ঋতু স্রাব
ঋতু স্রাব
'মা ও মা, মা' বলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো রিনার মেয়ে, তুলু।।
'কি হয়েছে? এমন করে কাঁদছিস কেন? কে বকেছে? দিদিমণি?'
'না কেউ বকেনি, মা আমি আর স্কুলে যাবোনা, আমায় আর স্কুলে পাঠিওনা'।
মেয়ের এমন কথা শুনে রীতিমতো হকচকিয়ে গেছে রিনা। কিসব বলছে মেয়ে।
রিনা তার একমাত্র মেয়ে তুলুকে ভীষণ ভালোবাসে। তাই এমন আচরণে সাধারণ ভাবেই যেকোনো মা ই ভয় পেয়ে যাবেন।
তুলুর বয়স মাত্র ১০বছর। এখন ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ওদের গ্রামের স্কুল তো। ছেলে মেয়ে সবাই একসাথেই।
তাই রিনার বুকে ঘনিয়ে এলো আচমকা গাঢ় কালো মেঘের ঘনঘটা। সেই মেঘ কিন্তু নিতান্তই বকাঝকা বিষয়ে নয়।। আরো অনেক বেশি তার থেকে, একটু গভীর ও।
মেয়ে তখন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। এতক্ষন খেয়ালই করেনি রিনা। মেয়ের কান্না ফের কানে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পায় ও। সঙ্গে সঙ্গে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ছোট্ট মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো" লক্ষী মা আমার, এমন ভাবে কাঁদে না। ভিতরের ঘরে দিদিমা শুয়ে আছেন, রাগ করবেন, এবার বলতো মা, কি হয়েছে? "
মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পেছনের দিকে ফিরলো।
রিনা প্রথমটা কিছু বুঝতে পারলো না। শেষে জামার নিচের অংশতে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে ও।
" একি!!! কিভাবে হলো?"
মেয়েকে ভয়ে বুকে টেনে নেয় ও। ধীরে ধীরে রিনার বুকের মধ্যে তৈরি হওয়া কালো মেঘ আরো ঘন হতে থাকে।
এখন কি করবে ও? কোথায় যাবে?
যদি লোক জানাজানি হয়ে যায়?? কিচ্ছু ভেবে পেলোনা রিনা।
মেয়ের জামা কাপড় তড়িঘড়ি পাল্টে দিলো রিনা।
স্নান করে খেতে বসানোর সময়, মেয়ে ফের কেঁদে উঠলো,
" মা খাবো না, পেট ব্যাথা করছে খুব,,"
রিনার চোখে জল। কি যে হলো হঠাৎ মেয়েটার। স্কুলে কিছু অঘটন হলো নাকি??
উফফ আর ভাবতে পারলো না রিনা। ভয়ে মুখ ঢাকলো শাড়ির আঁচল দিয়ে।
দুপুর গড়িয়ে রাত হলো। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল বলে দুপুরে আর কাঁদেনি।
কিন্তু দুশ্চিন্তার কালো মেঘ মোটেও রিনার মন থেকে যাচ্ছিল না।
গ্রামে তো তেমন কোনো ভালো ডাক্তারও নেই।
একজন আছে সে আজ বসে কিনা তাও তো জানে না ও। তাও কি একবার গিয়ে দেখবে??
রমেশ ও তো এখনো এলো না। এদিকে রমেশের মা বিকেলে উঠে জিজ্ঞেস করছিলেন " হ্যাঁ গা বৌমা, তুলু তখন ওই ভাবেই কাঁদছিলো কেন???"
" ও কিছু না মা, দিদিমণি বকেছে তো, তাই আর কি"
"ও,, তা ও এখনো ওঠে নি??"
" না একটু ঘুমোচ্ছে, ঘুমাক"
রিনার শাশুড়ি সব কিছুর জন্য রিনাকেই দোষারোপ করে।
রিনার মেয়ে হওয়াতে সেটা খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি ওর শাশুড়ি।
যাই হোক দুশ্চিন্তা চরম আকার নেওয়ার পর, আর দেরি না করে রিনা তার মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
তখন প্রায় রাত ৭:৩০ বাজে।
গরম কাল, তাও রাতের দিকে একটু ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তাই খানিকটা স্বস্তির কারণ।
" বৌমা, কই যাও?"
" এই একটু মানসী দির বাড়ি" বলেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় ও।
জানে মিথ্যে বলে এসেছে। কিন্ত তা ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই। শাশুড়ি জানতে পারলে সারা গ্রাম মাথায় করবেন।
মিনিট ২০ হাঁটার পর ডাক্তার বৈদ্যর বাড়ি পৌঁছায়।
রিনা দরজায় কড়া নাড়ে, " ডাক্তার বাবু আছেন নাকি?"
দু তিনবার কড়া নাড়ার পর একটা মাঝ বয়সী মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
"ডাক্তার বাবু আছেন?"
"হ্যাঁ বাবা একজন রোগী দেখছেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন"।
রিনা দরজার পাশে থাকা একটা কাঠের চেয়ারের উপর বসলেন মেয়েকে কোলে নিয়ে।
মেয়ে এখন শান্ত, কোনো সমস্যা নেই।।দিব্যি হাসছে।
তাও রিনার মন থেকে ভয় যায়নি।
মিনিট দশ পরে রিনার ডাক এলো, ভেতরে একটা চেয়ারে ডাক্তার বাবু বসে, তার সামনে প্রশস্ত একটা টেবিল, যা অধিকার করে আছে বিভিন্ন ডাক্তারি সামগ্রীতে।
" বসো" চেয়ার লক্ষ্য করে বললেন ডাক্তারবাবু।
"কি হয়েছে?? জ্বর নাকি?"
রিনা তুলুকে পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসিয়ে সব কিছু খুলে বললো।
ডাক্তার মুখ গম্ভীর, কিছু যেন খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবছেন।
এবার প্রশ্ন করলেন ডাঃ বৈদ্য
" এরকম আগে কখনো হয়নি? তাই তো?"
"না, আগে কোনোদিন হয়নি"
বেশ, বলে তুলুর দিকে এগিয়ে গেলেন।
তুলুর গাল দুটি টিপে প্রশ্ন করলেন" চকলেট খাবে??"
তুলু চকলেটের ভীষণ ভক্ত, ও জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
ডাক্তার বাবু তার টেবিলে রাখা একটা চকলেট দিয়ে প্রশ্ন করলেন।
" পেট এখনো ব্যথা?"
না ইঙ্গিত দিয়ে মাথা নাড়লো তুলু।
"আচ্ছা তোমায় কেউ মেরেছে??"
"না"
"কেউ তোমার হাত ধরেছিল?"
চকলেট টা মুখে পুরে ফের না বললো।
"কেউ তোমার গায়ে বা অন্য জায়গায় হাত দিয়েছে?"
না।
সব শুনে ডাক্তার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
"হুম" বলে সটান তাকালেন রিনার দিকে " আপনি যেটা ভাবছেন, ওইরকম কিছুই হয়নি, আপনার মেয়ের সাথে"।
তাহলে "রক্ত"??
আপনার মেয়ের ঋতুস্রাব হয়েছে।
রিনা যেন আকাশ থেকে পড়লো। এইটুকু ছোট্ট বয়সে ঋতুস্রাব?? এটাও কি সম্ভব?
ডাঃ বৈদ্য বললেন" হ্যাঁ সব সম্ভব, এটা এখন অনেকেরই হয়, বয়সের অনেক আগে,ভয় পাবার কিছু নেই।"
এই বলে ডাক্তারবাবু কিছু বড়ি দিলেন খেতে আর বললেন " পরিষ্কার কিছু ব্যবহার করবেন, না হলে জীবাণু সংক্রমের আশঙ্কা থাকবে"।
ঘন কালো মেঘ কিছুটা হালকা হলেও পুরোপুরি কাটেনি। অনেক রকম দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো রিনার।
রাস্তায় আসতে আসতে এইসবই ভাবতে লাগলো ও। শাশুড়ি কি বলবেন সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো এটাই।
বাড়ির কাছে এসে দেখলো সাইকেল রাখা। তার মানে রমেশ ফিরে এসেছে। রমেশ একটা ছোট কোম্পানির কেরানি।
যা মাইনে পায় তাতে কোনো রকমে দিন কাটে ওদের। তার উপর এইসব। উফফ ভাবলেও ভয় করতে লাগে রিনার। তুলুকে কোল থেকে নামিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়। প্রায় সাথে সাথেই রমেশ এসে দরজা খুলে দেয়।
"কোথায় গেছিলে এই রাতে?? মেয়ে কে নিয়ে?"
রিনা নিচু গলায় বললো ঘরে চলো কথা আছে।রমেশ কিছুই বুঝতে পারে না। শাশুড়ি কেমন যেন একটা সন্দেহের দৃষ্টি তে তাকিয়ে দেখে রিনা কে।
ঘরে ঢুকে রিনা সব কিছু খুলে বলে রমেশ কে। রমেশ চমকে ওঠে।।" একি!!! এই ছোট্ট বয়সে?? মা কি বলবেন?? পাড়ার লোকে কি বলবে?? আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারবোনা" বলে মুখ ঢাকলো ও।
রমেশ কেরানির কাজ করলেও অতটা ও শিক্ষিত নয়। তবে কিছুটা হলেও জানে। আর রিনা একটু পড়া লেখা করেছে তবে সেটা জানা আর না জানা সমান কারণ অত গভীর বিষয় ও জানে না। তবে বর্তমানে এইসব নিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রচার ও খুব মন দিয়ে শোনে। সেই শোনা কথা থেকেই ও বলে," দেখো এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, মেয়েদের এইসব তো হয়ই, এই নিয়ে ভাবার কোনো কারণ নেই"।
রিনার দিকে মুখ তুলে রমেশ বললো," তুমি ভুলে গিয়ে থাকতে পারো। আমি নই। শুধু মাত্র তোমার জন্য আমার বাবা মারা গেছিল,"।
রিনা হতভম্ব মুখে জিজ্ঞেস করে " কি?? আমার জন্য? আমি তো তোমার বাবার ভালোর জন্যই.........."
রমেশ রিনাকে, হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।।রিনা স্তম্ভিত হয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
চোখ গড়িয়ে জল নেমে আসে তার।
শাশুড়ির কানে সব কথা যেতেই চিৎকার করে ওঠে।
"আমি তো জানতাম ওই মুখ পুড়ি শয়তান,ও ডাইনি, এখুনি ঘর থেকে বের করে দে ওকে, না হলে সংসার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে, ও আমার বর কে খেয়েছে, এবার আমায়ও খাবে"।
উফফ কি কথা, নিশ্চিত মৃত্যু, রিনা দেখলো চোখের সামনে।
এমন কি করেছিল ও।। আজ হয়তো ওর শেষ দিন। ভয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ।
মনে পড়েগেল, সেই ৫ বছর আগের এমনি এক ঘটনার কথা। মনে পড়লেই গা শিরশির করে ওঠে ওর।
চারপাশে তার কেউ নেই। স্বামীও হাত ছেড়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিক,আগে মা।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে একটা চিৎকার শুনতে পেল বাইরে থেকে। তুলু আর রিনা দুজনেই অবাক। দরজা খুলে যেই বাইরে এলো দেখলো মা বুকে হাত চেপে মাটিতে শুয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। রমেশ জল আনতে ছুটলো।তুলু ভয়ানক ভয়ে কেঁদে উঠেছে। রমেশ কোনোরকমে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ছুটলো হাসপাতালের দিকে। গ্রামের আরকিছু জন লোক নিয়ে। বাড়িতে পড়ে রইলো উদ্বিগ্ন দুটো প্রাণী। তুলুর হাসপাতালে যাওয়া নিষেধ। এই অকারণে।
ধীরে ধীরে ফের মনে পড়লো সেই ৫বছর আগের রাত।।এইভাবেই শশুর বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন। রিনার তখন ঋতুস্রাবের ২য় দিন। অনেক বাঁধা সত্ত্বেও হাসপাতালে যায়, সেখান থেকে সামনের মন্দিরে, শুধু মাত্র প্রার্থনা করতে, যাতে বাবা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ভগবান তার কথা রাখেনি। পরেরদিনই মারা যান। আর এতে সব দোষ এসে পড়ে রিনার উপর।
নানান লোকে নানান কথা বলতে থাকে। খোদ মা ই বলেন" কি দরকার ছিল বাপু ওইসব নিয়ে মন্দিরে যেতে??, খেলে তো আমার বর কে চিবিয়ে, মুখ পুড়ি মর তুই"। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কথা।
সেই সব ভাবতেই রিনা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। উফফ না জানি আজ কি হবে?? কিভাবে এই রাত কাটবে? " হে ঈশ্বর বাঁচাও, মা কে সুস্থ করে তোলো"।ভেজা চোখে পাশ ফিরে যখন দেখে একি তুলু কই???।
"তুলু, তুলু," বলে ডাকতে ডাকতে যখন ঘরের বাইরে আসে, তখন দেখে তুলু ঠাকুর ঘরের সামনে বসে এক মনে ডাকছে মাকে " মা, আমার দিদা কে ভালো করে দাও না গো, দাও না"। ওর দু চোখ বেয়ে জল। নিচের দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো রিনা একি "রক্ত"।।
পরের দিন খবর এলো হাসপাতাল থেকে। রিনার দু চোখ বেয়ে জল।দুঃখের নয়,আনন্দের। মা ভালো আছেন।। ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার।
একটা মিথ্যা আশঙ্কাও মন থেকে দূরে চলে গেল।
যাক মেয়েটা আমার পেরেছে।। আর কোনো দিন যেন কারোর জরায়ু কাটতে না হয় ভগবান।
রিনার জরায়ু নেই। অনেক ইচ্ছে ছিল আর একটা ছেলে হবে। তুলু আর তিতান।
না, সে আশা আর পূর্ণ হয়নি।
সব শেষে পরে রইলো একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
এখনো অনেক জায়গায় ঋতুস্রাব কে একটা নোংরা , বাজে এবং অকল্যাণ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। তার জন্য এখনো অনেক মহিলা বিভিন্ন মারণ রোগে আক্রান্ত হন নোংরা ময়লা কাপড় ব্যবহার করার জন্য।
কিন্তু এটা জানা দরকার এটা একটা স্বাভাবিক পদ্ধতি। যা কোনো অংশেই খারাপ বা কুসংস্কার বা অকল্যাণ জিনিস নয়। বরং এটা একটা নতুন প্রানের আধার।। দয়া করে এটাকে অন্য পর্যায়ে না ফেলে স্বাভাবিক সুস্থ শারীরিক হিসেবেই দেখুন।। সমাজ পাল্টান।।