Anupam Rajak

Abstract Horror

3  

Anupam Rajak

Abstract Horror

রাজনর্তকী-২

রাজনর্তকী-২

6 mins
146



আমি ওখানে কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম তা বলতে পারব না। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন চাঁদ অনেক উপরে উঠে গেছে। মনে হচ্ছিল যেন জ্যোৎস্না স্নাত পৃথিবী আমার চার দিকে এক অপরূপ মায়াবী প্রকৃতির রচনা করে রেখেছে। আমার দেহ তখন কোন রকম পীড়া বা কষ্টের অনুভূতি থেকে নিষ্কৃত। এইরূপ অবস্থায় আমি অনেক্ষন ওখানে পড়ে থাকলাম। আসলে, আমাকে পড়ে থাকতে বেশ ভাল লাগছিল। নিঝুম রাতের জ্যোৎস্না ভরা চরাচর যেন সীমাহীন আনন্দের এক বিস্ময়কর পরিবেশ আমাকে চিরতরে গ্রাস করে ফেলছিল। কিছুক্ষণ পর একটানা নূপুরের শব্দ আমার কানে এসে বাজতে থাকল, ও তার সঙ্গে একটা নৈসর্গিক সুবাস আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে এক অদ্ভুত মায়াজালে মুখরিত করে রাখল। ধীরে ধীরে নূপুরের আওয়াজটা আমার দিকে এগিয়ে আস্তে লাগল। তখন পর্যন্ত আমি কাউকেও দেখতে পাইনি, কিন্তু, কারুর একটা উপস্থিতি আমি বেশ ভাল ভাবেই টের পাচ্ছিলাম। আর সে উপস্থিতিটা আমাকে কোনোরকম ভাবেই বিচলিত করছিল না। তার পরিবর্তে আমি যথেষ্ট আশ্বস্ত বোধ করছিলাম। আমি চোখ বুজে এই স্বর্গীয় অনুভূতিকে হৃদয় ভরে উপভোগ করে যাচ্ছিলাম। হটাত, মনে হল, যেন কেউ আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  

“তোমার কি হয়েছে বন্ধু?” কোন এক মেয়েলী কণ্ঠের সুমধুর আওয়াজের এই প্রশ্নে আমি চোখ খুলে চেয়ে দেখি, এক অপরূপ সুন্দরি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলাম। বললাম, “আমি যেতে যেতে কোন কিছুতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছিলাম। তারপর বোধয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিন্তু তুমি কে?” স্মিত হেসে আবার সেই একই রকম সুরেলা কণ্ঠে সে আমাকে বলল, “আমি রাজ নর্তকী, মৃন্ময়ী। তোমার আঘাত কি খুব গুরুতর?” আমি বলি, “না! না! আমি এখন বেশ সুস্থ। আমার কোন কষ্ট নেই। কিন্তু, এত রাত্রে তুমি এখানে কি করছ? আর এলেই বা কোত্থেকে?” আমাকে বধীর দিকে ইশারা করে সে বলল, “আমি রাজ সভায় নৃত্যরত ছিলাম। বাইরে, জ্যোৎস্নার আলোয় প্রকীর্তির রূপ দেখতে বের হয়ে তোমাকে এখানে পড়ে থাকতে দেখে, রাজ বৈদ্যের নিকট হইতে ঔষধি এনে তোমার ক্ষত স্থানে লেপন করে, তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম”। আমি তার অপরূপ সৌন্দর্যকে বিস্ময় ভরা চোখে দেখছিলাম। তার সুন্দর টানা টানা চোখ, দুধের মত ফর্সা মুখ, নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিত কলেবর আমাকে যেন তার প্রতি আকর্ষণ করে চলছিল। সে আকর্ষণকে উপেক্ষা করার মত শক্তি আমার ছিল না। আমি বললাম, “তুমি আমায় রাজ প্রাসাদ দেখাবে? আমার খুব ইচ্ছা আছে রাজ প্রাসাদ দেখার। তুমি দেখাবে আমাকে?” মৃণ্ময়ী বলল, “এ আর কি এমন বড় কথা? এস আমার সঙ্গে”। আমি তো একদম বিগলিত। এই প্রথম কোন রাজ প্রাসাদ দেখার সুযোগ পাব। খুশিতে আমার মন যেন নাচ করতে আরম্ভ করল। মৃন্ময়ী আমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। আমরা রাজ প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করলাম। কি কারুকার্য-পূর্ণ মুখসালা! প্রত্যেকটা থাম যেন সোনায় আচ্ছাদিত। ঘর গুল কত উঁচু! মৃণ্ময়ী আমাকে প্রত্যেকটা ঘর দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চলল। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চার দিকে তাকাতে তাকাতে অবাক হয়ে গেলাম। এক সময়, আমার মনে হল, যে, বহুত দেরি হচ্ছে; এবার ঘরে ফিরতে হবে। তাই বললাম মৃণ্ময়ীকে। সে আমকে মুখ্য দ্বারের কাছে এনে বলল, “আবার এস বন্ধু! আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব কিন্তু!” আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাইরে বেরলাম, তখন চাঁদকে ঠিক সেইখানেই দেখলাম যেখানে প্রাসাদে ঢোকার আগে দেখে ছিলাম। ঘরে যখন ফিরলাম তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। মা জিজ্ঞেস করলেন, “মেলা গিয়ে ছিলি?” আমি বললাম, “না মা! টিউশন থেকে ফিরতে একটু বেশী দেরি হয়ে গেল। তাই আর গেলাম না। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে সব ঠাকুর দেখিয়ে নিয়ে আসব”। মা বললেন, “তাই ভাল”। সেদিন রাত্রে আমি সুধু মৃণ্ময়ীর কথা ভাবতে থাকলাম। সে কি সুন্দর রাজ প্রাসাদে থাকে! কত ঘর, কত সৌন্দর্য ভরে আছে সে ঘর গুলয়। অনেক রাতে ঘুম এলে, সেই রাজ প্রাসাদ আর মৃণ্ময়ীকে স্বপ্নে দেখতে পেলাম। মৃণ্ময়ী আমাকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

এর পর বহুবার আমি রাত্রিবেলায় সেই বধীর রাস্তা হয়ে ফিরেছি, কিন্তু, আর মৃণ্ময়ীকে দেখতে পাই নি। আমার মনে একটা অজানা উদ্বেগ ভরে উঠতে থাকল। কি হল তার? কেন দেখা করছে না আমার সঙ্গে? মৃণ্ময়ীকে আর দেখতে না পেয়ে মনে একটা অবসাদ জেগে উঠল, যার অবসান হল কালী পুজোর রাত্রে। সেদিনও সেই রাস্তা হয়ে চারবাটিয়া থেকে ফিরছি। অমাবস্যার রাত বলে, ভীষণ অন্ধকার ছিল। আমি প্রায়ই ঐ রাস্তা ব্যাবহার করি বলে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। ঠিক বধীর কাছাকাছি এসে মনে হল যেন কেউ কাঁদছে। ক্রন্দনের আওয়াজ অনুধাবন করে এগোতে এগোতে যখন কাছে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন মৃণ্ময়ীকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সে তখন অঝোরে কেঁদেই চলেছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন ভাবে কাঁদছ কেন?” সে আমার দিকে তাকিয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠল। ওর কান্না দেখে আমারও কষ্ট হল। কিছুক্ষণ পর, নিজেকে সামলে আমার দিকে চেয়ে বলল, “যুবরাজ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। প্রাসাদ সম্পূর্ণ শোকাচ্ছন্ন। তুমি আমার খোঁজে এলেও আর দেখা হবে না, বন্ধু। জানি, তোমার খুবই কষ্ট হবে। কিন্তু, আর কিছুই হয়ত করার নেই”। আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। আমার এত স্বপ্ন, এত আশা সব কি এই ভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে! আমি যে একে বারে অথৈ জলে পড়ে যাব! আমার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মৃণ্ময়ী আমার চোখের জল নিজের হাতে মুছে দিল। ওর হাতের স্পর্শ পেয়ে আমার কি হল জানি না; তবে, আমি নিজেকে একটা দুর্গের প্রাচীরে বসে থাকতে দেখলাম, আর আমার কাছেই বসে আছে এক শ্যাম বর্ণা সুন্দরী । মৃণ্ময়ীর চেহারার সাথে তার কোন মিল নেই, কিন্তু, কোথাও কিছু একটা মিল নিশ্চয় আছে, যা আমি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়েও বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি মৃণ্ময়ীর দিকে তাকাতে, সে আমাকে বিদায় সূচক হাত নাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি স্থাণুর মত তাকিয়ে থেকে গেলাম সেই অভাবনীয় দৃশ্যের দিকে। এরপর একটা খুব ক্ষীণ, কিন্তু স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম, “তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে বন্ধু, কিন্তু, এখানে নয়, এই রূপে নয়। তুমি প্রতীক্ষা কর, আমিও করব। তবে, তত দিনে তোমার ভাগ্য অনেক বদলে যাবে। তুমি অনেক ঐশ্বর্যশালী হয়ে যাবে। তখন কি তুমি আমায় মনে রাখতে পারবে, বন্ধু?” আমি মনে মনে সুধু বললাম, “তোমায় আমি চিরদিনই মনে রাখব মৃণ্ময়ী। তোমায় আমি কখনই ভুলতে পারব না, কারণ, তোমাকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। 

এরপর, আমি কাছেই একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যাই, আমার রোজগার বাড়তে থাকে, বন্ধু মহল বদলাতে থাকে। কর্মব্যস্ততা বাড়তে থাকে। তবু, মৃণ্ময়ীর সেই স্নেহময় স্পর্শ আমার হৃদয়ের মাঝে একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থেকে যায়। জানতাম, মৃণ্ময়ীকে আর দেখতে পাব না। তার নূপুরের ধ্বনি আর আমার কানে এসে পৌঁছবে না, তার দেহের সেই অপূর্ব মিষ্টি সুবাস আর আমি ঘ্রাণ করতে পারব না; তৎসত্ত্বেও আমি বহুবার সেই অন্ধকার রাস্তা দিয়ে গিয়েছি, হৃদয়ের এক অপূরণীয় ক্ষতিকে প্রলেপ লাগানোর ক্ষীণ আশা মনের মধ্যে পোষণ করে গেছি। বার বার আমি সেখানে আশা নিয়ে গেছি, আর প্রত্যেক বার হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি, কিন্তু, প্রয়াসে কখনই ঘাটতি রাখিনি। মৃণ্ময়ীর স্মৃতি আমার হৃদয়ে বার বার সাড়া জাগিয়েছে, আমার উৎকণ্ঠাকে কখনই নির্বাপিত হতে দেয়নি। তার শেষ কথা, “তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে”; এটাই আমাকে আশাবাদী করে রাখল।  

চাকরিতে আমার উত্তরোত্তর উন্নতি হতে থাকায় খুব শিগগিরি আমার আর্থিক স্থিতির পরিবর্তন ঘটল। বাবার তৈরি ঘরটাকে আমি বাড়িয়ে দোতলা করে ফেললাম। বন্ধুবান্ধব প্রচুর বেড়ে গেল। সারা ভারত ঘুরতে থাকলাম বাবা-মাকে সঙ্গেকরে। তখন টিউশন করা ছেড়ে দিলাম। ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়ানোর পাট চুকিয়ে নিজের কর্ম সংস্থায় মন দিলাম। ধীরে ধীরে সবই ঠিক হতে থাকল। কিন্তু, আমার মনের মধ্যে যে উত্তাল আলোড়ন মৃণ্ময়ীকে নিয়ে ছিল, তা কোনোমতেই নির্বাপিত হল না। সময় সুযোগ পেলেই, আমি সেই বধীর দিকে রাত্রিবেলায় যাওয়া বন্ধ করতে পারলাম না। যদিও, তার দেখা আর কোন দিনই পেলাম না, আমার মনে বার বার একটা চিন্তা ঘুরে ফিরে আস্তে থাকল, “ও যে বলে ছিল, আবার দেখা হবে! কবে হবে? আর কোথায় বা হবে? এই ভাবেই, কখন যে সেই রাত্রের কথা মনের অতলে তলিয়ে যেতে থাকল তা আর আমি এখন মনে করতে পারছিনা। কিন্তু, মৃণ্ময়ী তার কথা ঠিকই রেখে ছিল। 

ক্রমশ: 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract