Sourya Chatterjee

Classics Others

4.7  

Sourya Chatterjee

Classics Others

সম্পর্ক

সম্পর্ক

6 mins
354


পল্লবীর ছোট মেয়েটা যে কি বদমাইশ হয়েছে কি বলব! বলা নেই, কওয়া নেই, হামাগুড়ি দিয়ে সোজা খাটের তলায় ঢুকে গেছে। ছায়াদি একটু বাথরুমে গেছিল, ব্যাস, ফাঁক পেয়ে খাট থেকে নেমে সোজা খাটের তলায়। সেটা দেখে পল্লবীর ছেলেটাও খাট থেকে নেমে খাটের তলায়। ছায়াদি ওদেরকে দেখাশুনা করে। ওনারও তো বয়স হয়েছে, একা দুজনকে বের করতে পারে নাকি! পল্লবী রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, তারপর কোনোরকমে দুজনকে বার করা হল। আর ওদিকে পল্লবীর খেয়াল ছিল না, তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে রান্নার গ্যাসটা কমিয়ে আসতে ভুলে গেছিল। কোনোরকমে ছুটে গিয়ে গ্যাসটা কমাতে গিয়ে গরম কড়াইয়ে হাত দিয়ে দিয়েছে ভুল করে। হাতে ফোস্কা পড়ে তো একাকার কান্ড। 


বরফ দেবার জন্য ফ্রিজ খুলতে যাবে, সে আরেক কান্ড! ডানপিটে ছেলেমেয়েদুটো একটা এক লিটারের জলের বোতল ফ্রিজ থেকে বের করে পুরো জল ফ্রিজের সামনে ঢেলে দিয়েছে। সেই জলে আছাড় খেয়ে পড়ে তখন পল্লবীর কি করুণ অবস্থা! কপাল ফুলে গেছে, কনুই ছড়ে গেছে। ওদিকে অবুঝ মনের বাচ্চা দুটো হাততালি দিতে দিতে খিলখিলিয়ে হাসছে। ছায়াদি দিশেহারা হয়ে পড়েছে, কি করবে বুঝতে পারছে না। 

স্বামী অফিসে ব্যস্ত থাকে এখন, জানে পল্লবী। তবুও একবার ফোন করল, খুব অসহায় লাগছে ওর, জ্বরও আসছে। একবার ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। স্বামী একটু বিরক্তি প্রকাশ করেও দায়িত্ব রক্ষার খাতিরে রাজি হলো। 

- লাই দিয়ে দিয়ে তো ছেলেমেয়েগুলোকে মাথায় তুলেছ। এখন সেই আমাকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে! ঠিকাছে, রেস্ট নাও। আমি যত তাড়াতাড়ি পারছি এসে তোমায় নিয়ে যাচ্ছি।

খুব দাদার কথা মনে পড়ছে পল্লবীর। দাদা থাকলে এখন ঠিক এক মুহূর্ত দেরি না করে পল্লবীকে নিয়ে ডাক্তারখানায় ছুটত। ছোটবেলা দাদাই হয়তো পল্লবীকে মারত। আবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেই দাদাই মা বাবার কাছে এসে হাপুস নয়নে কেঁদে আব্দার জুড়ত, “বোনকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারখানা নিয়ে চলো”। বোনের কান্নায় দাদার চোখেও কত সহজে জল চলে আসত, সেসব ভেবে পল্লবীর এখন মুখে হাসি ফুটে ওঠে। 

পল্লবীর দাদা পল্লবের বয়স তখন পাঁচ বছর হবে। তখন সে টুকটাক বুঝতে শিখেছে কোথা থেকে একটা পুঁচকে মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে তার আহ্লাদে ভাগ বসাচ্ছে, তার একার আদর খাওয়ার রাজত্বে ভাগ বসাচ্ছে। তাও সেই ভাগের পরিমাণ বেশি বই তো কম নয়। অত সহজে মেনে নেওয়া যায় বুঝি সব!! দাস কাকু আগে যখন আসত একটা বড় চকোলেট আনতো। বোন একটু বড় হবার পর দুজনের জন্য দুটো মাঝারি সাইজের চকলেট আনতে শুরু করল। এ তো অন্যায়, বেশ রাগ হত পল্লবের। তাই তো সমানে পল্লব ওর বোনকে বলত “জানিস, আমি হলাম আমার মায়ের ছেলে। তুই কিন্তু নস। আমরা যখন সমুদ্রে গেছিলাম তখন সমুদ্রের জলে ভেসে ভেসে তুই এসেছিলি। মা তোকে সেখান থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল”। কথাটা শুনে প্রথমে কিছুটা ফুঁপিয়ে কাঁদার পর পল্লবী যখন ভ্যা করে কেঁদে ফেলত তখন পল্লবও ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলত। নিখাদ অভিব্যক্তিতে ভরা একটা সম্পর্ক সোনালী স্বপ্নের রোদ গায়ে মেখে কখন যে আরো সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হল তা টেরও পায়নি ওরা। হাসি কান্না, সুখ দুঃখকে সমান ভাগে ভাগ করে নিয়ে বড় হয়ে উঠেছে ওরা। বিয়ের পর পল্লবী ব্যাঙ্গালোরে চলে এলেও দুজনের হৃদয় কোনো একটি অদৃশ্য সুতোর বন্ধনে আজও শক্ত করে বাঁধা।

তাই হয়তো কাকতলীয় ভাবেই পল্লবী চোট পাবার পরেই পল্লব ফোন করেছিল কিছু না জেনেই। কিংবা হয়তো অন্তর্যামী পল্লবীর চোট পাবার খবর পল্লবের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল মেঘ মারফত। খবর পেয়েই হাজারো দুশ্চিন্তা, বারবার ফোন করে খবর নেওয়া দেখে কে বলবে ছোটবেলা কতবার বোনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত ও-ই। “আমি ঠিক আছি রে” এর উত্তরে যখন প্রত্যুত্তর আসে “আমি বুঝতে পারি আমার বোনটা কখন ঠিক থাকে। তুই বললেই আমি মানব কেন?” তখন চুপ করে যায় পল্লবী। এই ভালোবাসা সত্যিই অনন্য। চোখ বন্ধ করে ভালোবাসাটাকে অনুভব করে পল্লবী। প্রায় দু হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা দাদার স্পর্শ খুঁজে পায় ও। এই তো, ঠিক যেন পাশে বসেই দাদা মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। 

ওমা! সত্যিই তো কনুইয়ে ছড়ে যাওয়া জায়গাটায় কে যেন মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। কান্ড দেখো! পল্লবীর ছেলে, বয়স এখনো পাঁচও হয়নি, সেই ছেলে অপটু হাতে মলম লাগাতে ব্যস্ত এখন। মেয়েটাও হামাগুড়ি দিয়ে মলম ভেবে ড্রেসিং টেবিল থেকে মুখে মাখার একটা ক্রিম নিয়ে এসে মায়ের হাতের ফোস্কাগুলোয় লাগানোর চেষ্টা করছে। বেমালুম যন্ত্রণা ভুলে ছেলেমেয়েকে বুকে টেনে নিল পল্লবী। চোখেমুখে স্নিগ্ধতা খিলখিলিয়ে হেসে বেড়াচ্ছে তখন। ছেলেটা জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে

- মা, তোমার ব্যাথা লেগেছে? ঠিক হয়ে যাবে দেখো।

পল্লবী আরো জোরে জড়িয়ে ধরে ওদের।

- না রে বাবা। ব্যাথা তো আর নেই। এই যে তোরা মলম লাগিয়ে দিলি। সেরে গেছে তো।

ছায়াদি একটু দূরে দাঁড়িয়ে এসব কান্ডকারখানা দেখে হাসে মিটিমিটি। কী সুন্দর হয় সম্পর্কগুলো। কলঙ্ক নেই, খাদ নেই , শুধু আছে একরাশ ভালোবাসা। ছায়াদি বলে

- মাকে কিসি দিয়ে দাও তো। তোমরা দুস্টু করেছ তো। দুস্টু করলে কিসি দিতে হয়। না দিলে মা তো কষ্ট পাবে।

পল্লবীর গালে দুটো স্নিগ্ধ, মিষ্টি চুমু আরো একবার স্মৃতির সরনী বেয়ে পল্লবের কাছে নিয়ে যায় ওকে। মা বলত “ বোনকে কাঁদিয়েছিস। ওকে চুমু খা। তা না হলে বোন কষ্ট পাবে কিন্তু। “ বোনের গলাটা ধরে নাকের উপর চুমু খেত পল্লব। কয়েক সেকেন্ডেই কান্না ভুলে আবার দাদার সাথে খেলায় মেতে উঠত ছোট্ট পল্লবী।

খুব ভালো লাগছে পল্লবীর। পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন ঢলে পড়ছে। পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে যেন আনন্দ আর নস্টালজিয়ার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছে পল্লবী। ছায়াদি বাচ্ছাদেরকে শেখাচ্ছে ঠাকুরের কাছে নমো করতে, যাতে মায়ের ব্যাথা আরো তাড়াতাড়ি কমে যায়। একটু দূরে বসে সেসব দেখে মিটিমিটি হাসছে পল্লবী। বারবার মনে হচ্ছে ছোট ছোট অনুভূতিগুলো কত সুন্দর হয়, কত মধুর হয়। 

দাদার সাথে ইচ্ছে হল অনুভূতিটা ভাগ করে নেবে। ফোন করল দাদাকে। ছায়াদি জিজ্ঞেস করল

- কাকে ফোন করছ গো? দাদাবাবুকে?

- না গো, তোমার দাদাবাবু ধীরেসুস্থে আসুক। আমি একবার আমার দাদাকে ফোন করছি

এখনই ফোন তুলছে না। উফফ! এই এতক্ষন ফোন করে করে দুশ্চিন্তা করে মাথা খাচ্ছিল, আর এখন ফোন ঠোন ফেলে রেখে কোথায় যেন গেছে।

প্রায় মিনিট কুড়ি পরে কল-ব্যাক করল পল্লব।

- কিরে দাদা! তুই..

- আরে ডাক্তার দেখালি? কি বললো ডাক্তার?

- হাপাচ্ছিস তো। 

- ধুর! তুই বল না কি বললো ডাক্তার!

- যাই নি রে এখনো। তোর ভগ্নীপতি রাস্তায় জ্যামে আটকে গেছে। এসে পড়বে এখুনি। তবে ব্যাথা এখন আর নেই বললেই চলে। শোন না!

- কি রে?

- জানিস আজ আমার পুচকে পুচকিকে দেখে খুব আমাদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। আমি ব্যাথা পেয়েছি বলে চুমু খেল, ঠিক তুই যেমন খেতি তেমন। তারপর কত কেয়ার করল। আমার শুধু মনে পড়ছিল আমাদের ছোটবেলার কথা। পুরো নস্টালজিক হয়ে পড়েছি রে।

- হি হি! জানিস তো তোর গলা শুনেই বুঝতে পারছি এখন তুই যে বেটার আছিস।

- ও, তারপর আবার ঠাকুরের কাছে নমো করেছে আমার পুচকেরা আমার দ্রুত সুস্থতা কামনায়। বাই দ্য ওয়ে, তুই ফোন ধরছিলি না কেন? অফিসের কাজ করছিলি নাকি বৌদির সাথে রোমান্স চলছিল? হুমম?

- হুট, সেসব না রে পাগলী।

- তবে?

- হাসবি না বল।

- না রে বল-ই না।

- আরে কি মনে হল। পাশের কালিমন্দিরটায় একটু ঢুঁ মেরে এলাম আর কি! 

হেসে ফেলল পল্লবী।

- এটা কি হল। বললি যে হাসবি না।

- আরে না রে আমার পুচকেগুলোর সাথে তোর এত মিল খুঁজে পেয়ে হাসলাম।

একটু শান্তিতে কথাও বলতে দেবে না। ওদিকে আবার চিৎকার শুরু হয়েছে।

- ছায়াদি! কি হয়েছে? চিৎকার করছে কেন?

- আর বোলো না। দেখো না কে তোমাকে বেশি চুমু খেয়েছে সেই নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছে। আর পারি না বাবা!

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দাদা জিজ্ঞেস করল

- কি বলল ছায়াদি?

- আরে, কে বেশি চুমু খেয়েছে আমাকে সেই নিয়ে ঝামেলা।

- সে তো হবেই। আমরা টেডিকে কে বেশি চুমু খেয়েছি সে নিয়ে ঝামেলা করতাম আর ওরা তো ওদের মাকে খেয়েছে। ঝামেলা হবে না?

এক সুতোর বন্ধনে সব সম্পর্ক - বর্তমান, অতীত, দাদা বোন, ছেলে মেয়ে – প্রত্যেকটা সম্পর্কই যেন নিজেদের অজান্তেই আবদ্ধ হতে থাকে। সূর্যের সোনালী আভা গায়ে মেখে চোখ বন্ধ করে সম্পর্কের জাল বোনা দেখে পল্লবী।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics