স্মাইল প্লিজ
স্মাইল প্লিজ
আহাহাহা! সাজছে দেখ!! হুমম!! সব বুঝি, সব বুঝি। সত্যি মাইরি। এগুলোর কোনো মানে হয় না। তোমার বাবা মা ফিরবে তো কাল, দেখো, সব বলে দেব। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসেব নেব।
তনুশ্রী তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে। গুনগুন করে জনপ্রিয় হিন্দি রোমান্টিক গান গাইছে। বারবার বিভিন্ন টিপ কপালে লাগিয়ে দেখছে কোনটা তার পরা নীল টপটার সাথে ভালো যাচ্ছে। আজ সৌম্য আসবে, প্রথমবারের মত সারা দিন একসাথে তনুশ্রীর ফ্ল্যাটে থাকবে ওরা। তনুশ্রীর কতদিনের স্বপ্ন একসাথে সৌম্যর সাথে একটা দিন নিজের ফ্ল্যাটে কাটানো। এতদিনে তা পূরণ হতে চলেছে। বাবা, মা মামাবাড়িতে গেছে, আর তনুশ্রী কাজের দোহাই দিয়ে রয়ে গেছে বাড়িতে। খুব ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে ও।
কাল সকালে যখন তনুশ্রীর সাথে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তখন থেকেই দেখছি ও অন্যমনস্ক। ব্যাপারটা বুঝিনি তখন। ভাবলাম কোনো কারণে মন মেজাজ ভালো আছে হয়তো। তার আগেই তো হোয়াটস্যাপে যে ওনাদের কথা হয়ে গেছে তা তো বুঝিনি। কাল রাতে শুনলাম ম্যাডাম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে বলছেন “সৌম্য, মা-বাবা কাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। তুমি চলে এসো কিন্তু দশটা নাগাদই”। সারারাত কথা বললাম না, অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকলাম। বুঝলই না। আমার যে রাগ, অভিমান হচ্ছে, সেটা বুঝলই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেখো না কি করি!! বুঝবে!!
তনুশ্রীকে আমি না খুব ভালোবাসি। খুব ভালো মেয়ে, একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কত কথা আমার সাথে শেয়ার করেছে ও। শুধু আমি জানি। প্রতিদিনকার সমস্যা, হাজারো কাজের চাপ সবকিছু দিনের শেষে রাত্রিবেলা ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে। নিজে হালকা হয়। আমি ওকে আদর করে দেই। তারপর আকাশের চাঁদের আলো গায়ে মেখে কখন যেন দুজনে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার বাবা কে! আমার মা কে! তা আমি জানিনা। যখন বোঝার জ্ঞান হয়েছে তখন থেকে তনুশ্রীর বাবা, মা কেই দেখেছি আমার আদর যত্ন করছে, আমাকে বড় করে তুলছে। দেখতে দেখতে কখন যে এত বড় হয়ে গেলাম বুঝলাম-ই না।
সৌম্য ছেলেটা হয়তো খারাপ নয়। কিন্তু আমি ওকে মেনে নিতে পারব না। আমি সৌম্য কেন, তনুশ্রীর সাথে অন্য কোনো ছেলের সম্পর্কই মেনে নিতে পারব না, কিছুতেই না। যে সোফায় বসে তনুশ্রীর সাথে আমি টিভি দেখি, যে বিছানায় তনুশ্রীর সাথে আমি ঘুমাই, সেই বিছানায়, সেই সোফায় অন্য কেউ! এটা হতে পারে না। এটা আমি হতে দেব না।
বাহ রে বাহ! সকাল থেকে আমি যে কিছু খাই-ও নি আজ সেটাও খেয়াল নেই তনুশ্রীর। খাবার দিয়েছিল, কিন্তু আমি যে খেলাম না সেটা দেখার ধৈর্য্যটুকুও আজ নেই ওর। কত পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি ভুল করে একটা ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙে দিয়েছিলাম একদিন। তখন আমি বেশ ছোট। তনুশ্রীর বাবা আমাকে খুব বকেছিল। রেগেমেগে বলল “আজ খাওয়া বন্ধ তোমার”। কষ্ট পেয়েছিলাম, দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু সব দুঃখ, কষ্ট গলে গিয়েছিল যখন দেখলাম তনুশ্রী নিজের পাত থেকে খাবার নিয়ে নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এরকম কত ঘটনা বারবার মনে পড়ছে আজ। এতটা অবহেলা আমার সাথে ও আগে কখনো করেছে বলে মনে করতে পারছি না। আমি খাবোনা, কিছুতেই খাবো না। দেখি, ও কতক্ষন থাকতে পারে!
কলিং বেলের শব্দ জানান দিল সৌম্য এসে গেছে। শেষবারের মত চুলটা ঠিক করে নিয়ে দরজা খুলল তনুশ্রী। হাতে গোলাপ ফুলের বোকে, জামায় তনুশ্রীর পছন্দের পারফিউমের গন্ধ, টকটকে লাল জামা, গাল থেকে দামী আফটার-শেভের গন্ধ ভাসছে, সৌম্য দাঁড়িয়ে আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ। মুখে স্মিত হাসি। কত বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকা মুহূর্তটা অবশেষে হাজির হয়েছে আজ। গোলাপের বোকেটা পাশে নামিয়ে রেখে তনুশ্রীকে নিজের বুকে টেনে নিল সৌম্য। সৌম্যর বুকে মুখ গুঁজে তনুশ্রী লজ্জামাখা গলায় বলল “এই, দরজাটা তো বন্ধ করতে দাও। লোকে দেখে নেবে তো।”
সব সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে কিন্তু তনুশ্রী। কি করছে এটা ওরা! ছি! যেখানে আমি উপস্থিত, সেখানে এরকম ভাবে তনুশ্রী কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে না। নিজেকে আটকাতে পারলাম না। ধূসর রঙের কিসব ফুল এনেছে লোকটা। ছিঁড়ে ফেললাম সেগুলো, অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম যে চিৎকার করে যাব যতক্ষন না সৌম্য এখান থেকে চলে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত।
বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে তনুশ্রী। এরকমটা হবে ও আশা করেনি। সৌম্যও বেশ খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল
- ও মনে হয় আমাকে পছন্দ করছে না। আমি বরং আজ আসি।
তনুশ্রী সৌম্যর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল
- দাঁড়াও, আমি ওকে বোঝাচ্ছি।
সৌম্য একটু ভয় পেয়েছে বোধহয়। বেশ হয়েছে। তনুশ্রীকে বলল
- ও তো খুব রেগে আছে। দেখো, আমার আনা লাল টুকটুকে গোলাপগুলো কি অবস্থা করেছে!
ও, ওগুলো লাল বুঝি!? আমি তো আবার লাল, হলুদ রংকে ধূসর দেখি। সে যাই হোক, কেন ও আসবে! ঘরে আমি আর তনুশ্রী ছাড়া কেউ থাকবে না এখন। তনুশ্রীর বাবা মা এলে না হয় ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে সৌম্য আসবে নাকি আসবে না। এখন কিছুতেই ঢুকতে দেব না।
তনুশ্রী হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসল। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল
- কি রে? খুব রাগ হয়ছে বুঝি?
রাগ তো হয়েছেই। আমি আমার ভালোবাসার ভাগ অন্য কাউকে নিতে দেব না। তনুশ্রী তো আমাকে আদর করে যাচ্ছে। না, না। তবুও আমি গলব না। তনুশ্রী আমাকে আদর করতে করতেই সৌম্যকে বলল
- তুমিও একটু আদর করো না!
ও মা! সৌম্যও হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে আদর করছে তো। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমার রাগ কমে যাচ্ছে তো। একটা এরকম সিরিয়াস ইস্যু এইভাবে ধামাচাপা পড়ে যাওয়াটা কি ঠিক? কিন্তু আমার তো আদর খেতেও খুব ভালো লাগছে। কি সুন্দর করে আদর করছে ওরা। তনুশ্রী বলল
- তোমার এই নতুন দাদাটা কিন্তু তোমার জন্যও চিকেন এনেছে।
এই, চিকেন তো আমি খুব ভালো খাই। উমম! কি করব!! আর রাগ করে থাকতে পারছি না তো। সৌম্য বলল
- এনেছি তো। প্রচুর চিকেন, সফ্ট টয় এনেছি। কুকুরটা কি সুইট গো।
- এই, ওর একটা নাম আছে তো। ওকে ‘জনি’ বলে ডাকো।
- হাই জনি, আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে?
না, ইয়ে মানে ছেলেটা তো বেশ ভালোই। আমার জন্য কি সুন্দর খেলনা এনেছে। বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারলাম না, জানেন। তনুশ্রী আর সৌম্যকে আমিও ভালো করে আদর করে দিলাম। ‘সরি’ও বললাম কুঁই কুঁই করে ডেকে। আমি এখন খুব খুশি চিকেন আর খেলনা পেয়ে। আমাকে আর সৌম্যকে এক ফ্রেমে নিয়ে তনুশ্রী একটা সেলফি তোলার জন্য মোবাইলটা সামনে এগিয়ে ধরল।
- স্মাইল প্লিজ!