবের দিকে ঘুরে বললো হয় বাবু হয়।কারণ ভোক্তার রক্ত খেলে তার আর রোগ হয় লাই আর সে মরেও লাই।


সৌনক চমকে ওঠে।

- বলো কি? ওই লোকটা র...রক্ত খায়।(কথাটা বলতে গিয়ে সৌনক ততলিয়ে ওঠে)


ভিকু- হ বাবু।ও আজ প্রায় একশো কুড়ি বছর বেঁচে আছে।আর উ জবে থেকে পূজা করছে ওমনি দেখতে রয়ে গ্যেছে। তবে উ এবার কেনে আমার ছেল্যাকে ভোক্তা করতে চায় আমি বুঝেছি।


সৌনক- কেন?


ভিকু- উ আসলে দেখতে চায় ছোট ছেল্যার রক্ত খেলে উয়ার বয়সটা কমছে কিনা।


সৌনক মনে মনে ভাবল শহরের থেকে মাত্র ঘন্টা পাঁচেক দূরে এমন একটা জায়গা রয়েছে যেখানে এখনো এমন সব ঘটনা ঘটছে। যা শুনলে কোনো সাধারণ মানুষ মোটেই বিশ্বাস করবেনা।তবে কেন জানিনা আজগুবি বলে মনে হচ্ছেনা ভিকুর কথা গুলো?মনে একটা কথাই বার বার উকি দিচ্ছে যে সত্যি কি এমনটা হয়......



সৌনক, সাদাবকে বললো ঊর্ধির নাম নেওয়া যাবেনা।কিছু নাম ভাব তাহলে।কারণ গ্রামের বাকিরা যেন ভাবে আমরা শুধু ঘুরতে এসেছি কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে নয়।


সৌনক- আচ্ছা ভিকু তুমি কি বলেছ।আমরা কি জন্য এসেছি?


ভিকু হেসে বললো আমি বল্যাছি আমার মানসিনের বন্ধু বুধার মাসতুতো ভাই আপনারা।তাই আমি আপনাদের আমার গ্রাম দ্যাখাতে লিয়ে আইছি...



সৌনক বেশ খুশি হয়ে বলল বাহঃ।তুমি যে সত্যি খুব বুদ্ধিমান সেটা বোঝাই যাচ্ছে ভিকু।


সাদাব নাম কিছু ভাবতে পারলি।


সাদাব- ভিকুর মেলে টাইটেল ছিল যে অভিশপ্ত গ্রাম।ওটা দিলে কেমন হয়


সৌনক কিছুক্ষন মাথা চুলকে নিয়ে ঘাড় নেড়ে বললো না।ঠিক জমছে না।তারপর উঠে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলো।



বেশ কিছুক্ষন পায়চারি করার পর হটাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো সাদাব জলদি ক্যামেরাটা অন কর একটা বেশ নাম বের করেছি


সাদাব ক্যামেরাটা সৌনকের দিকে ফোকাস করতেই সৌনক বলতে শুরু করলো

নমস্কার বন্ধুরা, আমি আপনাদের প্রিয় হোস্ট সৌনক সকলকে স্বাগত জানাই আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান লোকচক্ষুর আড়ালের একশো এপিসোডে।বন্ধুরা আমরা এসে গেছি দিবাডিয়া গ্রামে যেখানে আমাদের অনলাইন কম্পিটিসনের বিজেতা ভিকু মাসরাকে আমরা পেয়ে গেছি।তবে আপনারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন এই এপিসোডের নাম কি হবে তাই না।তো বন্ধুরা আমি মনে করি, এই এপিসোডের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অলৌকিকতা,রহস্য ও ভীতি।কারণ এই এপিসোড হলো এক অলৌকিক শক্তির অধিকারিণীকে নিয়ে।ইনি কোনো শুভ শক্তি নন,না ইনার নাম ইতিপূর্বে কোনো গ্রন্থে আমরা পেয়েছি।একদম আমাদের শো'য়ের নামের সাথে মানানসই, এই দেবীও আসলে রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে।সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এখানে উনার নাম মুখে আনাটাও অন্যায়।তাই আমরা এখানে মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত না করে এই এপিসোডের নাম রেখেছি মন্দের দেবী।


অবাক হচ্ছেন তাই না,তো বলে রাখি অনেক অবাক হতে এখনো বাকি তাহলে। কারণ এর পরের এপিসোডে আপনারা জানতে পারবেন ইনি মন্দের দেবী কেন।ততক্ষণ নিজেদের মধ্যে জানতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে বজায় রাখুন আর হ্যাঁ সুস্থ থাকুন।কারণ আমি এখানে এসে জানতে পারলাম ইনি নাকি রোগ ছড়ান।

তো আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি পরের এপিসোডে দেখা হচ্ছে।শুভ সন্ধ্যা।











[পাঠকদের প্রতি: আমি গ্রাম্য বাংলার ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে বেশ অপটু ,কিন্তু এই গল্পের জন্য গ্রাম্য বাংলার টান আবশ্যিক ছিল।তাই সেই বিষয়ে ত্রুটি মাফ করবেন।অনেক ধন্যবাদ সবাইকে পড়ার জন্য।মতামত দেবেন কেমন লাগছে]

মন্দের দেবী (পর্ব-৬)

© লেখক- দেবদত্ত





পরের দিন ভোরে


সৌনক- সাদাব ,এই সাদাব


সাদাবের ঘুম তখনো ভাঙেনি, সে আধ চোখ খুলে জড়ানো গলায় বলল কি হয়েছে,এত ভোরে উঠে পড়লি কেন?


সৌনক- জলদি ওঠ।বেরোতে হবে


শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাদাব বিছানা ছেড়ে ওঠে।চোখ মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে সৌনক বাগপত্র নিয়ে তৈরি।


সাদাব- কি ব্যাপার বলতো?


সৌনক- সব বলছি আগে বাইরে চল।


দুজনে এরপর কোনো কথা না বাড়িয়ে হাঁটা দেয় বাইরের দিকে।রাতের অন্ধকারে জায়গাটা বোঝা যায়নি ঠিক করে। তবে এখন ভোরের ক্ষীণ আলোয় জায়গাটার নৈসর্গিক রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে।অজান্তেই দুজনের মুখ দিয়ে বাহঃ উচ্চারণ হলো।


সাদাব- আমি এমন সুন্দর জায়গা আজ অব্দি দেখিনি রে...


সৌনক- হুম।তবে ,আমি আরো বেশি অবাক হচ্ছি যে এইরকম সুন্দর জায়গা এতদিন অব্দি ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে থাকলো কি ভাবে?

এককথায় বলতে পারি এই জায়গাটা অপূর্ব টুরিস্ট স্পট হতে পারে।


সাদাব- ঠিক।


দুজনে আরো এগিয়ে চললো। ততরাং পুকুরটার দিকে নজর যেতেই দেখা গেল সেটা একদম শান্ত।মনেই হচ্ছেনা সেটা একটা জলাশয়।সেটা বিকেলের আবছা আলোয় যেমন সবুজ মাঠের মতো লাগছিলো ,ঠিক তেমনি লাগছে।মাঠের একটা আল ধরে দুজনে এগিয়ে যেতে লাগলো।


সাদাব- আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায় বললিনা যে?


সৌনক যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে বললো গ্রামের বাইরে চল বলছি সব।


এরপর প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটার পর তারা উঠে এলো একটা মেঠো রাস্তার ওপর।সৌনক এদিক ওদিক দেখতে লাগলো যেন সে পথ হারিয়েছে।


সাদাব- কি ব্যাপার একটু খুলে বলবি কি? তাহলে আমিও সাহায্য করতে পারতাম


সৌনক একটু অন্যমনস্ক ভাবে বললো গ্রামের লোকদের কাছে কিছুই সেরকম জানা গেলোনা।তাই বাইরে কয়েকটা লোকের মুখ থেকে ঘটনা টা............. আবার সেই বিশ্রী ভাবে সৌনক কেশে উঠলো খকঃ খকঃ করে।তবে এবার যা হলো তাতে সাদাব চমকে উঠলো


সাদাব- এ কি রে রক্ত কি করে?তোর মুখ দিয়ে তো রক্ত উঠছে


সৌনক তখন মাটিতে বসে পড়েছে তার চোখ নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে খানিকটা থুতু ফেলে সে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো জানি


সাদাব- জানি মানে? তুই কি কাজ করে করে পাগল হয়ে গেছিস নাকি?তোর কাশির সাথে রক্ত উঠছে আর বলছিস জানি।এটা তো ভয়ানক কিছু রোগ বাঁধিয়েছিস মনে হচ্ছে


সৌনক একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো বলো জয় মন্দের দেবীর জয়...... হেঃ হেঃ


সাদাব রাগে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনি একজন অপরিচিতের গলা শোনা গেল।তবে এটা শুধু গলার শব্দ নয় কেউ মনে হচ্ছে গান গাইছে।কোনো বৃদ্ধ হবে.......ঠিক তাই


এদিক ওদিক দেখতে লাগলো দুজনে কিন্তু কোনো লোকের দেখা মিললনা


সৌনক- শব্দটা ওই বড় পাথরটার থেকে আসছে না


সাদাব- মনে তো তাই হচ্ছে।


এগিয়ে গিয়ে পাথরটার কাছে যেতেই দেখা গেল পাথরটার পিছনে এক বৃদ্ধ বসে আছে ।তার পরনে অল্প কিছু কাপড়,আর চারিদিকে গাঁজার ধোঁয়ায় ভর্তি।


সৌনক কাছে যেতেই বৃদ্ধ গান থামালো।আর সৌনকের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।


বৃদ্ধ- কেন এসেছিস এখানে।যত জলদি পারবি পালা এই জায়গা ছেড়ে


সৌনক- কেন?


বৃদ্ধ- কেন ,কেন হেঃ হেঃ।

তা বেশ এই বলে বৃদ্ধ আবার আপনমনে গান ধরলেন।এই অকস্মাৎ উৎকণ্ঠা তৈরি করা হেঁয়ালিতে সৌনক খানিক বিব্রত হলো।সে পুনরায় বৃদ্ধের দিকে ঝুঁকে বললো কি ব্যাপার বলুন না একটু,সাথে তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল সে


বৃদ্ধ এবার ফিরে তাকালো। ওর ঘোলাটে হলুদ চোখগুলো যেন নিমেষে একবার সৌনককে আপাদমস্তক জরিপ করলো,তারপর একটা খ্যাক করে শব্দ উচ্চারণ করে বললো জানিস এই জায়গাটা কি?


সৌনক বুঝলো এপিসোডের জন্য সঠিক লোক পাওয়া গেছে,সে সাদাব কে বাঁ হাতে ইশারা করলো যেন সে শ্যুট শুরু করে তবে বৃদ্ধকে না জানিয়ে?


সাদাব চুপচাপ ক্যামেরাটা অন করলো।তবে একটা সবুজ আলো ক্যামেরাটায় জ্বলে উঠতেই বৃদ্ধ হটাৎ করে চেঁচিয়ে উঠল


বৃদ্ধ- দূর হ বদমাইশের জাত।আমাকে মারতে চাস তাই তো।তো মার না মার


সৌনক বৃদ্ধের চিৎকার শুনে হকচকিয়ে গেল সে দ্রুত ক্যামেরার সবুজ আলোর জায়গাটায় নিজের রুমাল ঢাকা দিয়ে দিল।


সৌনক- আপনি রাগ করবেন না।কুয়াশা খুব তাই আলো জ্বালিয়ে ছিলাম


বৃদ্ধ তখনো রাগে গজগজ করছে।


সৌনক তার মুখে একটা সিগারেট দিয়ে লাইটারটা জ্বালালো।আর সাথে সাথে বৃদ্ধ যেন খানিক নরম হল।


সৌনক- তা আপনি কি যেন বলছিলেন? কি জায়গা এটা।


বৃদ্ধ যে রীতিমতো গাঁজার নেশা করেন তা বোঝাই গেল।সিগারেটে একটা জোর টান দিতেই সিগারেটটা তীব্র ভাবে জ্বলে উঠলো তারপর একরাশ ধুঁয়া ছেড়ে বললেন,

- আগে এই জায়গাটায় কোনো মানুষ বাস করতো না।এই জায়গাটায় শুধু ওই শিয়াল আর নেকড়ের বাস ছিল।আর ছিল ওই পুকুরটা।তবে তখন সেখানে জল দেখা যেত ওমন পানাপুকুর ছিলোনা।(বৃদ্ধ এই বলে আবার সিগারেটে টান দিলেন।)

এমন নিরবিলি জায়গা শুধু এক ধরণের লোকেদেরই ভালো লাগে.............


সৌনক- কি রকম?


বৃদ্ধ একদৃষ্টে সৌনকের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি হেসে বললো শহরের বাবু নাকি? হ্যাহ্যায়ঃ


খানিক বিরক্তি লাগছিলো সাদাবের,এই বৃদ্ধ লোকটা খুব বেশি হেঁয়ালি করে,কিছুই স্পষ্ট করে বলছেনা।কানে কানে সৌনককে বললো ভাই আদেও এই বুড়োটা কিছু জানে। নাকি গাঁজা খেয়ে নেশাভাঙ করে পড়ে থাকে আর এখন আমাদের ঝোলাচ্ছে।

কথাটা শেষ হতে না হতেই বৃদ্ধ খিঁচিয়ে উঠে সাদাবকে বলল তুই কি জানিস আমার ব্যাপারে?সালা বেরো এখান থেকে


সাদাব আরো কিছু একটা বলতে যাবে ওমনি সৌনক বৃদ্ধের হাত চেপে ধরলো


সাদাব- আপনি রাগ করবেন না।ও বুঝতে পারেনি.....মাফ করুন।আমি আপনাকে আর ভালো ভালো সিগারেট এনে দেব


বৃদ্ধ খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো কি? কি? আমাকে কিনতে চাস তুই হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ।বেশ কিছুক্ষণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার পর বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো।তারপর..............


তোরা এই জায়গায় নতুন আর..........বৃদ্ধ একবার সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে বললো আমি কারোর কিছু নি না।তবে তোর ব্যাবহার আমার ভালো লেগেছে,কথাটা বলতে বলতে বৃদ্ধ স্থির দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ সৌনকের দিকে চেয়ে রইলো।


এরপর কিছুক্ষনের জন্য একটা ক্ষনিকের নিস্তব্ধতা..........তারপর বৃদ্ধ বলল যা ঐ খানটায় বোস.......


সৌনক আর সাদাব বৃদ্ধের কথা মতো নির্দেশিত স্থানে বসতেই একটা জিনিস লক্ষ করলো যেটা তারা এতক্ষন করেনি। একটা নরমুন্ড নিয়ে বৃদ্ধ বসে আছে, পাশে একটা পানপাত্র রয়েছে।


বৃদ্ধ কেশে কথা বলা শুরু করলো


তা আজ থেকে প্রায় একশো বছর এই জায়গাটা মানুষের বসবাসের জন্য ছিলোনা।সেই সময় ইংরেজ আর আদিবাসীদের মধ্যে দিকে দিকে সংঘাত চলছে।ইংরেজরা জায়গা আর কাঠের লোভে আদিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করছে পুরো ভারত জুড়ে।আমাদের বঙ্গে দিকে দিকে তাই হচ্ছিল।

(সিগারেটটায় একটা জোরে টান দিয়ে বৃদ্ধ সেটাকে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে মারলো)

কোম্পানির লোকেদের হাত থেকে আমরা অব্দি রেহাই পাইনি।


সৌনক ভ্রু কুঁচকে বললো আপনাদের মানে?


বৃদ্ধ মুচকি হেসে বললো সাধকেরা?


সৌনকের আরো বেশি করে কপালে ভাঁজ পড়লো কারণ বৃদ্ধকে দেখলে মনে হচ্ছিলনা তিনি কোনো সাধক।গায়ে একখানা মলিন সাদা কাপড় আর একটা হাটু অব্দি ধুতি পরে আছেন।কপালে কোনো তিলক নেই ,না আছে রক্তবর্ণ পরিধান।এ কিরকম সাধক


মুখ দিয়ে কিছু না বললেও বৃদ্ধ,সৌনকের মনের কথা বুঝতে পারলেন হো হো করে হেসে উঠে বললেন

কি ভাবছিস।আমাকে দেখে মনে হচ্ছেনা না।


সৌনক- না মানে? যেমন শুনেছি সাধকেরা হয়, তাদের মতন..............


বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন লাল বস্ত্র আর কপালে তিলক নিলেই কেউ সাধক হয়না রে।চাই আত্মত্যাগ......সেটা সে লাল বস্ত্র পরেই করুক কি নগ্ন হয়ে।তোরা কিছুই জানিসনা সাধকদের ব্যাপারে


সৌনক- আচ্ছা আচ্ছা সে ঠিক আছে। তারপর বলুন কি হলো


বৃদ্ধ- বেশির ভাগ আদিবাসীদের কোনো দেবতা হয়না।তারা আসলে প্রকৃতির উপাসক হয়।গাছপালা,পশুপাখি এদের পুজো করে।এমনি এক আদিবাসী ছিল এই গ্রামের থেকে কিছুটা দূরে।


সৌনক- তা বাবা। এই গ্রামে তাহলে মানুষ থাকতো না তো কি শুধুই সাধকেরা সিদ্ধিলাভ করার জন্য থাকতো


বৃদ্ধ বাঁকা হেসে বললেন বুদ্ধি আছে তোর।আসলে ইংরেজ সরকারের সময় বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায় সাথে শব সিদ্ধি।ওরা মনে করতো এসব শুধুই বুঝরুকী।মানুষকে নাকি বোকা বানানোর পন্থা।সরকারের নির্দেশে অনেক সাধককে ইংরেজ সেনারা মেরেও ফেলে।তাই বাকিরা লোকজনের আড়ালে এই নির্জন গ্রামে ঠাঁই নেয়।যাতে তারা সিদ্ধিলাভ করতে পারে,তাছাড়া বেশি ভক্তের সমাগম হলে সাধনায় বিঘ্ন হয়।


সৌনককে উদ্দেশ্যে করে বললেন আগুনটা দিয়ে এই কলকেটা জ্বালাতো।সৌনক লাইটার দিয়ে বৃদ্ধের কলকেতে আগুন দিতেই গড়গড় করে বেশ কিছুক্ষণ টান দিয়ে বৃদ্ধ বললো হ্যা তো কি বলছিলাম


সৌনক- আপনি কোন এক আদিবাসীদের কথা বলছিলেন?


বৃদ্ধ খানিক মাথা নিচু করে বললেন হুম। লোর জাতি বলত ওদের।এই গ্রাম ছাড়িয়ে থাকতো।শিকার করা ছিল ওদের পেশা।আর এই শিকার করতে গিয়ে গ্রামের এক যুবকের বিষ মেশানো তীর গিয়ে লাগে এক সাহেবের মেয়ের গায়ে। গ্রাম বেড়াতে এসে সেই সাহেব ,তার একমাত্র মেয়েকে হারায়।তবে সেই ছেলেটির এতে দোষ ছিলোনা কারণ সাহেবকন্যা নিজেও ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করে জঙ্গলি পশু শিকার করতে এসেছিল। কিন্তু সাহেবকন্যার মৃত্যু হয়েছিল বিষতীরে, ফলস্বরূপ এই সকল আদিবাসীদের ওপর ইংরেজদের কোপ পড়ে।


সৌনক- বাপরে।এতো বিশাল কান্ড।তারপর....


বৃদ্ধ- তোরা হয়তো জানবিনা এই গ্রামে এক সাধক থাকতেন ত্রিকালনাথ বলে।পিশাচ তন্ত্রে সিদ্ধহস্ত।সাধকদের মধ্যে এই দিবাডিয়াতে সবচেয়ে বড় সিদ্ধ সাধক ছিলেন তিনি।তবে বিশেষ কাউকে তিনি তার কাছে আসতে দিতেন না।গ্রামের মধ্যে একটা জায়গায় মাটির একটা গুহা বানিয়ে তিনি সাধনা করতেন।তার তন্ত্রের জোরে নাকি প্রেতকুলে নাড়া দিত।

তো সেই সময় ত্রিকালনাথ অশুভ আত্মাকে বশীকরণের এক দীর্ঘ সাধনাতে লিপ্ত ছিলেন।

আর এই দিকে রজার সাহেব তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে লোরদের সমূলে বিনাশ করতে উদ্ধত হয়ে উঠেছিল। রজার সাহেব তখন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছিল।তিনি শহরে ফিরে গিয়ে কোম্পানির এক সেনাপ্রধান ক্যাপ্টেন সিম্পসনকে পুরো ঘটনা সবিস্তারে খুলে বলেন।রজার সাহেব জানতেন তার ব্যক্তিগত প্রতিশোধের জন্য সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে যেতে সিম্পসন সাহেব অনুমতি দেবেন না। তাই তিনি গ্রামের প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের কথা বলেন ও সাথে মিথ্যে গুজব রটান যে লোরেরা সেই ধন সম্পদ কিভাবে কোম্পানিকে ঠকিয়ে লুঠ করছে।(বৃদ্ধ আবার জোরে কলকেটা টানলেন,সাথে চারদিকটায় ধুঁয়াতে ভরে উঠলো)


সৌনক কয়েকবার খুক খুক করে কেশে বললো তারপর কি সিম্পসন এখানে লোক পাঠয়েছিলো?


বৃদ্ধ একবার তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন ওরা ছিল জ্যান্ত পিশাচ। শুধু লোভ আর লোভ। এখানের মানুষদের ওরা মানুষ বলেই গ্রাহ্যই করতোনা।তবে এভাবে শুধু কাঠ,গালার জন্য যে একটা জাতিতে ওরা নির্মূল করে দেবে সেটা কেউ ভাবতে পারেনি।


সাদাব চমকে উঠে বললো মানে।এখন তারমানে কোনো লোরদের লোক আর বেঁচে নেই


বৃদ্ধ আড়চোখে সাদাবের দিকে তাকিয়ে বলল না।কেউ নেই। ভুতেরা এমনি এমনি বদনাম হয়ে আছে।আসল পিশাচ তো ওই জ্যান্ত মানুষগুলোই।এত নৃশংস যে বাচ্ছা গুলোকে অব্দি গুলি করে মেরে ফেলেছিল ওরা। তবে সে বেঁচে গিয়েছিল........


সৌনক উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করলো সে কে?


বৃদ্ধ- নাম জানা নেই।তবে ওই আদিবাসীদের মধ্যে একটি বছর কুড়ির ছেলে গুলির আঘাত পেয়েও কোনোক্রমে এই দিবাডিয়াতে ঢুকে পড়ে। কোম্পানির সেনা রাতের অন্ধকারে আর ওকে খুঁজে পাইনি।পরে ওরা ভাবে যে নেকড়েতে হয়তো ওকে ছিঁড়ে খেয়েছে।


সৌনক- তো সে কি করেছিল?


বৃদ্ধ নিজের পানপাত্র থেকে অল্প করে তরল মুখে ঢেলে নিয়ে বললো বলছি।সেই যুবক আধমরা অবস্থায় টলতে টলতে অজান্তে এসে পৌঁছায় ত্রিকালনাথের টিলার কাছে। সেই সময় ত্রিকালনাথ তার সাধনা সবে মাত্র শেষ করেছেন। এমন সময় যুবক তারসামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়।

ত্রিকালনাথ ছিলেন জ্ঞানীপুরুষ তিনি সহজেই বুঝে ফেলেন কি হয়েছে সেই যুবকের সাথে।আর কিছু সামান্য টোটকা করতেই সেই যুবক উঠে বসে।তবে অনেক রক্তক্ষরণের জন্য তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল।মৃত্যু ওর অবশ্যম্ভাবী ছিলো।(বৃদ্ধ এই বলে খানিক চুপ করে থাকলেন)

মহাযোগী, শ্মশানচারী হওয়া সত্ত্বেও সেদিন ত্রিকালনাথের মনে দয়ার উদয় হলো। বছর কুড়ির ছেলেটি চোখের সামনে শুধু পরিবার না,তার জাতির বিনাশ দেখেছিল।হয়তো তার কষ্ট, সেদিন ত্রিকালনাথের পাথরের হৃদয় গলাতে পেরেছিল।

ফলে ত্রিকালনাথ জিজ্ঞেস করে তোর কি চাই বল, মৃত্যু আটকানো আমার শক্তির বাইরে তবে সেটা ছাড়া যা বলবি করে দেব?


সৌনকের তখন গায়ের সবলোম খাড়া হয়ে গেছে, সে বলল কি চেয়েছিল সেই ছেলেটি?


বৃদ্ধ- হয়তো সে তখন যা কিছু ভালো ছিলো তার স্বাদ নিতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি।শুধু চেয়েছিল তার জাতির বিনাশ যারা করেছে, তাদেরও যেন বিনাশ হয়।তারা মৃত্যু চাইলেও যেন মুক্তি না পায়।তিলতিল করে তড়পে যেন তাদের মৃত্যু হয়। হিংসার লেলিহান শিখা তার চোখে জ্বলছিল তখন। অপরদিকে ত্রিকালনাথ তার দেওয়া প্রতিজ্ঞার প্রতি বদ্ধপরিকর ছিলেন?


সৌনক- ফলে


বৃদ্ধ- ফলে........তিনি চার অমাবস্যা ধরে এক প্রখর যজ্ঞ করেন।আর সৃষ্টি করেন এক অপদেবীর


সৌনক আর সাদাব একে অপরের দিকে একবার চেয়ে দেখে যে এই ভোরের ঠান্ডা হওয়ায়, তারা ঘেমে উঠেছে।


বৃদ্ধ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন .........ঊর্ধি। ত্রিকালনাথ নিজেই এই নাম দেন।


সহসা আমড়া গাছের ডালে বসে থাকা একটা দাঁড়কাক কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠে । সাদাব আর সৌনক সেদিকে তাকিয়ে বলে কি হলো কি?


বৃদ্ধ- আজ অমাবস্যার রাত, ঊর্ধির আহার পাবে ও


সৌনক- আপনি বলুন তারপর কি হল


বৃদ্ধ-  তো ত্রিকালনাথ ঊর্ধির নির্মাণ করলেন। অপদেবীর মূর্তিটা আদলে এক বৃদ্ধার ,তার পিঠে থাকে এক ঝোলা। যাতে করে সে মহামারীর সব জীবাণু বহন করে।যেহেতু কোম্পানির লোক এখানে লোভের বশে এসেছিল, তাই ত্রিকালনাথ ঊর্ধির দুর্বলতা করেন লোভ।কেউ লোভে পড়ে আশীর্বাদ চাইলেই পাবে মহামারী রোগ। (এই বলে উনি আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।)

পিশাচতন্ত্রের সিদ্ধসাধক কিন্তু পারিপার্শ্বিকভাবে এটা বুঝেছিলেন যে যার নির্মাণ তিনি করেছেন তা আসলে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দেবী।তাই তিনি ঠিক করেন যে প্রতিশোধ পূরণ হলেই ঊর্ধিকে মন্ত্রবন্দি করে পাতালে প্রবেশ করিয়ে দেবেন।


সাদাব- তাহলে সেই দেবী কিরকম ভাবে প্রতিশোধ নিলো?


বৃদ্ধ- ঊর্ধি অপয়া। ওর দেখা পেলে সে মানুষ হোক বা পশু, আর বাঁচেনা। নৃশংস ওর স্বভাব। এক কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে কাশতে কাশতে ঘুরে বেড়ায়। ঊর্ধির স্বর নেই,আর একচক্ষু। বীভৎস রূপ ওর। নিজের শিকার যখন রোগগ্রস্ত হয় তার পঁচা গলা হাঁড় চিবিয়ে নিজের ক্ষুদা মেটায়।

ওর সৃষ্টির এক অমাবস্যার রাতেই কোম্পানির সেনাদের শরীরে এক অদ্ভুত রকমের চর্মরোগ শুরু হয়। কয়েকদিনেই ছাল চামড়া উঠে গিয়ে মাংস গলে গলে পড়তে শুরু করে। দিন কয়েকের মধ্যেই সেনাদের মধ্যে ভয়ের সূত্রপাত হয়। লেফটেন্যান্ট সিম্পসন তবে পাত্তা দেননি। তিনি নিজে রাতে শিকারে বেরোতেন।তবে তার মুন্ডহীন দেহটা যখন আমড়া গাছে টাঙানো মেলে সেনাদের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। তারা এই জায়গা ত্যাগ করে আর তারপর দেশ দু'শো বছর পরাধীন হলেও এই জায়গায় তারা কোনোদিন আসেনি।এমন পরিত্যক্ত ভূমি এদেশে আর দুটো নেই। এখনো অনেকেই এই জায়গাটা সম্বন্ধে অবগত নয়।


গায়ে কাঁটা দিলো কথাটা শুনে।


সৌনক- আচ্ছা আপনি ঊর্ধির রূপের ব্যাপারে এত কিছু কিভাবে বলছেন?


বৃদ্ধ খানিকক্ষন আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো........তারপর সৌনকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল রূপ দেখিনি তবে ওর চোখ দেখেছি।


সৌনক বিস্ময়ের সাথে বললো কি?








মন্দের দেবী (পর্ব ৭)

লেখক: দেবদত্ত চট্টরাজ

প্রবল উৎসুকতা নিয়ে সৌনক বৃদ্ধ সাধকের দিকে চেয়ে ছিল।


সৌনক- বাবা। আপনি কখন দেখেছিলেন?


বৃদ্ধ খানিকক্ষন স্মৃতিচারণা করে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো,

- সে কথা বলতে গেলে আরো কিছু কথা বলা দরকার।

কোম্পানির সেনারা সেই মারণ রোগ থেকে বাঁচতে জায়গা ছাড়লো।তবে যারা রোগগ্রস্থ হয়েছিল তাদের এক ভিন্ন অবস্থা দেখে দিলো।


সৌনক- ভিন্ন অবস্থা মানে


বৃদ্ধ অলসভাবে শরীরটাকে আধো এলিয়ে দিয়ে বলল বলছি বলছি,ওতো উতলা হচ্ছিস কেন?


ভিন্ন অবস্থা মানে...... ওরা মুক্তি পেলোনা।গ্রামের যারা আদিবাসী ছিল তারা তো আগেই মারা গিয়েছিল। তাই যে সব সেনারা রোগে মারা গেল, তাদের কোনো সৎকার হলোনা।অবশ্য এর জন্য ওরা নিজেরাই দায়ী। কিন্তু এই মৃত্যু যে সাধারণ ছিলোনা, স্বয়ং রোগের অপদেবীর আশীর্বাদ পেয়েছিল ওরা।তাই আর ছাড়া পেলোনা। চর হয়ে রয়ে গেল।


সৌনক- বাবা। এই চর কি জিনিস। মানে গ্রামেও কাল এই কথাটা শুনছিলাম।ভিকু বলছিলো যে চর আছে।

আর হ্যা একটা আশ্চর্যের ঘটনা আমরাও দেখেছি তাই না সাদাব?


সাদাব- হ্যাঁ। ভিকু বলে একজন আমাদের এখানে আসার আমন্ত্রণ দিয়েছিল। তবে এখানে নেমে আমরা অবিকল তার মতোই একজন কে দেখেছি। এমনকি ভিকু নিজেও জানে সে কে,কিন্তু কিছুই বললোনা


বৃদ্ধ কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল, চোখ বুঝে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর সোজা ভাবে সৌনকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল

তোরা মস্ত বিপদে পড়েছিস রে ব্যাটা। 


সহসা একটা ভয়ের সঞ্চার হলো দুজনের মধ্যে।


সৌনক- কি বিপদ বাবা,খুলে বলুন।


বৃদ্ধ- চর হলো অপদেবীর সেবাইত। ভগবান আর অপদেবতা প্রায় সমান। একজন আলো তো আরেকজন অন্ধকার।এর বেশি কিছু পার্থক্য নেই রে।তাহলে নিজেরাই বুঝে নে ভগবানের সাগরেদ থাকলে অপদেবীর কেন থাকবেনা।



সৌনক একবার সাদাবের দিকে ফিরে চাইলো তবে এবার দুজনের মুখের হাবভাব আগের মতো ওতো সাধারণ নেই। ভয়ের একটা আবছা আস্তরণ তাদের মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে গিয়েছে।


বৃদ্ধ- দেবতার প্রসাদ লাভ হলে যদি স্বর্গসুখ হয়, তাহলে নরকের দেবীর আশীর্বাদে কি হতে পারে বুঝে নাও।


সৌনক খানিকক্ষন নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো রোগ,অসুখ তাই না।


বৃদ্ধ- না, শুধু অসুখ নয় রে। এই রোগ জন্মজন্মান্তরের জন্য দাসবৃত্তি।মৃত্যুতে যদি মুক্তি হত তাহলে তো কোনো কথাই ছিলোনা। সব সাধনা তো মুক্তিকে ঘিরেই রে।কিন্তু যারা ঊর্ধির আশীর্বাদ পায় তাদের আত্মা ওর চিরকালের দাস হয়ে রয়ে যায়।তবে এদের দেখা যে বড়ই খারাপ রে........


কথাটা বলে বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন।


সৌনক- খারাপ কিভাবে?


বৃদ্ধ- এরা সেবাইত বা চর যা খুশি বলতে পারিস। তবে এই চরেরা দেবীর জন্য আহারের খোঁজ চালাতে থাকে।যেকোনো জীবকে ধরে দেবীর কাছে উৎসর্গ করে।

না না উৎসর্গ ভালো কথা। এর অর্থ কলঙ্কিত হচ্ছে ওই অপয়ার জন্য।ভোক্তা বলবি ভোক্তা


বৃদ্ধ রেগে গেলেন।উনার চোখ কিছুক্ষনের জন্য যেন আগুনে ঘী পড়ার মতো জ্বলে উঠলো।


সৌনক- এই ডাক আমি শুনেছি।ভোক্তা .....ঠিক।রাতের অন্ধকারে যখন ভিকু আমাদের ততরাং দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কে যেন আমাদের এটা কানের কাছে ফিসফিস করে বলছিলো আয় ভোক্তা হবি আয়, তাই না রে সাদাব।


বৃদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তারপর করুণার স্বরে বললেন তোরা এখানে থেকে পালা বাবা। নিজের মায়ের কোল খালি করিসনে।বিপদ তোদের পিছু নিয়েছে।


সৌনক- আপনি আমাদের বলুন কি হয়েছিল।আমি কথা দিচ্ছি বাবা, যে আমি চলে যাবো আপনার কাছে কথা শুনেই।


বৃদ্ধ- ঊর্ধিকে জানার লোভ বড়ই ভয়ানক রে।স্বয়ং ত্রিকালনাথ নিজে পারেন নি ওকে সামলাতে।ও সাক্ষাৎ মৃত্যু।তবে তুই যখন জানতে চাস তোকে বলে দিচ্ছি,

সেনাদের সমূলে শেষ করে ঊর্ধির ক্ষুদা মেটেনি।মিটতই বা কি করে। মহামারী যার সৃষ্টির উৎস তার কি দু একজনে পেট ভরে।তবে আমার গুরুদেব কালীনাথ পন্ডিত বলেছিলেন যে মন্ত্রশিক্ষা বড়ই জটিল।যত শিখবে ততই মনে হবে প্রয়োগ করি।এ জিনিস প্রয়োগ করে তার রূপ সৃষ্টি করার যে কি আনন্দ, সে তোদের বোঝাতে পারবোনা। আমি আজকালকার সাধক এ জিনিসের শুধু ক,খ টুকুই জানি। তবে তিনি জানতেন, তাও পারেননি। দীর্ঘকাল পিশাচতন্ত্রের সাধনা করে তিনি আসলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন, মনে মনে চেয়েছিলেন এর সৃষ্টি তিনি করে দেখবেন। আর কালের পরিহাস দেখ, সেই সুযোগ এলো।তবে ঊর্ধির সৃষ্টিতে তিনি যত মনোনিবেশ করেছিলেন তার ওপর নিয়ন্ত্রণে ততটা করেন নি। ফলে ঊর্ধি ও ওর চরেরা যখন শিকার পেলোনা তখন এই দিবাডিয়াতে সাধকদের শিকার করতে শুরু করলো।

ভাবতে পারিস হেঃ হেঃ, সাধকদের শিকার করছিল ওই অপয়া।শবসিদ্ধ সাধকদের মনে ত্রাসসৃষ্টি করা কোনো প্রেতের কম্ম হতে পারেনা। তবে ও পেরেছিল। আর তাই সৃষ্টিতে এক পিশাচী হলেও কালের ভক্তকে ভোক্তা বানিয়ে ও হয়ে উঠেছে আধুনিক যুগের কুখ্যাত অপদেবী। তবে ভালো যে মানুষের আধুনিক সমাজ এখনো অব্দি ওর কোপের থেকে দূরে আছে।


সৌনক- বাবা।আমি যখন এখানে এসেছিলাম গ্রামের লোকেরা বলছিলো যে ঊর্ধিকে নাকি ওরা মাটি খুঁড়ে পেয়েছে।


বৃদ্ধ মুখ বিকৃতি করলেন।


বৃদ্ধ- হতচ্ছাড়া গুলো। মূর্খ, মূর্খের দল। জায়গা পেলোনা আর বসবাসের। সাধকদের প্রাণরক্ষার্তে,ত্রিকালনাথ নিজের প্রাণের আহুতি দিয়ে এক যজ্ঞ করেছিলেন। আর তাতেই ওই অপয়া বাঁধা পড়েছিল ত্রিকালনাথের গুহায়। পরে একশো সাধক মিলে নির্জলা উপোস দিয়ে কালমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ঊর্ধির মূর্তিকে ত্রিকালনাথের শরীরের সাথে বেঁধে উনার গুহায় সমাধি করে।

কিন্তু না,ঊর্ধির চরেরা ইষ্টদেবীকে না পেয়ে যে চটপট করছিল।আর ওই অপগন্ডগুলোকে এখানে নিয়ে এলো বাস করার লোভ দেখিয়ে। তারপর ওরা যা বলেছে সব সত্যি।


ঊর্ধি যে কতটা ভয়ানক তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা।ওর ভয়ডর বলে কিছু নাই।শিকারকে পছন্দ হলে ও সব শক্তি লাগিয়ে নিজের আহার বানাবেই।সে মানুষ হোক কি পশু,সাধক হোক কি পিশাচ।


সৌনক- বাবা আপনি কিভাবে বলছেন এই কথা?


বৃদ্ধ- কারণ আমার গুরুদেব অব্দি পার পায়নি ওর থেকে। উনি প্রেতসিদ্ধ সাধক ছিলেন,কিন্তু এক অমাবস্যার রাতে উনি ঠিক করেছিলেন ওই মাসরাদের মুক্তি দেবেন ঊর্ধির হাত থেকে।কিন্তু না, তা আর হয়ে ওঠেনি।আমাকে উনি সেদিন সাথে যেতে মানা করেছিলেন। কিন্তু আমি গুরুমন্ত্রের জপ করতে রাতের দিকে যখন গেলাম দেখি গুরুদেবের জটার থেকে রক্ত বেরোচ্ছে আর উনি উনি.........চিৎকার করছেন সাহায্যের জন্য।এক পলকের সেই পৈশাচিক কান্ড দেখে আমার রক্তশুন্য হয়ে গিয়েছিল।(বৃদ্ধের মুখে চোখে ভয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল)

আমি ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম।গাছের আড়ালে মুখ দাবা দিয়ে দেখেছিলাম সেই লোমহর্ষক দৃশ্য।কি ভয়ানক যে তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা।তবে ওর মুখ দেখার সাহস আমি করতে পারিনি।যা দেখেছিলাম তা হলো গুরুদেবের মাথায় ফলার মতো দাঁত ঢুকিয়ে ওই অপয়া ঊর্ধির পরমাতৃপ্তি করে রক্তের

স্বাদ আস্বাদন করা চোখটা।ওমন নিষ্ঠুর চোখ আমি জীবনে দেখিনি আর দেখতেও চাইনা।

(বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন)


সৌনক মাথা নিচু করলো


সৌনক- তারমানে এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে সেটা ওরা ওই মূর্তিটা না বের করলে আর হতোনা, তাই না।


বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন।কয়েকটা অশ্লীল গালি গিয়ে কলকেতে পুনরায় মজে উঠলেন


সৌনক বৃদ্ধকে প্রণাম করে বললো বাবা তাহলে আমি আসি।


বৃদ্ধ হলদেটে ঢুলুঢুলু চোখ দিয়ে একবার তাকিয়ে বললেন সাবধানে থাকিস। মহাকাল তোদের মঙ্গল করুক।বোম ভোলে.....


সৌনক উঠে সাদাবকে ঈশারা করল দূরে যেতে।কিন্তু ওরা পা বাড়াতেই বৃদ্ধ আবার বলে উঠলো তোরা কি দামরুটা দেখেছিস?


সৌনক- দামরু কি জিনিস?


বৃদ্ধ একবার বাঁকা ভাবে হাসলেন ডমরুর মতো দামামা। পৃথিবীতে আর কোথাও পাবিনা দেখতে।ঊর্ধিকে বশে রাখতে কালের প্রিয় ডমরু আর আদিবাসীদের দামামার এক অপূর্ব মিশ্রণ


চোখের সামনে যেন গতকালের সেই অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রের কথা মনে পড়ে গেল সৌনকের।


সৌনক- হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি দেখেছি, তবে ওর কাঠিগুলো বেশ অদ্ভুত লাগছিলো আমার।কেন জানিনা অন্য কিছু মনে হচ্ছিল।


বৃদ্ধ হো হো করে হেসে উঠলেন।অন্য কিছু হা হা হা

ওটা অন্য কিছু নয় রে বোকা।ওটা পাঁজরের হাঁড়। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাসির শব্দটা পুরো জায়গাটা জুড়ে গমগম করে উঠলো।কিন্তু সাদাব আর সৌনকের বুকে যেন একটা ভয়ের বিদ্যুৎ খেলে গেল কথাটা শুনে


একযোগে ওরা বলে উঠলো কার হাঁড়?


বৃদ্ধের চোখ তখন আবার জ্বলে উঠেছে,সে বলল ঊর্ধির শেষ আহারের। তাই পালা তোরা নাহলে পরের দামরুটা তোদের হাঁড় দিয়ে বাজবে। হাঃ হাঃ বলে কিনা অন্য রকম হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ


বৃদ্ধ আপনমনে তখন হেসে চলেছে।আর সৌনক যেন পাথরের মত নিস্তেজ।কি করা উচিত এখন। সে মনে মনে ভাবছে জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চিত এপিসোড করে কি দিল্লির টিকিট পাকা করব? নাকি পালাবো।মন তখন ভয়ে আতঙ্কে কু গাইছে।যদি সত্যি মন্দের দেবী লোকগল্প না হয়ে থাকে,তাহলে?






মন্দের দেবী (অন্তিম পর্ব)

লেখক: দেবদত্ত চট্টরাজ





সাদাব,সৌনকের পিঠে হাত রাখতেই সৌনক খানিক চমকে উঠলো।


সাদাব- কি ভাবছিস ভাই। ফিরে চল, যা রেকর্ড করেছি সেটায় মোটামুটি এডিট করে ভালো হয়ে যাবে এপিসোড। আর এখানে বেশিক্ষন থাকা ঠিক হবেনা।


সৌনক অন্যমনস্ক ভাবে একদিকে চেয়ে বললো না। শুধু ভালো হলে চলবেনা। সবচেয়ে সেরা হতে হবে।


মুহূর্তের মধ্যে সাদাবের দিকে ঘুরে তাকালো সে।সৌনকের চোখে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষণীয়।সে যেন মুখিয়ে আছে এর পরিণতি দেখতে।


সাদাব- বোকামো করিসনা সৌনক। আমি নিজে এসব মানিনা কিন্তু কেমন জানি..........


সৌনক- ভয় পাচ্ছিস। হাঃ হাঃ

ভয় নিয়ে বেঁচে কি করবি শুনি।সারাজীবন পারবি তো এডিটর আর ডিরেক্টরের জুতো খেতে। ইচ্ছে হয়না তোর এই ছোট ডোবাটা থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরোতে।নাকি সারাজীবন এই ডোবার কুনোব্যাঙ হয়ে থেকে জাবি তুই।


কথাগুলো কর্কশ ছিল।শব্দের প্রখরতার চেয়েও বেশি সৌনকের ঝাঁঝালো গলাটা কেমন জানি সাদাবের মনে আঘাত করলো।


সাদাব- আমি নিজের জন্য বলিনি শুধু। এখানে থাকলে তোর....


সৌনক- ছাড় তো। ওসব আমাকে শোনাতে আসিসনা।ভীতু তুই এটাই আসল কথা। কিন্তু আমি না। আমি অবশ্যই বেরোবো এখান থেকে। মন্দের দেবীকে টি.আর.পি তে আমি বাংলা চ্যানেলের সেরা এপিসোড করবো।যা আজ অব্দি কেউ কল্পনাও করেনি।


বন্ধুর চোখে সে দেখল এটা কোনো স্বপ্নপূরণের অদম্য তাড়না নয় বরং সেটা ঊর্ধিকে জানার তীব্র ইচ্ছে।

বুকটা দুরুদুরু করছে।ফটফটে সূর্যের রোদে চারিদিক ঝলমল করে উঠেছে।কিন্তু সেটা মনের বিভীষিকাকে দূর করতে পর্যাপ্ত নয় ।না চাইতেই মাথায় একটা দৃশ্য ভেসে আসছে,আর সেটা হলো একটা কালো লম্বা বলশালী লোক পাঁজরের হাঁড় দিয়ে দামরু'টা বাজাচ্ছে।

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

সাদাব একবার ভাবলো এখান থেকে সে ছুটে পালিয়ে যাবে।কিন্তু তার মনটা সায় দিলোনা।পরক্ষণে সৌনকের উজ্জ্বল চোখগুলোর নিস্পলক দৃষ্টিটার দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বললো দেখাই যাক, কি হয়?


দুজনে একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে চললো গ্রামের দিকে।প্রকৃতির কি মোহময়ী রূপ। এই দিবাডিয়া ভোরের আলোয় যেমন প্রাণবন্ত লাগছিলো এখন বেলা বাড়তে কেমন জানি উদাস হয়ে উঠেছে। চারিদিকের গাছপালা গুলো কেমন জানি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।


তবে বৃদ্ধসাধকের কথাগুলো ততক্ষনে মনের মধ্যে যেন একটা জোয়ার তুলেছ, তবে কি এই বনজঙ্গল সবই ঊর্ধির ভয়ে ভীত।এমন উদাস হয়ে থাকা গ্রাম আগে কোনোদিন দেখিনি।

দুজনের মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছে সেটা তারা একে অপরকে জানাতে পারছিলনা।কারণ, হয়তো তারা চাইছিলনা একে অপরের সাহসকে সেই সময় আরো দুর্বল করে দিতে।


দিনের উজ্জ্বল আলোকেও দুজনে হেঁটে যাচ্ছিল একটা প্রাণহীন জায়গার মধ্যে দিয়ে।কোনো পাখি ডাকছেনা এমন কি একটা কীটের আওয়াজ অব্দি নেই।সাদাবের বুক তখন ঢিপঢিপ করছে।একবার ততরাং এর দিকে চোখ যেতেই সে দেখল জলটা হালকা দুলছে।তবে উপরে জমে থাকা পানা গাছের আস্তরণে সেই প্রানের ইঙ্গিতটা নিতান্তই ক্ষীণ।


সাদাব- সৌনক


সৌনক ফিরে তাকালো ওর দিকে


সাদাব- ভাই খুবই অদ্ভুত না জায়গাটা।আমরা ঠিক করছি তো?


প্রশ্নটা এবার সৌনক উড়িয়ে দিতে পারলোনা। বৃদ্ধের নিষেধাজ্ঞা আর এই অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতা সৌনকের মনে সাহস আর ভয়ের দ্বন্দ্বকে প্রবল করে তুলেছে।


সৌনক কথা না বাড়িয়ে পিছু ফিরে বললো জলদি চল। এত কিছু ভাবিসনা।কাল সকালেই চলে যাবো।


সাদাব আর কথা বাড়ালোনা।দুজনে এগিয়ে চললো গ্রামের দিকে।তবে গ্রামে প্রবেশ মাত্রই তারা স্তব্ধ হয়ে

গেল। এ কি নৃশংস দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে তারা।


ভিকু আর ওর স্ত্রী মাটিতে আঁছড়ে পড়ে কাঁদছে হো হো করে আর ওদের ছেলেটিকে গ্রামের লোক একটি বাঁশের তৈরি খাঁচার মধ্যে বন্দি করে গাছের সাথে লটকে রেখেছে। ছোট ছেলেটির তীব্র চিৎকার করে মা, মা বলে ডাকাটা ওদের দুজনকে রক্তশুন্য করে দিলো।বন্দি শিশুটিকে ঘিরে ছয়জন লোক তখন এক অদ্ভুত নৃত্যে মগ্ন।আর বাঁশের তৈরি ভেঁপু বাজিয়ে বাকিরা এই দিবালোকেই জায়গাটাকে অশান্ত করে তুলেছে।


সাদাব কিছু বলতে যাবে তার আগেই সৌনক বাঘের মত চিৎকার করে উঠলো।


সৌনক- হেই। তোমরা এসব কি শুরু করেছ। তোমরা মানুষ নাকি অন্য কিছু।


হটাৎ এই গর্জনে নিমেষে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠলো।নাচতে থাকা সেই লোকগুলো এবার ফিরে তাকিয়েছে।তবে ওদের মুখভঙ্গী অত্যন্ত কদাকার।লোকগুলোর মাথার মধ্যে চক দিয়ে অদ্ভুত সব উল্কি করা,চোখ গুলো নেশাগ্রস্থ আর মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে লালা।দেখলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।


ভিকু- বাবুরা পাল্যান। পাল্যান বাবুরা।আপনারা কেন আল্যেন আবার।চলে যান ই জায়গা ছ্যাডে চল্যা যান।


ভিকুর আবেদন যেন বড় করুণ।সে যেন এই বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি কি ভয়ানক হতে পারে তা আগে থেকেই জানে।


সৌনক- তুমি কি জন্য ভয় পাচ্ছ ভিকু।কি জন্য।তোমার ছেলেকে ওরা ধরে রেখেছে আর তুমি ওদের বাধা না দিয়ে কাঁদছো। উঠে দাঁড়াও


সাদাবের চোখ কিন্তু সেই লোকগুলোর দিকে স্থির।লোকগুলো কেমন জানি স্বাভাবিক নয়।সে ওদের মুখে বিকৃত হাসি দেখে ভয় পাচ্ছে।ছয়জন মানুষের অবয়বে পিশাচ যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।ওদের ওই পৈশাচিক হাসি যেন বুকের মধ্যে রক্তের স্রোতকে দ্রুত করে দেয়।


সৌনক তখন ওর হাত চেপে ধরে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।নিমেষে ওর পা আঁকড়ে ধরলো ভিকু।


ভিকু- উ দিকে যাবেন লাই বাবু।ওরা মানুষ লয় বাবু


কথাটা যেন বাজ পড়ার মতো শোনালো।মানুষ নয় মানে।কি বলতে চাইছো


ভিকু- এখানে কোনো দিন রাত বলে কিছু হয় লাই বাবু।সবটাই..................সবটাই ঊর্ধির মায়া


ভেঁপুর শব্দটা আরো বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে তখন।নিতান্তই কর্কশ মাধুর্যহীন সেই সুর।কিন্তু মনকে যেন বশ করছে।নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আর থাকছেনা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে তখন ওই ছয়জন।গোল করে একহাত উপরে তুলে ওরা আবার বিশৃঙ্খলভাবে নাচতে শুরু করেছে।এইরকম উন্মত্ত নাচ দেখে সাদাবের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেছে তখন।মাথার ওপর একবার তাকাতেই স্নায়ুগুলো চঞ্চল হয়ে উঠলো, ঝলমলে রোদ্দুর পরিবেশটা হটাৎ করে কালো মেঘের আস্তরণে ঢেকে পড়ছে।মাটিতে পড়ে থাকা ভিকু আর ওর বউ অজ্ঞান হয়ে গেছে ততক্ষনে। নিজের চোখকে কি বিশ্বাস করবে কিনা সেটাই তারা বুঝতে পারছেনা।


মুহূর্তের মধ্যে একবার পিছনে চোখ ফেরাতেই সৌনক চমকে উঠলো ,সে দেখল আরো বেশ কিছু কালো কালো ছায়া মূর্তির সেখানে আবির্ভাব হয়েছে।সাদাব তখন ভয়ে হাতের ক্যামেরাটা নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।


এমন সময়......................কানের কাছে লোমগুলোয় শিহরণ জাগিয়ে একটা খনা গলা ভেসে এলো ভয় পাচ্ছিস নাকি?ভয় পাশনা। আমি যে তোর মা........তোর মা নই বল। ইঁ হিঃ হিঃ হিঃ


সৌনক চমকে মাথা ঘোড়াতেই দেখলো অদ্ভুত ,সামনে কোথাও কিচ্ছু নেই। কে কোথায়?কোথায় সেই লোকগুলো আর কোথায় ভিকু, ওর ছেলেটাই বা কোথায়।সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলোনা। ভয়ে গলাটা এতটাই শুকনো হয়ে গিয়েছিল যে সে ঢোক অব্দি গিলতে পারলোনা।


পিছন ফিরে তাকাতে সৌনক দেখলো সাদাব আগের মতোই থরথর করে কাঁপছে।ওর মুখ চোখ সব ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। একটা ঝাঁকুনি দিতে সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে উঠলো।


কাঁপা কাঁপা গলায় সাদাব বলে উঠলো এটা কি ছিল? আমি জানিনা ভাই ফিরে চল এখান থেকে........আমি এখানে এক মুহূর্ত থাকতে চাইনা আর।


সৌনকের এবার আগের মত প্রতিবাদ করতে পারলোনা।সে নিজেও একটু আগে বিভীষিকাময় সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছে।কোনো উত্তর না দিয়ে ওরা ফিরে চললো।কিন্তু আকাশটা নিমেষে যেন নিজের রূপ পরিবর্তন করেছে। আতঙ্কটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে একটা দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।চারিপাশের জঙ্গলটা দুলছে একটা অদ্ভুত ছন্দে।ঠিক যেন সেই ভেঁপুর তালে।


সৌনক দাঁড়িয়ে পড়ে সাদাবকে বললো লোকগুলোর মত গাছগুলো দুলছে না।কিন্তু সাদাব কোনো উত্তর দিলোনা।সে তখন বিড়বিড় করে কি বেশ বলে চলেছে।দুজনে দ্রুত পা চালাতে শুরু করলো।কিন্তু সময়টা যেন ওই দমকা হওয়ার মতো দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সময়ের আগেই আজ সূর্য ঢাকা পড়ে চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে।


মাঠের আল দিয়ে ছুটে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়।শহরের লোকের পক্ষে তো একেবারেই নয়।যেভাবে হোক টাল সামলে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল এমন সময় দুর্যোগ বাড়তে শুরু করলো

ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি নেমে এলো।যেভাবে হোক ওরা ছুটে একটা কলা গাছের নিচে আশ্রয় নিলো।দুজনে হতবাক হয়ে গিয়েছিল এই আকস্মিক ঝড়ঝঞ্ঝায়।


সাদাব ফুঁপিয়ে উঠলো,সে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সৌনকের হাত চেপে ধরলো।


সাদাব- আমরা খুব ভুল করে ফেলেছি। আমাদের উচিত হয়নি এখানে আসা।আমি জানিনা আমরা বাঁচতে পারবো কিনা।আমরা......আমরা বাঁচবো তো?


বন্ধুর এই সহজ প্রশ্নটা কিন্তু সেই সময় খুবই জটিল বলে মনে হলো সৌনকের। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।কিন্তু লোভ.......লোভ নিজে বড় হওয়ার,লোভ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার,খ্যাতি, যশ ইত্যাদি বড়ই আকর্ষণীয়।ভয়ে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু একবার,শুধু একবার ঊর্ধির স্বরূপ ক্যামেরাবন্দি করার লিপ্সা মনের মধ্যে হিন্দোল তুলেছিল সৌনকের মনে।


সৌনক- সাদাব জীবনে একবার সুযোগ আসে খ্যাতিমান হওয়ার। আর ভাই এই সেই সুযোগ।কোলকাতার ছোট ফ্ল্যাটে আমি আর থাকতে চাইনা।আমি এই দেশের সর্বকালের সেরা সাংবাদিক হতে চাই। তুই আমাকে সাহায্য করবিনা বল।বল করবিনা?


সাদাবের কি বলবে খুঁজে পেলোনা, চোখের সামনে সে যেন দেখতে পেলো তার বন্ধু মৃত্যুর আগমন জেনেও নির্বিকার।এদিকে আলোর আভা ক্ষীণ হতে হতে অন্ধকার হয়ে আসছিল।


সাদাব- অন্ধকার নেমে এলে আর কোথাও যেতে পারবিনা।চল.......


সৌনক চুপ করে কলাগাছের নীচে বসে আছে।সে এবার দৃঢ় কণ্ঠে বললো আমি যাবোনা।আমি কিছুতেই যাবোনা।যেতে হলে তুই চলে যা।


দুজনের ভিন্নমত পোষণের ফলে খানিক চোখ রাঙারাঙি আর বাকবিতন্ডা চলছিল।নিস্তব্ধ জঙ্গলে দুজনের কথাবার্তা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।শেষে একসময় সৌনক নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সাদাবের গলা চেপে ধরবে ঠিক সেই সময় ঈশান কোন থেকে একটা মর্মভেদী আর্তনাদ ভেসে এলো।পুরো জঙ্গলটা যেন সেই আর্তনাদে কেঁপে উঠলো।ধড়পড় করে উঠে সৌনক,সাদাবের কাছ থেকে ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে সেই দিকে অগ্রসর হতে গিয়েই একটা আছাড় খেলো।

গ্রামের মেঠো পথ বৃষ্টিতে আর চলার মত নেই।আল দিয়ে ঝরে ঝরে মাটি গলে গলে পড়ছে।রাস্তা অত্যধিক পিচ্ছিল। খানিক আগে বাকবিতন্ডা হলেও সব রাগ ভুলে সাদাব, সৌনককে ধরে তুললো।


সাদাব- দে, ক্যামেরাটা আমাকে দে?ওটা ভেঙে গেলে সব পরিশ্রম বৃথা।


সৌনক হাসলো।এরপর অতি সন্তর্পণে তারা এগিয়ে চললো জঙ্গলের ঈশান কোণ বরাবর। থেমে থেমে সেই আর্তনাদ স্পষ্ট ,আরো স্পষ্ট হতে লাগলো। না দেখেই সেই চিৎকার বুকে মধ্যে একটা ধারালো অস্ত্রের মত আঘাত হানছিলো।


বৃষ্টি তখনো থামেনি,তবে তার তীব্রতা খানিক কমেছে।লতাপাতার আবরণ সরিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতেই দূরে একটা জিনিস দেখে সৌনক থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লো।


সৌনক- সাদাব ক্যামেরাটা অন করে রাখিস। আর আমার কিছু হলে এক মুহুর্ত এই জায়গায় দাঁড়াবিনা।দৌড়োবি যে দিকে পারবি।


সাদাব এবার নিজের ওপর ঠিক রাখতে পারলোনা

তোর কিছু হলে মানে। তুই কি সত্যি পাগল হয়ে গেছিস।


সৌনক ভ্রু কুঁচকে একটা অদ্ভুত রকমের হাসলো,

যদি সত্যি তুই ঠিক করে এই এপিসোড শ্যুট করতে পারিস তাহলে আমি অমর হয়ে রয়ে যাবো। যশ,খ্যাতি,জনপ্রিয়তা তো মৃত্যুর পরেও পাওয়া সম্ভব তাই না, কি বলিস?


সৌনক কি বলছে এসব?


সাদাব কিছুক্ষন হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে ছিল সৌনকের কথাটা শুনে।তবে খানিকক্ষন পর ক্যামেরাটায় চোখ লাগাতেই ওর শরীর নিমেষে ঠান্ডা হয়ে গেল।সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

এ কি জিনিস?এ তো আজ আমরা দেখলাম।


সাদাবের কাছ থেকে সৌনক ক্যামেরাটা নিয়ে জুম করতেই ও নিজেও খানিকক্ষন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর পিছু ঘুরে রক্তবর্ণ চোখ করে বললো এই বাচ্চাটাকে আমি বাঁচাবো।আর নিয়ে যাবো কলকাতা।কারণ এই অলৌকিক কান্ড শুধু ক্যামেরাবন্দি করলেই মানুষ মেনে নেবেনা।চাই নিখাদ জলজ্যান্ত উদাহরণ।সে সাদাবকে কাছে টেনে একটা বুদ্ধি ঠাউরে ফিসফিস করে কানের কাছে বললো।


তবে সৌনকের কথা শুনে সাদাব কিছু উত্তর দেবে সেই সুযোগ সে পেলোনা।কারণ তার আগেই সৌনক পা বাড়ালো গ্রামের দিকে।সে আগে এগিয়ে যাচ্ছে।পিছনে হাত দশেক দূরে সাদাব।


চোখের সামনে এক সমূহ বিপদ জেনেও সে এগিয়ে চলেছে তার বন্ধুকে অনুসরণ করে।গ্রামের মধ্যে খোলা প্রাঙ্গনটা তখন মেতে উঠছে এক পৈশাচিক আনন্দে। বাবা মায়ের কোল থেকে ছাড়িয়ে একটি শিশুকে তারা খাঁচাবন্ধী করে নিজেদের প্রাণ বাঁচার আনন্দে মত্ত। মত্ত না বলে উন্মত্ত বলা সঠিক।দুপুরে ঠিক যেমন চোখে দেখেছিল সেরকমই দৃশ্য।তবে জলজ্যান্ত মানুষের এ হেন কাণ্ডকলাপ যেকোনো সাধারণ লোকের চিন্তার বাইরে।


আর তারসাথে অদ্ভুতসব উল্কিতে পুরো গ্রাম কেউ যেন রাঙিয়ে দিয়েছে।



গ্রামের সব লোক তখন, এক বিশৃঙ্খল ছন্দে এক হাত তুলে নাচ করছে আর থেমে থেমে হুট হুট হুট হুট বলে ধ্বনি তুলছে। খুবই সাধারণ সেই শব্দ ,তবে থেমে থেমে একযোগে উচ্চারণের দরুন সেই ধ্বনি ভয়ের এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আর মন এটা ভেবে চঞ্চল হচ্ছে যার জন্য এই আয়োজন,সে তাহলে কতটা বীভৎস হতে পারে?

উত্তরের দিকে চোখ যেতেই ক্যামেরায় দেখা গেল গ্রামের বাকি শিশুরা একটা ঘরে বন্ধী। তারা একযোগে ভয়ে চিৎকার করছে।তাদের আকুল বেদনা দেখে যেকোনো মানুষের মন গলতে পারে কিন্তু এই ঊর্ধির ভক্তদের নয়। দেবীর আহার জুটিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পেরে তারা আজ নিদারুণ খুশি।


নিথর হয়ে এই সব দৃশ্য সাদাব ক্যামেরা বন্ধী করছিল। হটাৎ করে গতকাল রাতে দেখা সেই ঊর্ধির উপাসক বেরিয়ে এলো ভগ্নস্তূপটা থেকে। আর করজোড়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে উঠলো উর্ধিইইইইই...ইইইই


কি বীভৎস সেই হুঙ্কার।একমুহূর্তের জন্য মনে হলো ক্যামেরাটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।কিন্তু যেভাবে হোক সাদাব চেপে ধরলো সেটা। তার ভয়ে ততক্ষনে গলা শুকিয়ে এসেছে।


উপাসকের চোখের দৃষ্টি নিতান্তই ভয়ানক।সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো,একটা খুলিতে করে খানিক রক্ত মুখে ঢালতেই সাদাবের শরীরে শিহরণ দিলো।

উপাসকের মুখের দুই ধার দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে।সে তখন নিজেই এক পিশাচের মতো হয়ে উঠেছে।


রক্তপান করে উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে সে নীচে নেমে এসে বাকিদের সাথে নৃত্যে যোগ দিলো।সকলে মিলে এরপর হুট হুট ধ্বনি তুলে নাচ করছে,সাথে ভেঁপু আর দামরুটার আওয়াজ পরিবেশটাকে ঘন ও জটিল করে তুলেছে। এই অস্বস্তিকর পরিবেশে একজন সুস্থ মানুষ কোনোমতেই নিঃশ্বাস নিতে পারেনা।

এই দৃশ্য দেখে চঞ্চল হয়ে উঠেছে মন। এরইমধ্যে হটাৎ করে উপাসক দাঁড়িয়ে পড়লো,আর ঘোলাটে চোখ করে একটা বাঁকা হাসি হাসতে হাসতে সোজা তাকালো সাদাবের দিকে। ক্যামেরায় সেই তীক্ষ্ণ চোখ ধরা পড়তেই সাদাবের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বরফের স্রোত নেমে গেল।কম্পমান হাতে ক্যামেরাটা ধরে থেকেই সে ফিরে তাকালো উপাসকের দিকে।


উপাসক- আমাদের উপাসনাকে কি রঙ্গ ভাবিস নাকি রে?


উপাসকের গুরুগম্ভীর আওয়াজে তখন সবাই নৃত্য থামিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে সাদাবের দিকে চাইলো।


উপাসক- রঙ্গ ভাবিস না কি? উত্তর দে...... উত্তর দে?


সাদাব নিথর হয়ে গেছে তখন।পেছন থেকে একটা সজোরে ধাক্কা দেওয়ায় সে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।আর সাথে সাথে সমস্ত লোকগুলো কর্কশ ভাবে খল খল করে হেসে উঠলো।


উপাসক- শহরের বাবু........শহরের বাবুর রক্ত ক্যামন হয় জানিনা।ওকে ধরে নিয়ে আয় আমার কাছে।


সাদাব কি করবে বুঝতে পারছিলোনা।সে উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে পালাতে যাবে ওমনি একটা ধরাম করে আওয়াজে সবাই পিছনে ফিরে তাকালো।চোখ যেতেই সাদাব দেখলো সৌনক শিশুটিকে কাঁধে তুলে ছুটতে শুরু করেছে আর ওর বন্ধ খাঁচাটা যে লোকটা দামরু বাজাচ্ছিলো তার মাথায় গিয়ে পড়েছে।লোকটা মূর্ছা গেছে.........


তৎক্ষণাৎ সাদাব ক্যামেরাটা তুলে উল্টোমুখে দৌড় লাগালো।পূর্বপরিকল্পিত ভাবে সাদাব জমির আল ধরে ছুটতে শুরু করলো।তাদের কথা ছিল দুজনে দুই দিকে ছুটে ততরাং এর কাছে এসে দেখা করবে।কিন্তু এই মধ্যিখানের সময়ে তারা একে অপরের চিন্তা না করে দ্রুত,অতি দ্রুত ততরাং এর পাড়ে এসে পৌঁছবে।


গ্রামের লোকেরা এই আকস্মিক ঘটনার জন্য তৈরি ছিলোনা।কিন্তু নিমেষের মধ্যে তারা বদ্ধউন্মাদের মতো কর্কশ সুরে হুট হুট ধ্বনি তুলে সৌনকের পিছু নিলো।


সাদাব ভাবলো পরিকল্পনা সফল হয়েছে, সবাই সৌনককে ধাওয়া করেছে।কিন্তু একবার পিছু ঘুরে তাকাতেই তার রক্তজল হয়ে গেল।কারণ সে দেখল তার পিছু নিয়েছে শুধু একজন।আর সে কেউ না, স্বয়ং উপাসক। আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে যেন তার দৃষ্টি থেকে।চিরাচরিত প্রথার ব্যাঘাতে সেই উপাসক আজ নিজে এক বর্বর জংলী পশুতে পরিণত হয়েছে।


সাদাব আর পিছনে না তাকিয়ে যেভাবে হোক ছুটে চললো। কিন্তু পরিবেশ খুবই প্রতিকূল তখন। বৃষ্টিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে সাথে পাল্লা দিয়ে বজ্রপাত।এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু না..........প্রানের ভয় যে তখন শক্তির সঞ্চার করছে।এই তীব্র বৃষ্টিতেও উপাসক অবলীলায় হেঁটে আসছে তার পিছনে।সাদাব মনে মনে ভাবল এভাবে সে পেরে উঠবেনা।কিন্তু সে কি করতে পারে......এই দানবপ্রমান উপাসক যে তাকে হাতের নাগালে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। ছুটতে ছুটতে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসেবে সে তার ছোট ছুরিটাকে চেপে ধরলো।এই ছুরিটা মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট নয় কিন্তু নিরস্ত্র,আতঙ্কিত সাদাবের মনে কিঞ্চিৎ সাহস যোগানের জন্য যথেষ্ট ছিল।অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে একসময় সে বুঝতে পারলো জমির আল প্রায় শেষ।তারমানে একটাই আর কিছু দূরেই ততরাং...........................


বাঁচার ক্ষীণ আশাটা এখন খানিক বৃদ্ধি পেয়েছে।কিন্তু জমির আল শেষ হবে.............ওমনি কে যেন তার ঘাড়ের কাছে একটা কামড় বসালো।যন্ত্রনায় সে কঁকিয়ে উঠলো আঃ করে।মাটিতে ক্যামেরাটা সজোরে পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে গেল।কিন্তু সেদিকে কোনো নজর নেই তার। একটা হিংস্র পশুর কামড়ে সাদাব প্রায় মূর্ছা যাবে এমন অবস্থায় সে প্রাণ বাঁচাতে তার ছুরিটা সজোরে বসিয়ে দিল সেই পশুর ওপর। তারপর এক ভীষণ আর্তনাদ। এমন আর্তনাদ ইতিপূর্বে কেউ কোনোদিন শুনেনি।বাজ পড়ার চেয়েও বেশি তার ক্ষিপ্রতা। সাদাব তার কাঁধ চেপে ধরে আহত অবস্থায় পিছু ফিরতেই দেখলো, উপাসক তার কাঁধ থেকে খানিকটা মাংস খুবলে নিয়েছে তবে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, সাদাবের ছোট ছুরিটা ওর চোখে গাঁথা।


সাদাব হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে দাঁড়ালো।ওর শরীরের সবটুকু শক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছে।কাঁধ থেকে ঝরে পড়া রক্ত বৃষ্টির জলে ধুয়ে মাটিতে কালচে রঙের সৃষ্টি করছে।

তবে এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে সে তখন একলা বসে আছে সদ্য আহত এক পাশবিকের সাথে।প্রাণ বাঁচিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে দাঁড়িয়ে, একবার উত্তরের দিকে তাকাতেই সে দেখল সৌনক ছুটে আসছে আর তার পিছু নিয়েছে সবাই।তবে ওটা কি ওর হাতে?

চকচকে সাদা মতো,যেটা বারবার ও পিছনে ঘুরিয়ে দেখাতেই গ্রামের লোকেরা পিছু হটছে।যন্ত্রণার কারণে সাদাবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল তাও ও বুঝতে পারলো এই সাদা জিনিসটা আর কিছু না দামরুর কাঠি।মনে মনে ঈষৎ হাসলো সে।


সাদাবকে আহত অবস্থায় দেখে সৌনক ঘাবড়ে গেল।সে ছুটে এসে সাদাবকে ধরে তুললো


সৌনক- কি হয়েছে ভাই? একি এত রক্ত কিভাবে?


সাদাব- এই পাষন্ডটা কামড়ে দিয়েছে ।তবে আমিও ছাড়িনি


সৌনকের চোখে তখন রাগের আগুন জ্বলে উঠেছে? সে গর্জন করে গ্রামবাসীকে বলে উঠলো তোদের এই পিসাচী উপাসককে আমি আজ মারবোই? এই দেখ,এই দেখ আমি কি করতে পারি......


গ্রামের লোকগুলো থমকে দাঁড়ালো। সাদাব কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দেখল সৌনক দু হাত তুলে দামরুর কাঠিটা বসিয়ে দিয়েছে উপাসকের বুকে।হিংস্র পশুর মত উপাসক চিৎকার করে উঠলো সাথে সাথে।তবে এই বীভৎস পাশবিক কাণ্ডের মধ্যে ভিকু চিৎকার করে সৌনককে বলে উঠলো বাবু ঈ আপনি কি করলেন? ঊর্ধির কাছ থ্যকে আর কেউ বাচবেক লাই.........উ আমাদের কাউকে আর ছাড়বেক লাই


গ্রামের লোকেরা হাঁটু মুড়ে হুট হুট শব্দ তুলে কাঁদতে শুরু করলো।সৌনকের এই রূপ সাদাব আগে কখনো দেখেনি। শহরের উচ্চ শিক্ষিত ছেলেটা আজ যেন নিজেই এদের একজন হয়ে উঠেছে।একটা প্রকান্ড শরীরের ওপর চেপে বসে দামরুর হাঁড়টা শুন্যে তুলে সে চিৎকার করে বলে উঠলো ঊর্ধি বলে কিছু হয়না।সব মিথ্যে।পুজো করবে তোর আমার করো।আমি তোমাদের মুক্তি দিলাম........


আত্মদম্ভ আর স্পর্ধাতে সে তখন উন্মত্ত। গ্রামের লোকেরা সৌনককে দেখে পিছিয়ে গেল। একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সাদাব নিজেও কেঁপে উঠলো।পরক্ষনে সৌনক তার রক্তমাখা হাতটা দিয়ে শিশুটিকে কাঁধে তুলে সাদাবকে বলে উঠলো চল।কিছু ভয় নেই।আমি নিজেই মুক্তিদাতা।আমি নিজেই সর্বেশ্বর।

এ কথা সৌনকের হতে পারেনা।এই ভাষা ওর নয়।কিন্তু তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত সাদাব ওকে অনুসরণ করলো।


রাস্তা দিয়ে ওরা এগিয়ে চললো সামনের দিকে।গ্রামের বাকি লোকেরা তখন উপাসকের দেহটাকে ঘিরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছে । কিন্তু সেটা হটাৎ করে থেমে গিয়ে,একটা ভয়ের চিৎকার শোনা গেল। এই চিৎকার শুনে যে কোনো লোকের হৃদস্পন্দন নিমেষে কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।পিছন ফিরে সাদাব তাকাতেই সেও ভয়ে পাথর হয়ে গেল।কারণ দেবীর আহারের ব্যাঘাত ঘটায় এবার দেবীর চরেরা তখন জেগে উঠেছে। তুমুল বৃষ্টিতে দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার মত ঠান্ডা আবহাওয়াটা নিমেষে দমবন্ধ হয়ে এলো।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাদাব সৌনককে ডাকতেই সৌনক ফিরে দেখলো জঙ্গলের গাছগুলোর লতাপাতা ঠেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে আধখাওয়া কয়েকটা লাশ।একসময় ঊর্ধির আহারগুলো আজ তার জন্য আহারের সংস্থান করতে তৎপর।


ভিকু- বাবুরা পাল্যান।আমার চেল্যাটাকে দেখবেন।


সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা দৌড়োতে লাগলো।কিন্তু না।আর উপায় ছিলোনা। চারিদিক দিয়ে তখন ঊর্ধির চরেরা তাদের ঘিরে ফেলেছে। আর তাদের মধ্যে একটা পরিচিত মুখ বেরিয়ে এলো।


- কি বাবুরা পাল্যাচ্ছেন কুথাকে? ই গ্রামে অল্যে যাওয়া জাবেক লাই। ইঁ হি হি হি


ভিকু ততক্ষনে এগিয়ে এসেছে তার ছেলের জন্য। সে বলে উঠলো বাবুরা আপনারা পাল্যান। উ মারা গেছে,উ আমার ভাই।


প্রেতাত্মাটা তখন খলখল করে হেসে উঠেছে। আপনারা চল্যা যাবেন তা সিম্পসন সাহেব জানেক তো?


দুজনে কি করবে বুঝতে পারছেনা তখনই আমড়া গাছের ডালের দিকে চোখ যেতেই তারা ভয়ে নিথর হয়ে গেল।দেখলো ডাল বেয়ে নেমে আসছে সিম্পসন সাহেব।তার আধটা মাথা কেউ যেন চিবিয়ে খেয়েছে,সাহেবের মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে রক্ত মেশানো লালা আর শরীর থেকে গলে গলে পড়ছে থোকা থোকা মাংসপিন্ড।


সৌনকের একবার মনে হলো হয়ত মৃত্যু এবার আসীন।তাই সে সব জেনেও যেন নির্বিকার।যেন কোনো মাকড়সার জালে জড়ানো কীট।আর হয়তো কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই সে মারা যাবে।


কিন্তু তা হলোনা।ক্ষিপ্র নেকড়ে বাঘের মত ভিকু ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো সিম্পসনের ওপর। আর সৌনক নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল।সাদাবের হাত চেপে ধরে সে প্রানপনে দৌড় লাগলো।পিছনে তখন মর্মভেদী চিৎকার, পৈশাচিক হাসি আর গ্রামবাসীর কান্না মিলেমিশে এক প্রাণঘাতী পরিবেশ।


সৌনক দৌড়োতে দৌড়োতে বলে উঠলো বুড়ো বাবার কাছে চল,উনি আমাদের বাঁচাতে পারবেন।


অমাবস্যার অন্ধকারে পথ চেনা তখন মুশকিল হয়ে উঠেছে।কিন্তু মনে হচ্ছে এই রাস্তাটা ধরে সোজা ছুটলেই ওরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে চলে যেতে পারবে।কিন্তু সেটা সহজ নয় কারণ শিশুটিকে কাঁধে নিয়ে সৌনক ততক্ষনে হাঁফিয়ে উঠেছে,এদিকে সাদাব নিজেও ভীষণভাবে আহত। শিশুটিকে মাটিতে বসিয়ে ওরা দুজনে একটু দূরে বসে খানিকক্ষন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।


চোখ ফিরিয়ে সাদাবের দিকে তাকাতেই সৌনকের মায়া হলো, সাদাব এর শরীর অনেকক্ষন রক্তক্ষরণে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।


সৌনক- আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই। আমার জন্য তোর এই রকম অবস্থা হলো।


সাদাব উত্তর দিলোনা।সে যেন কিছু দেখে চোখ বিস্ফারিত করে বসে আছে।


সৌনক- কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?


সাদাব এবারো কোনো উত্তর দিলোনা।ওর চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট।সে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে আঙ্গুল তুলে সামনের দিকে দেখালো,আর সেই দিকে তাকাতেই সৌনকের মনে হলো সে যেন প্রাণ হারিয়েছে। কারণ সামনে তখন শিশুটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধা।


এক প্রকান্ড দেহী বৃদ্ধা,কাঁধে ঝোলা,একরাশ জটা চুল হওয়াতে পাক খাচ্ছে আকাশে আর মুখে হিংস্র হাসি।


মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলনা ওদের।সাদাব কিছুক্ষনের জন্য নিজের সমস্ত ব্যাথা ভুলে গেল।সে ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো,মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোলো কয়েকবার।


বৃদ্ধা তখন হাসছে।কোলে শিশুটিকে বুকের মধ্যে সে জড়িয়ে ধরেছে।তারপর একবার বিশাল হাঁ করে আধকাটা জীবটা দিয়ে খোঁ খোঁ শব্দ তুললো।


নিমেষে বিদ্যুৎপ্রবাহের মত বুড়োসাধকের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো সৌনকের, " ও স্বরহীনা,বৃদ্ধা,অপয়া,একচক্ষু........"


নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিলনা ওদের।মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গলে আলোড়ন উঠেছে তখন।গাছপালাগুলো ঊর্ধির দেখা পাওয়াতে তালে তালে পিশাচের মত নৃত্য করছে।আর সে তখন শিশুটিকে কোলে নিয়ে পরমাতৃপ্তিতে হাসছে।


সৌনক কিছু বলতে যাবে ওমনি দৃঢ়, প্রাণনাসী একচক্ষু দৃষ্টি দিয়ে সে চাইলো সৌনকের দিকে।কি ভীষণ সেই চোখ।ঘন অন্ধকারের মধ্যেও চোখটা জ্বলে উঠলো স্ফটিক মর্মরের মত।তারপর শিশুটির মাথাটিকে সে নিজের মুখের মধ্যে পুরে গোৎ গোৎ শব্দ তুলে রক্তপান করতে শুরু করলো।

কি নিষ্ঠুর সেই চাউনি।কি নিষ্ঠুর তার শব্দ।স্বরহীনা হওয়া সত্ত্বেও তার রক্তপানের শব্দটা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।


সৌনক আর বসে থাকতে পারছিলোনা,সে নিজের মনকে শক্ত করলো। মনে মনে ভাবল এই পিশাচী কোনো দেবী নয়।কোনো যোগ্যতা নেই এর কারোর আরাধনা পাওয়ার।এ একটা অপয়া প্রেত যার সৃষ্টি হয়েছে রক্ত পিপাসা মেটানোর জন্য। একটা নিষ্পাপ শিশুর রক্ত পান করে যে নিজের ক্ষুধা মেটায় সে কোনো দেবী হতে পারেনা।

নিমেষে রাগের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো সৌনকের মনে।সে দামরুর হাঁড়টা চেপে ধরে চিৎকার করে আঘাত করতে গেল ঊর্ধির দিকে।


কি এ কি?


মন্দের দেবী ততক্ষনে জাগ্রত হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টিতে সে এক সামান্য পিশাচী ছিল কিন্তু আজ নয়। তার সৃষ্টিকর্তার বাঁধন ছাড়িয়ে সে এখন এই গ্রামের আরাধ্যা। তন্ত্রসিদ্ধরা যাকে বশ করতে পারেনি ,তাকে কি এক সামান্য মানুষ পারে? পারেনা.........


তাই দামরুর হাঁড় যথেষ্ট ছিলোনা।নিমেষে সৌনককে শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ঝোলা থেকে একটা হাঁড় বের করে সৌনকের বুক চিরে ফালফাল করে দিলো সে। সৌনকের নাড়ী ভুঁড়ি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই ঊর্ধির চরেরা ঝাপিয়ে পড়ে সেই রক্ত চাটতে শুরু করলো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বন্ধুর ছিন্নভিন্ন শরীরটা দেখে সাদাব আতঙ্কে চিৎকার করে মূর্ছা গেল।তার আর্তনাদ জঙ্গলের পৈশাচিক নিস্তব্ধতা ভেঙে বাইরে ছড়িয়ে পড়লো।


বৃদ্ধসাধক চমকে উঠলেন সেই আর্তনাদ শুনে।কম্পমান হাতে সাধনার মাদুলি চেপে ধরে ছুটে গেলেন দিবাডিয়া গ্রামের রাস্তাটার দিকে।কিন্তু যা দেখলেন তা তার ইন্দ্রিয়ের ভ্রম বলে মনে হলো।একটা চোখ মুছে পুনরায় তাকাতে তিনি দেখলেন কয়েকশো প্রেত গ্রামের দিকে নাচতে নাচতে ফিরে যাচ্ছে।তাদের হাতে কোনো মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ।সেগুলোকে তারা উল্লাস করতে করতে খাচ্ছে ও ইতস্তত ছড়াচ্ছে।তাদের সামনে একটা বিশালাকার মুন্ডহীন প্রেত মাটিতে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজ্ঞান হয়ে থাকা মানুষকে।তবে তারা যাকে অনুসরণ করছে তাকে দেখে সাধক বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন মাটিতে কারণ


সে ছিল আজ থেকে বহুবছর আগে তার গাছের আড়ালে দেখা একচক্ষু,স্বরহীনা,অপয়া পিশাচী যে কোলে এক শিশুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে অন্ধকারময় গ্রামের দিকে।


চারিদিকে হুট হুট ধ্বনিতে তখন গমগম করে উঠেছে।কারণ মন্দের দেবীর আবির্ভাব হয়ে গিয়েছে। আর আজ থেকে তিনি নিজেই নিজের আহার গ্রহণ করেছেন।বৃদ্ধ সাধক কেঁদে ফেললেন ওই দৃশ্য দেখে।তবে ওনার শব্দ ঢাকা পড়ে গেলো,

কারণ দেবীকে শান্ত করতে তখন দামরু বাজছে,

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

দুম দুম দুদুম

 

অশ্রুসজল চোখে সাধক দেখলেন মন্দের দেবী ও তার অনুচরেরা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।            







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror