নলেন গুড় তৈরির গল্প কথা
নলেন গুড় তৈরির গল্প কথা
শীতকাল মানেই পৌষ পার্বণ। পৌষ পার্বণ মানে পিঠে পায়েস। আর পিঠে পায়েস মানেই নলেন গুড়।খেজুর রস থেকে তৈরি গুড়কেই নলেন গুড় বলে বা খেজুর গাছের রস থেকে তৈরি হয় নলেন গুড়। বাংলায় জনপ্রিয় এই গুড়ের ব্যবহার ছিল প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ ভারতে । কারণ বাংলা-দ্রাবিড় অভিধানে ‘ণরকু’ শব্দের অর্থ হল কাটা বা ছেদন করা। অবার বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধান মতে নরুন বা নরশনি মানেও কিন্তু কাটা বা ছেদন করা। নরুন হল গ্রাম বাংলার নাপিতের ক্ষৌর অস্ত্র। খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে গুড় প্রস্তুতকারীরা প্রথমে দা বা কাটারি দিয়ে চেঁছে দেয় হয়। তারপর নরুনে দিয়ে ফুটো করে সেখান থেকে একটা বাঁশের ছিলা বা নল লাগিয়ে দেওয়া হয় হাঁড়ি পর্যন্ত, এই নল দিয়ে রস চুঁইয়ে হাঁড়িতে আসে। এর থেকেই এই গুড়ের নাম নলেন গুড় হয়।যাঁরা এই খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন তাদের বলা হয় শিউলি, কথ্য ভাষায় ‘গাছি’-ও বলা হয়। নলেন গুড় তৈরি করতে শিউলিদের ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত খাটতে হয়৷
নলেন গুড় তৈরি করার অনেক ধাপ আছে৷ প্রথম ধাপ হল ‘গাছ কাটা’৷ হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় হাল্কা শীত শুরু হয় , সেই সময় থেকেই গাছ কাটার কাজ শুরু করতে হয় শিউলিদের৷ প্রথমে খেজুর গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ কেটে ফেলতে হয় অধিকাংশ পাতা৷ এই কাজকে গ্রাম্য ভাষায় বলে ‘গাছ কাটা’৷
গাছ কাটা’র পর খেজুর গাছের একেবারে উপরের দিকে পাতার ঠিক নিচের কান্ড কেটে পরিষ্কার করতে হয়৷ পরিষ্কার অংশ চেঁছে পরিষ্কার করার পর খেজুর গাছের কান্ডের ওই অংশ কিছুটা নরম হয়ে যায়৷ তখন কান্ডের নরম অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটা কাঠি বা নল৷ এই কাঠি বেয়ে টুপটুপ করে বেরিয়ে আসে খেজুর রস৷ এই নল বা কাঠি সাধারণত বাঁশের কঞ্চির একটা অংশ কেটে নিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি মাঝখান থেকে চিরে ফেলতে হয়৷ ফলে মাঝখানে একটা সরু পথ তৈরি হয়৷ এই পথ দিয়েই রস বেরিয়ে আসে।
শীতের শুরু থেকে গাছে রস আসতে শুরু করে৷ তখন শুরু হয় নলেন গুড় তৈরির দ্বিতীয় ধাপ৷ সূর্য ডোবার আগে মাটির কলসি গাছে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দিতে হয় যাতে কলসির মুখটা কাঠির নিচে থাকে৷ সারারাত ধরে কলসিতে জমা হতে থাকে রস। পরদিন ভোরবেলা, সূর্যের আলো ফোটার আগে গাছ থেকে কলসি নামিয়ে নিতে হয়৷
নলেন গুড় তৈরির তৃতীয় তথা শেষ ধাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ৷ ভাল গুণমানের নলেন গুড় তৈরি করতে তৃতীয় ধাপে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার প্রয়োজন৷ মাটির উনুনে কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করে রস ফোটাতে হয়৷ রস ফোটার সময় তার মধ্যে বিশেষ ধরনের হাতা দিয়ে সারাক্ষণ নাড়তে হয়৷ মূলত নারকেলের মালার অর্ধেক অংশে লম্বা কাঠ লাগিয়ে এই হাতা তৈরি করা হয়৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে রস ফোটাতে হয়৷ যত সময় এগোয়, ততই নলেন গুড়ের গন্ধ পাওয়া যায়৷ গন্ধ যত বাড়বে, বুঝতে হবে গুড়ের মান ততই ভাল হচ্ছে৷
গুড়ের গুণমান রসের উপর নির্ভর করে৷ টানা তিনদিন রস সংগ্রহের পর বন্ধ করে দিতে হয়৷ একে বলে গাছের জিরেন৷ কারণ, প্রতিদিনই গাছে হাঁড়ি ঝোলানোর সময় কান্ডের কিছুটা অংশ চাঁছতে হয়৷ গাছকে জিরেন দিলে ওই তিন দিন, তা চাঁছতে হয় না৷ এর পর চতুর্থদিন বা জিরেনের পর প্রথমদিন যে রস সংগ্রহ করা হয়, তার স্বাদ অন্য রসের তুলনায় একেবারেই আলাদা৷ এই রস জিরেন-কাটের রস নামে পরিচিত৷ জিরেন-কাটের রস থেকে জিরেন-কাটের গুড় তৈরি হয়৷ এই গুড়ের স্বাদ সব থেকে ভাল৷