Sudip Hazra

Horror

3  

Sudip Hazra

Horror

প্রতিকৃতি

প্রতিকৃতি

10 mins
368


নাগপুর থেকে রায়গড়ে ফিরছিলাম। আমার পরিবার থাকে নাগপুরেই। কাজের সূত্রে রায়গড়ে আসা। একটি দু-কামড়ার ফ্ল্যাট নিয়ে একাই থাকি সেখানে। সপ্তাহের শেষে একবার করে বাড়ি যাই। সবার সাথে দেখা করে, একদিন থেকে পরদিনই ফিরে আসি রায়গড়ে। আজও তাদের সাথে দেখা করে আমি ফিরছিলাম রাতের ট্রেনে। ট্রেনের মধ্যে কখন যে আমার চোখ লেগে গিয়েছিল, তা জানি না। তবে ঘুম ভাঙল ট্রেনের এক বিষম ঝাঁকুনিতে। হাতঘড়িতে সময় দেখলাম; রাত্রি তিনটে দশ বেজে মিনিটের কাঁটা খানিক দক্ষিণে সরেছে। আর বোধ হয় ঘুম আসবে না। জানালা দিয়ে মুখ ঝুকিয়ে দেখি সেটা গুন্ডিয়া জংশন। মিনিট সাতেক মতো ট্রেনটি সেখানে দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করল। জানালা দিয়ে আসা হিমেল বাতাসে মনটা এতটাই ফুরফুরে লাগছিল যে, সেইসময় একটি বই পড়তে ইচ্ছে করল আমার। কাঁধব্যাগ থেকে বইটি বের করতে যাব; আচমকাই এক ভদ্রলোক কোথা থেকে এসে আমাকে বললেন...


-- কিছু যদি মনে না করেন, জানালার পাশের সিটটাতে আমায় একটু বসতে দেবেন?


-- হ্যাঁ! বসুন।


কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি সরে বসলাম পাশের সিটে। মন থেকে না হলেও, একজন বয়স্ক মানুষের অনুরোধকে ফেলতে পারলাম না। তারপর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন...


-- তা, কোথায় যাচ্ছেন আপনি?


-- রায়গড়।


-- আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি। বোনের বাড়িতে। শেষবারের মতো বোনের মুখখানা দেখে আসতে।


-- শেষবার কেন?


-- কতদিন যে আর বেঁচে থাকব, তা'তো জানি না। তাই এটাকেই শেষবার মনে করছি।


আমি কিছু বলতে যাব; তার আগেই ভদ্রলোক আবার বললেন...


-- আপনার সাথে আলাপ হয়ে বেশ ভালোই হল। অনেকক্ষণ একসাথে কথা বলা যাবে।


ভদ্রলোক যে মিশুকে স্বভাবের, সেটা তাঁর কথাতেই বোঝা যায়। আমিও দীর্ঘক্ষণ পর একজন কথা বলার মানুষ পেলাম। এমনিতে কারোর সঙ্গে যেচে আলাপ করা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। তবে কেউ যদি নিজে থেকে সেই কাজ করে, তখন আমি তার সাথে মন খুলেই কথা বলি। ভদ্রলোকের সাথে কথা হওয়ায় জানতে পারলাম; তিনি একসময় কলেজের প্রফেসর ছিলেন। সেইসাথে খুব ভালো ছবিও নাকি আঁকতেন। এখন তাঁর পরিবার বলতে কিছুই নেই। বিয়ে-থা করেন নি। পরিবারের অংশ বলতে কেবল সেই বোন। কথা বলতে বলতে একসময় অনুভব করি, আমার পায়ের উপর যেন কিছু একটা পড়ে আছে। সেটাকে তুলতে যাব; দেখি ভদ্রলোকের ব্যাগের চেনটি খোলা। বুঝলাম সেটা তাঁরই। হাওয়ার কারণে ব্যাগ থেকে উড়ে এসে পড়েছে। তবুও নিঃসন্দিগ্ধ হতে কাগজটিকে তুলে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম...


-- এটা কি আপনার?


-- আজ্ঞে হ্যাঁ! ব্যাগ থেকে পড়ে গেছিল বোধ হয়। দিন ওটা আমাকে।


কাগজটি দিতে যাব; হঠাৎই আমার নজর পড়ল কাগজে আঁকা মোহনীয় ছবিটির উপর। কী অপূর্ব সেই ছবি! দেখলেই যেন দু'চোখ স্থির হয়ে থাকে সেইদিকে। আমি বললাম...


-- বাঃ! ছবিটি তো ভারী চমৎকার। আপনি এঁকেছেন বুঝি?


-- না, এই ছবি আমার আঁকা নয়।


"ছবিটির চিত্রকর কে?" -- সেটা জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বললেন...


-- ছবিটি আপনার পছন্দ হয়েছে?


এমন অপরূপ সেই ছবি; অপছন্দের একটিও কারণ থাকতে পারে না। আমি বললাম...


-- এত অভূতপূর্ব ছবিটিকে কি কারোর পছন্দ না হয়ে থাকতে পারে?


-- আপনি চাইলে ছবিটি রাখতে পারেন। আমার তাতে আপত্তি নেই।


ছবিটির প্রতি আমার মোহিত হওয়ার ভাবটি বোধ হয় লক্ষ্য করেছিলেন ভদ্রলোক। তাই তিনি কথাটি বললেন। তবুও এত মূল্যবান একটি ছবি তো বিনা পয়সায় নেওয়া যায় না কারোর থেকে। তাই আমি জিজ্ঞেস করি...


-- তা এটার জন্য কত দিতে হবে আপনাকে?


মৃদু হেসে ভদ্রলোক বললেন...


-- এর মূল্য আপনি এখনই দিতে পারবেন না মশাই। এটা নিজের মূল্য নিজেই জোগাড় করে নেবে একদিন।


ভদ্রলোকের এই কথাটি আমার মাথায় ঢুকল না কিছুতেই। মৃদু হেসে তিনি আবার বললেন...


-- এই যে আপনি বিনা বাক্যব্যয়ে জানালার পাশের সিটিটি আমায় ছেড়ে দিলেন। মনে করুন সেটিই এর মূল্য। এতটুকুই বা ক'জনে করে?


আমি আর এই বিষয়ে কোনো কথা বাড়ালাম না। চমৎকার একটি ছবি যে বিনা পয়সায় পেয়ে গেছি, এটাই অনেক। ছবিটিকে ব্যাগে ভরে নিলাম। রায়গড়ে যখন ট্রেন দাঁড়ালো, তখন সকাল সাড়ে ন'টা বেজে গেছে। দু'জনেই নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। তারপর ভদ্রলোককে একটি রিকশায় তুলে দিয়ে আমিও অগ্রসর হলাম নিজের গন্তব্যের পথে।


সেদিন রাত থেকেই সূত্রপাত হল এমন কিছু ঘটনার; যা এর আগে আমার জীবনে কখনও ঘটেনি। রাতে শোবার আগে, পরদিন অফিসের জন্য ব্যাগটিকে গুছিয়ে রেখেছিলাম। ছবিটিকে ব্যাগ থেকে বের করে রাখি টেবিলের ওপরে। তারপর একটি বই নিয়ে চলে যাই বিছানায়। রাত্রে বই পড়তে পড়তে ঘুমোনোর অভ্যাসটা আমার চিরকালের। সেই রাতেও বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা খেয়াল নেই। মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল একটি বিশ্রী গন্ধে। আধঘুমো চোখদুটিকে মুছতে মুছতে নজর পড়ল টেবিলে রাখা ছবিটির ওপরে। সেটি থেকে উজ্জ্বল আলো বের হচ্ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম সেইদিকে। এমন মনে হচ্ছিল যেন, আমাকে জোর করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে সেই আলো। মনের অজান্তেই বসে পড়লাম টেবিলের সোজাসুজি রাখা চেয়ারটির উপর। নানারকম অস্ফুট শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমার কানের চারপাশে। ততক্ষণে অপরিচিত গন্ধটি মিলিয়ে গেছে। স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম ছবিটির দিকে। আমার চোখের পাতাকে যেন অদৃশ্য মায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেই ছবি। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না। একসময় দেখি, আমি এসে পড়েছি একটি সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায়। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। "এটা কোন জায়গা?" -- কথাটি মনে হতেই উঠে দাঁড়ালাম। তখনও সেই মায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, মাথাটাও টনটন করতে থাকে প্রবল। কাউকে ডাকবো কিনা, বুঝতে পারছিলাম না। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে হতভম্বের মতো এগিয়ে চলেছিলাম অজানা অন্ধকারের পথে। বেশ অনেকক্ষণ পর আবার নাকে এল বিদঘুটে গন্ধটা। আমার মন থেকে চেতনা, ভয় সব যেন হারিয়ে গিয়েছিল তখন। হয়তো সেই মায়াই আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছিল নিজের লক্ষ্যে। একসময় আমার হাত পড়ল একটি কাঠের দরজার ওপরে। আলতো করে খুললাম সেটিকে। এরপর আরও এইরকম চার-পাঁচটা অজানা দরজা খুলি। মাঝে মাঝে কয়েকটি পুরু মাকড়সার জালের ঘেরাটোপকে ভেদ করে অন্ধকারের গহিন কুয়াশায় এগোতে হয়েছিল। বুকের মাঝখানটা শুকিয়ে আসতে থাকে আমার। এইভাবে এগোতে এগোতে শেষ দরজাটা খুলে দেখতে পাই, একটি মেয়ে চেয়ারের উপর বসে মোমবাতির আলোয় কিছু একটা করছে। "কিন্তু এরকম একটা নির্জন, অন্ধকার ঘরে সে একা একা কি করছে?" -- মনে হতেই কৌতূহলবশত এগিয়ে গেলাম সেইদিকে। ঘরে ঢুকতেই গন্ধটি আরও জোরালো হয়ে উঠল। এতটাই বিশ্রী গন্ধ যে নাক চেপে রাখতে হয়েছিল। মেয়েটির কাছাকাছি গিয়ে দেখি, টেবিলের উপরে একটি কাগজ রেখে সে ছবি আঁকছে। "কিন্তু, ওটা কী!" -- মেয়েটি নিজের একটি হাত কেটে তার রক্ত দিয়ে ছবিটিতে রং করছে। সেটা দেখার পর আমার পা টলতে শুরু করল। পেটের ভিতরের নাড়িভুঁড়ি সব পাকিয়ে আসছিল। আমি আর্তনাদ করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম। আচমকাই আমার ভারাক্রান্ত দেহটি পড়ে গেল মাটিতে। তৎক্ষণাৎ মেয়েটি ঘুরে তাকালো আমার দিকে। সে কী বীভৎস, কদাকার রূপ! -- আমি তার বর্ণনা দিতে পারবো না। মেয়েটিকে দেখার পর আমার হৃৎপিণ্ড বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ইতিমধ্যে মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে একটি বাঁকানো ছুরি হাতে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমার শরীর আটকে গিয়েছিল মাটিতে। আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। কেবল নিজের প্রাণ রক্ষার একটা ক্ষীণ অভিপ্রায় ঘুরতে থাকে আমার মনজুরে। "কিন্তু কি করব? সমস্ত শক্তিই যে হারিয়ে গেছে আমার শরীর থেকে। আমি বেঁচে আছি তো?" -- ভাবতে ভাবতেই ততক্ষণে আমার একেবারে সামনে চলে এসেছে মেয়েটি। সচকিতে সে তার হাতের ছুরিটি ঢুকিয়ে দিল আমার বুকে। চারিপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। এরপর আর কিছুই মনে নেই আমার।


পরদিন সকালে যখন চোখ খুলি, তখন আমি ঘরের মেঝেতে পড়ে আর আমার পাশেই পড়ে আছে ছবিটি। ধরফর করে উঠে দাঁড়ালাম। গত রাতের ঘটনাটি তখনও ভাসছে আমার চোখের সামনে। "সেটা কি কোনো স্বপ্ন ছিল তবে, নাকি.." -- ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ গিয়ে পড়ল ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটির উপর আর আমি শিহরিত হয়ে গেলাম। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। আয়নার উপর যেটা ফুটে উঠেছিল সেটা আমি নই। একটা কুৎসিত, দুর্বল বৃদ্ধের প্রতিচ্ছবি ছিল সেটি। তার মাথার চুল সাদা এবং চামড়া কোঁচকানো। সেটা দেখার পর রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠি আমি। পরপর দু'দিন আমার সাথে একই ঘটনা ঘটতে লাগল। আমি নিজেকে একটা ঘরে বন্দী করে নিয়েছিলাম। ঠিক করে ঘুমোতে অবধি পারতাম না। স্বপ্নের মধ্যেও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকত সেই মেয়েটি। ক্রমশ আমার শরীর দুর্বল হতে থাকে। অফিসে যাই না, কারোর সাথে দেখাও করি না। চুপচাপ ঘরে বসে অপলক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকি ছবিটির দিকে। একা একাই বকবক করে চলি। নানান আজব ভাবনা ঘুরতে থাকে আমার সারা মস্তিষ্কে। ধীরে ধীরে উন্মাদের মতো হয়ে উঠতে থাকি নিজের সেই কুৎসিত প্রতিবিম্বটি দেখার পর থেকে।


আমার প্রথম দিন থেকেই মনে হয়েছিল, ছবিটাই যত নষ্টের গোড়া। কারণ ওটাকে বাড়িতে আনার পর থেকেই ঘটনাগুলো শুরু হয়েছে। একদিন আমি ছবিটিকে দলা পাকিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম নর্দমায়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ টেবিলে চোখ পড়তেই দেখি, ছবিটি যেখানে থাকার সেখানেই রয়েছে। তারপর ওটাকে নানারকম উপায়ে নষ্ট করার চেষ্টা করলেও শেষমেষ ব্যর্থ হলাম আমি। আমার কিছু ভালো লাগত না। দিনরাত শুধু ভেসে উঠত সেই কদাকার মেয়েটির মুখ আর আমি পাগলের মতো ছটফট করতাম। এরপর একদিন বিকেলে আমি বের হলাম; বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ছবিটি ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ওনাকে সেদিন রিকশাতে তুলে দেওয়ার কারণে ঠিকানাটি মনে ছিল আমার। ঠিকানার গন্তব্যে পৌঁছে বাড়িটি খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। বাড়ির কলিং বেল দু'বার প্রেস করতেই খুলে দিলেন একজন মহিলা। বললেন...


-- কে আপনি? কাকে চাই?


অস্ফুট কণ্ঠে উত্তর করলাম...


-- বয়স সত্তর-পঁচাত্তরের এক ভদ্রলোক সপ্তাহ খানেক আগে এসেছিলেন এই বাড়িতে। ওনার একটি..


কথাটি শেষ করার আগেই মহিলা বলে উঠলেন...


-- ও, আপনি আমার দাদার কথা বলছেন। কিন্তু উনি তো বেরিয়ে গেলেন দশ মিনিট আগে।


"ইনি কি সত্যিই সেই বৃদ্ধের বোন? দেখে তো আমার চেয়েও বয়সে ছোট মনে হচ্ছে।" -- কথাটি ভাবতে ভাবতেই অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি বলে উঠল...


-- আর কিছুক্ষণ আগে এলেই ওনার দেখা পেয়ে যেতেন। দাদা আজই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল।


সেখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে আমি ছুটতে থাকি স্টেশনের পথে। ছবিটিকে ব‍্যাগের ভিতর ভরে রাখলাম। স্টেশন অবধি যেতে হল না। মাঝ রাস্তাতেই দেখা পেয়ে গেলাম বৃদ্ধ ভদ্রলোকের। তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। কয়েকদিন আগে যাকে দেখে মনে হচ্ছিল, "সত্তর-পঁচাত্তর বয়সী এক বৃদ্ধ, আজ তার বয়সের এতটা পার্থক্য! চোখের ভুল নয়তো?" কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রলোক বললেন...


-- আমি জানতাম, আপনি ঠিক আসবেন। কিন্তু এতটা দেরি করবেন সেটা ভাবতে পারিনি।


আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম...


-- আপনি জানতেন? তার মানে এইসব আপনি ঘটাচ্ছেন?


কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ম্লান হাসলেন ভদ্রলোক। তারপর রাস্তার একধারে থাকা একটি বসার বেঞ্চের দিকে ইশারা করে বললেন...


-- চলুন, বাকি কথা নাহয় ওখানে বসেই বলা যাক।


তারপর দু'জনে গিয়ে বসলাম সেই বেঞ্চটির ওপর। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করি...


-- এই ছবিতে এমন কি আছে? যার জন্য আমার চেহারায় এত পরিবর্তন ঘটেছে।


মৃদু কণ্ঠে ভদ্রলোক বললেন...


-- একটি মেয়ের আত্মা।


-- আত্মা!


আত্মার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম আমি। সেইসাথে প্রবল বেগে কম্পিত হতে থাকল আমার হৃদয়। লোকটি বলতে লাগল...


-- হ্যাঁ, শুনুন তবে। আজ থেকে প্রায় তিনশো-চারশো বছর আগে মারলিন নামে এক রাশিয়ান মহিলা খুব ভালো ছবি আঁকত। সেই ছবিগুলো ছিল যতটা সুন্দর, তার রূপও ছিল ততোটাই কদাকার। বিশ্রি দেখতে ছিল বলে মারলিনের আঁকা ছবি কেউ কিনতে চাইত না। এমনকি বিভিন্ন আর্ট এক্সিভিশন থেকেও ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র রূপের কারণেই। তারপর প্রায় তিন বছর ধরে মারলিন নিজেকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। আর সেই তিন বছরে সে তার সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে আঁকে এই ছবিটা। মৃত্যুর আগে মারলিন অভিশাপ দেয় যে; যার কাছে এই ছবি থাকবে সেই ব্যক্তিকেও তার মতো জীবনের পীড়া ভোগ করতে হবে, যেটা সে নিজে করেছিল। পুলিশের লোক দরজা ভেঙে উদ্ধার করে মারলিনের কঙ্কালটির সাথে এই ছবিটিও। তারপর বিভিন্ন হাতবদলের মাধ্যমে এটি এসে পড়ে আমার কাছে।


-- আপনি এতসব কথা জানলেন কি করে?


-- আপনার মতো একদিন আমিও এই ছবির অভিশাপের হাত থেকে মুক্তি পেতে ঘুরেছিলাম অনেকের দ্বারে দ্বারে। তাদের মধ্যেই একজনের থেকে জানতে পারি এইসব ঘটনার কথা।


কিঞ্চিত রাগপ্রকাশ করে আমি বললাম...


-- তবে আপনি ছবিটি আমায় দিলেন কেন? আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা?


বেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে ভদ্রলোক জবাব দিলেন...


-- আপনার তো এই ছবিটি পছন্দ হয়েছিল। একবার এই ছবি যার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলে, ছবি গিয়ে পড়ে তার হাতে। আর তখনই পূর্বব্যক্তির শাপমুক্তি ঘটে। ক্রমশ তার চেহারাতেও পরিবর্তন আসতে থাকে। আমি না চাইলেও ছবিটি স্বেচ্ছায় আপনার কাছেই চলে যেত।


-- কিন্তু এখন আমি এটাকে আর নিজের কাছে রাখতে চাইনা। আপনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য ছবিটি আমি নিয়ে এসেছি।


ব‍্যাগ থেকে বের করে ছবিটি ভদ্রলোককে দিতে যাব; তার আগেই তিনি বললেন...


-- এই ছবি নিজের ইচ্ছাতে নেওয়া যায়, কিন্তু ফেরত দেওয়া যায় না। আপনি ফেরত দিলেও ওটা আপনার কাছেই থেকে যাবে।


ভদ্রলোকের কথা শুনে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম আমি। সমস্ত চেতনা লোপ পেয়েছিল আমার সেই মুহূর্তে। হতবুদ্ধি হয়ে জিজ্ঞেস করি...


-- তাহলে কি আমার মুক্তি নেই ছবিটির থেকে?


-- হ্যাঁ! কেবল একটিই মাত্র পথ রয়েছে। আর সেটা হল অপেক্ষা।


-- অপেক্ষা? কতদিনের অপেক্ষা?


-- সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে যেদিন এই ছবি অন্য আরেকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেবে, সেইদিনই মুক্তি পাবেন আপনি এই মেয়েটির অভিশাপ থেকে। আমার কাছে প্রায় আড়াই বছর ধরে ছিল এই ছবি।


ভদ্রলোক তারপর উঠে চলে গেলেন নিজের গন্তব্যের পথে। অসহায়ের মতো ছবিটি হাতে আমি বসে রইলাম বেঞ্চের উপরে। বিকেলের সূর্য ডুবে তখন আঁধার নেমে এসেছে। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোটি এসে পড়েছে আমার মুখের আঙিনায়। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। একটা গমগমে বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে উঠে অস্থির মনে ছবিটি হাতে নিয়ে এগোতে থাকি আমি। চিন্তা করতে থাকি, "আদেও কি এই ছবি আমায় মুক্তি দেবে কোনোদিন? কিন্তু কবে পাবো আমি মুক্তি? ছবিটি আমায় শেষ করে দিয়েছে এই কয়েক দিনে। নিজের ভিতরেই উপলব্ধি করতে পারি এখন, নিজের মৃত্যুযন্ত্রণাকে।"


ধীর পায়ে এগোতে এগোতে আচমকাই আমার চোখের উপর এসে পড়ল এক তীব্র আলোর ঝলক। মুহূর্তেই ছবিটি আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ল রাস্তার একপাশে। আমার শরীরের উপর দিয়ে সবেগে চলে গেল একটি মালবাহী লড়ি। চিৎকার করারও সুযোগ পাইনি। শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্য উন্মুক্ত ছিল আমার চোখের পাতা। দেখলাম ছবিটি হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে যাচ্ছে আর একইসাথে কানে এল রক্তহিম করা এক হাসির আওয়াজ। "ছবিটি কি তবে হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে চলেছে তার পরবর্তী শিকারের কাছে? তারও কি আমার মতোই পরিণতি হবে?" -- ভাবতে ভাবতেই দু'চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে আমার। চারিপাশে অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মাঝে সেই হাসিটিকেও শুনতে পেলাম না আর। একসময় প্রাণটা বেরিয়ে আসতে লাগলো আমার শরীর ছেড়ে। আমি মৃত্যুর পথে অগ্রসর হলাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror