Ratna Halder

Crime Others

4  

Ratna Halder

Crime Others

শিকারীর দৃষ্টি

শিকারীর দৃষ্টি

6 mins
426


লাস্ট ট্রেনটা প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতেই স্টেশন এরিয়া সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায় । কাঁধের ব্যাগটাকে শক্ত করে চেপে ধরে প্রিয়া একটা লম্বা শ্বাস নেয় , যেন তলানীতে এসে ঠ্যাকা সাহসের ফানুসটাকে জোর করে ফুলিয়ে নিতে চায় । তিন বছরের চাকরী জীবনে এমন বিকট পরিস্হিতির মুখোমুখি সাতাশ বছরের মেয়েটাকে কখনো হতে হয়নি । অফিস ফেরত দেরি হলেও , এতটা দেরি হয়নি কোনোদিন । ঘড়িতে এখন রাত বারোটা বাইশ , সম্পূর্ণ ফাঁকা স্টেশনে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো স্ট্রিট ডগ গুলো ছাড়া আর দ্বিতীয় জনপ্রানী নেই । প্রিয়াকে একা প্লাটফর্মে দেখে দুটো কুকুর ওর দিকে লেজ নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে এলো , একটু খাবারের আশায় । 

কুকুর , বেড়ালের প্রতি অসম্ভব ভীত মেয়েটা হাত উঠিয়ে হ্যাট হ্যাট করে দু একবার তাড়া দিতেই সারমেয় দুটো লেজ তুলে উল্টো দিকে দৌড় দিল । হাফ ছেড়ে বাঁচলো প্রিয়া । এবার তাহলে বাড়ি ফেরার পালা .......

স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা পঁচিশ হয়ে গেছে , খুব জোরে পা চালিয়ে হাঁটলেও বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা বেজে যাবে !!!!! 


প্রিয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে , মোবাইলটাও ডেড হয়ে গেছে , অফিসেই একটু চার্জ দিয়ে নিলে ভালো হতো , কিন্তু ঐ লাস্ট মোমেন্টের মিটিং টাই সব পন্ড করে দিলো । না বাড়িতে একটা ফোন করতে পারলো , না দীপেনকে । 


" মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে !!!"নিজের মনেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পা চালালো প্রিয়া । স্টেশনের বাইরে এসে দেখলো , সারিবদ্ধ দোকানগুলোর প্রত্যেকটার ঝাঁপ বন্ধ , যে স্টেশন এলাকা দিনের বেলায় বা প্রতিদিন ওর ফেরার সময়েও লোকজনের হৈচৈতে ভরপুর থাকে , তাই আজ যেন শ্মশানের মতন নিস্তব্ধ । ভয়ের একটা চোরাস্রোত ধীরে ধীরে গ্ৰাস করে প্রিয়াকে । " এবারে কি হবে ? এতটা পথ ....... যাবো কি করে ?" নিজের মনেই ভাবে ও । কিন্তু উপায় তো নেই , বাড়িতে তো ফিরতে হবে .........


সাহসে ভর করে পা বাড়ায় ও । যতটা দ্রুত হাঁটা সম্ভব ওর পক্ষে ও হাঁটছে , কিন্তু পথটাও তো নেহাত কম নয় । ইস একবার যদি দীপেনকে একটা কল করা যেত !! ও ঠিক চলে আসতো........... দুজনের অফিস টাইম এক নয় , তাই আগে পরে ফেরে দুজনে , কিন্তু যত রাতই হোক প্রিয়া একবার আগে জানিয়ে দিলে , ও ঠিক বাইকটা নিয়ে হাজির হয়ে যায় কালু দার চপের দোকানের সামনেটায় । আজকেও অফিস থেকে বেরিয়ে একবার ফোন করেছিলো প্রিয়াকে , কিন্তু কাজের ব্যাপক চাপ থাকায় , প্রিয়া" busy right now , call you later" বলে ফোন কেটে দিয়েছিলো , ইস তখন যদি আন্দাজ থাকতো যে এই বিপদে পড়বে আজ , তবে নির্ঘাত বলে দিত ওকে নিতে আসবার জন্য ।চার বছরের রিলেশন ওদের , কিন্তু সম্পর্কটা এতটাই মজবুত যে বছর কুড়ির দাম্পত্য জীবনের মত দু'জনের বোঝাপড়া । দুজনে দুজনের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েও পরস্পরের পরিসরে নাক গলায় না । দুজনেই চাকরি করছে , নিজেদের আর নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য । সুপরিকল্পিতভাবে বিয়ে ও সন্তানের কথা ভাবতে চায় বলেই , বিয়ের আগে নিজেদের পায়ের তলার মাটিকে চায় মজবুত করতে । দীপেন যদি এতটা সাপোর্টিভ না হতো , তাহলে এভাবে সাতাশ বছরের যুবতী হয়েও বাড়ির লোকের ও আত্মীয়স্বজনের পরিকল্পনাকে ভেস্তে বাপের ঘরে বসে থাকতে পারতো না । ও ভালো বলেই তো নিজে এগিয়ে গিয়ে ওর আর নিজের বাড়ির লোকজনদের একত্র করে নিজেদের রিলেশনের কথা বলে , ঠিক দুই বছর বাদে বিয়ের সিদ্ধান্তোও জানিয়ে দেয় । ওর এই সৎ সাহসের জন্যেই তো মাথা তুলে সব কাদা ছোড়াছুড়ির মাঝেও শান্তির শ্বাস নিতে পারে প্রিয়া । 


নিজের মনেই এমন হাজার কথা ভাবতে ভাবতে দ্রুত হেঁটে চলেছে প্রিয়া , হঠাৎ দাসপাড়ার তিনরাস্তার মোড়ের মাথায় আসতেই তাল কাটলো । প্রিয়ার মনে হলো যেন , কেউ বা কারা ওকে এক নাগাড়ে ফলো করে চলেছে । চিনচিনে একটা বরফ জলের ধারা নেমে যায় যেন ওর শিরদাঁড়া দিয়ে । এত রাতে একা একটা মেয়ের পথ চলা যে কতটা ভয়াবহ , হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করে প্রিয়া , পায়ের বেগ আরোও বাড়িয়ে দেয় সেই সাথে । 

মাথা ঘেমে কানের পাশ বেয়ে ঘামের বিন্দু নেমে আসছে ক্রমাগত , বাহাতে বারবার কপাল আর গাল মুছতে মুছতে চামড়া জ্বলে যাচ্ছে । কিন্তু উপায় নেই , থামা যাবে না , পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ গুলো বড় স্পষ্ট হয়ে উঠছে , কাছে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে .....


গাঙ্গুলী বাড়ির মোড় ঘুরতেই পেছন থেকে ভেসে আসে টুকরো টুকরো কিছু কিছু কথা, 


" কি ভাগ্য মাইরি ..... আজ যে একেবারে চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে ...."


" আইটেম একেবারে খাসা , রসে ভরপুর কি বলিস ?? ফাটাফাটি সাইজ !!"


" আরে বা* ব্যাক সাইডটা তো দ্যাখ ........ আমার তো এখানেই ঝরে যাবে "


আরোও বেশ কিছু মন্তব্য ও অশ্লীল বাক্য ধেয়ে আসে প্রিয়ার দিকে , বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না , এই সবই ওকে উদ্দেশ্য করে বলা । স্কুল , কলেজ বা বর্তমান সময়ে অফিস করতে গিয়ে রাস্তা ঘাটে দু একটা কুমন্তব্য যে কখনো শুনতে হয়নি প্রিয়াকে , তা নয় , কিন্তু তাই বলে এমন অশ্লীল মন্তব্য কারো কাছে ও শোনেনি । যথারীতি ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওর । লোকগুলোর যে কি অভিপ্রায় , তা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় না ওর । পেছন ফিরে একবার লোকগুলোর দিকে তাকাতেই তিন জোড়া কামাতুর লোভী দৃষ্টি নিজের সর্বাঙ্গে অনুভব করে ওর শরীর শিউরে ওঠে । ক্ষনিকের জন্য মনে হয় যেন ও সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে আছে ঐ তিনজোড়া চোখের ক্ষুধার্ত দৃষ্টির সামনে। বড় অসহায় লাগে নিজেকে । সাইডে ঝোলানো ব্যাগটাকে বুকের ওপর চেপে ধরে প্রায় দৌড়তে থাকে ও , সাথে সাথেই পেছন থেকে ভেসে আসে 


" আরে আরে , পাখি যে পালাচ্ছে বা* ..... ধর ধর ধর ..... এত ডবকা মাল হাত ছাড়া হলে পস্তাতে হবে ।"


প্রিয়ার কান্না পেয়ে যায় , চোখের সামনে দীপেনের মুখটা ভেসে উঠতে থাকে ।মনে হয় , " আজ যদি কিছু একটা ঘটে যায় ও আমায় গ্ৰহন করবে ???? যদি না করে !! " 

পরক্ষনেই মন থেকে কুচিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে , প্রানপনে দৌড়তে থাকে । কোনদিকে যাচ্ছে ঠিক নেই , চোখের সামনেও সব কেমন যেন ঘোলাটে অন্ধকার অন্ধকার লাগছে । এদিকে পায়ের আওয়াজ আরোও এগিয়ে আসছে ...... আরোও কাছে চলে আসছে .... এই বুঝি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তিন জোড়া কামুক হাত ..................মাকে বুঝি আর দেখা হলো না ওর !!!!

হঠাৎ সামনের মোড়টা ঘুরতেই একটা জোরালো হলদেটে আলো আচমকা ওর ওপর আছড়ে পড়ে । ব্যাগটা ফেলে দিয়ে দুহাতে চোখদুটো আড়াল করে ও থেমে যায় । পিছনে না দেখেও বুঝতে পারে , ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকা লোক তিনটেও থেমে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায় । আলোটা চোখে সয়ে আসতে একটু সময় লাগে , ইতিমধ্যেই একটা পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসে " প্রিয়া !!! আজ এত দেরি হলো , একটা ফোন করবে তো , জানো কত চিন্তা হয় ........"


গলাটা শুনে ধড়ে যেন প্রান ফিরে পায় বেচারি , এতো দীপেন !!!!! ও কোন কথা বলতে পারে না , কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে দীপেনের গলা জড়িয়ে ধরে । লোক তিনটের দিকে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীপেন ওকে বলে " কি হয়েছে বলোতো ?"


চোখের জলটুকু মুছে প্রিয়া শুধু বলে 


" কিচ্ছু না ..... বাড়ি নিয়ে চলো ...."


ওর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দীপেন ওর পালসারটায় স্টার্ট দেয় । লোক তিনটের মুখের ওপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে গাড়িটা চলে যায় । আলো আঁধারি সর্পিল পথের বাঁক ঘুরে তিন জোড়া ক্ষুধার্ত কামুক দৃষ্টি নিজেদের সদ্য হাত ফস্কানো শিকারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে , তারপর একসময় তপ্ত নিঃশ্বাসে বুকের উদভ্রান্ত বিষাক্ত বাতাসকে শহরের ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে নিজেদের আস্তানায়। তাদের লোভাতুর দৃষ্টি রাস্তার ফাঁক ফোকরে অলিগলিতে ঘুরতে থাকে নতুন শিকারের সন্ধানে ।


                 সমাপ্ত




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime