সোঁদর বুড়ি প্রসঙ্গ
সোঁদর বুড়ি প্রসঙ্গ
সোঁদর ব্রত,পৌষ সংক্রান্তিতে সুন্দরবন অঞ্চলে মহিলাদের দ্বারা পালিত ব্রত।পৌষ সংক্রান্তি বাংলার ঘরে ও বাইরে পালিত হয় মহা সমারোহে।এখন সোঁদর ব্রত তুলসী তলায় দেখা যায়। লক্ষ্মীর আটনের পাশে একটি ছোট্ট মাটির গর্ত করে তারমধ্যে একটি কুলেরডাল পুঁতা হয় ।গোবরের সোঁদর প্রতীক হলুদ ছোপান কাপড়ে ঢাকা।তীর ধনুকের প্রতীক রাখা পিছনে আর কূল সহ ডাল শীকার ও সংরহ সমাজের ইঙ্গীতবাহী।সামনে আলপনা ঢেঁকি পার রত মানুষ , কূলো, ইত্যাদি চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত সরঞ্জাম।
গোবরের তাল তৈরি সোঁদর বুড়ি বা গোবরবুড়ির গোবরের তাল সোঁদর মার বা সোঁদর বুড়ির প্রতীক। এটি মাতৃপূজার প্রতীক । সোঁদর বুড়ির মাথায় সিঁদূর টিপ দেওয়া হয় তা থেকে বোঝা যায় এটি নারী মূর্তির প্রতীক ।এর পাশে তীর ধনুক আর কূল সহ ডাল, হয়তো এক সময় আদি মানব সভ্যতার সুচনা প্রতীক, এটা প্রমান করে এক সময় মানুষ ফল মুল সংগ্রহ কারী ছিলো। এর ঠিক সামনে একটি ছোট্ট গর্ত জলাশয়ের প্রতীক যাকে যমপুকুর বলা হয়। মা তারা সন্তানের মঙ্গল কামনা করে এই যম পুকুরে কড়ি বা পয়সা দেন। সোঁদর বুড়ির সামনে যমগর্তে পয়সা ফেলে , তালপাতা টুকরো নাড়তে নাড়তে মাহিলারা বলেন, "সোদর যায় ভেসে, ওদোর আসে হেসে" আর এই গর্ত থেকে আঙুলে করে কাদা নিয়ে মায়েরা টিপ লাগিয়ে দেন সন্তানদের কপালে মঙ্গলকামনায়। জল-জঙ্গলজীবী সুন্দরবনের বাঙালি জনজাতির এটি একটি প্রাচীন সংস্কার প্রমান।
পৌষপার্বণের বাংলার লৌকিক এবং প্রাচীন পূজা এটি। এরকম অনেক ব্রত ছড়িয়ে আছে বাংলায় যেমন, পৌষবুড়ির শস্যের দেবী । লৌকিক পুজো তাই কোন মন্ত্র তন্ত্র নেই। আনুষ্ঠানিক পুজোর বালাই নেই।ছেলেপুলেরা কাঁচা বয়সে অনেকই পৌষবুড়ির তৈরি করেছি, সোদরবুড়ির সঙ্গে এর অনেকটা মিল আছে। সুন্দরবন অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তির দিন সোদর ব্রত পালন কারী মহিলারা আগেই বলেছি ।বাংলার কৃষিসংস্কৃতি আঞ্চলিকভাবে বৈচিত্র্য পূর্ণ। পৌষবুড়ির কথা বলতে হবে।অনেক জায়গায় পৌষসংক্রান্তির দিন সূর্য ওঠার পাঁচটা মাটির ঢিপি বানিয়ে , সেই ঢিপিগুলির বিশেষ পুজো হয় মুলোর শিকড় বা সরষের ফুল দিয়ে।আর পয়লা মাঘ তিনটি মাটির ঢিপিকে পুজো করা। এদেরকে ফসলের রক্ষক হিসেবে ধরা হয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি পৌষবুড়ি কে অলক্ষ্মী হিসাবে ই ধরা হয় । দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজার দিন যে অলক্ষ্মীকে বিদায় করা হয়, ভাঙাকুলো বাজিয়ে বিদায় করা হয় , অবজ্ঞা করে। লক্ষ্মী বা শস্যদেবতা। মা-লক্ষ্মীকে পূজার আগে তাই অলক্ষ্মী বিদায় হয়।পৌষবুড়ি অলক্ষী তা বিতর্কিত হলেও। পিঠে-পুলির লৌকিক দেবী কিন্তু এই পৌষ বুড়ি। পৌষবুড়ির প্রথম পিঠের ভাগ চাই তাঁর। পিঠে না পেলে রেগে যান তিনি।পৌষপার্বণের দিনে পিঠে বানাবার আগে চালগুড়ি আর ময়দা দিয়ে চোর-চুন্নি নামে দুটি নর-নারীর মূর্তি বানা্ন হয় ।চোর-চুন্নিকে নিয়ে গিয়ে পৌষবুড়িকে পিঠে খাইয়ে আসতে হয়। তার পর চোরপিঠে খায় সাধারণত অবিবাহিত পুরুষ।লোকবিশ্বাস ঐ পুরুষের তারাতারি বিয়ে হবে এই পিঠে খেলে। চুন্নিপিঠে খান যে মেয়ে মা হতে চাইছে ।। পিঠেপুলির লোক উৎসবে পৌষবুড়ির ট্রাজিক চরিত্র।পিঠে উৎসবের পরেরদিন এই পৌষবুড়িকে ছেলেরা পিটিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দেয়।
অলক্ষী বিদায়, পৌষ বুড়ির প্রসঙ্গ আনার কারণ একটাই। দেখুন দোলের হোলিকাদাহনের বা নেড়া পড়া উৎসবকে লক্ষ্য করুন। লোকইতিহাসের কোন নিগূঢ় সংকেত খুঁজে পাবেন।মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষ শাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হচ্ছে।অদিম সংস্কৃতি তথা দেব দেবী ভাবনাকে ক্রমশ বিদায় জানানো হয়েছে।বলতে পারেন লোক ধর্ম বিশ্বাসকে বিদায় দিয়ে শাস্ত্র পুরান সমর্থিত দেবদেবীরা জায়গা করে নিয়েছেন বাঙালির ঘরে।পৌষবুড়ির , অলক্ষী কিংবা সোঁদর বুড়ির স্থান একসময় হয়তো ঘরে ভিতরেই ছিলো সেখান থেকে চলে গেছে দরজায় বাইরে। তার মুছে সাফ করে দেওয়া হয়েছে বলেই এই ভাঙনের বা বিদায়ের প্রথা।

পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন একটা সুন্দর বনের ছবি বাজারে দেখতে পাবেন। সোঁদর ব্রত পালন করবেন মহিলারা পৌষ সংক্রান্তিতে ঘরে ঘরে। তাই কেউ কেউ দোকান নিয়ে বসে সেখানে।কুল সহ কুলের ডাল,লাউ পাতা,ধানের শীষ,আম পাতা ও ধানের শীষ ৩, ৭ বা ১৭ পর্যন্ত বিজোর সংখ্যায় একসঙ্গে বেঁধে বাউনি।আতপ চালের গুঁড়ো,সিদ্ধ চালের গুঁড়ো যা প্রতীকী পিঠে করতে লাগবে সব আছে ।আছে নলেন গুড়,পিঠে সরা ঢাকা সহ। তবে সবার ঊপরে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল নারকেল পাতার কাঠি যা ঝ্যাঁটা করতে লাগে তার খন্ড অংশ লাল সূতোয় বেঁধে ধনুক আর কাঠির তীর।এর দাম ৫টাকা । শীকার ও সংগ্রহ যুগের প্রতীক যা আজও সুন্দরবনের মানুষের উৎস চিনিয়ে দিতে ব্যাবহার হচ্ছে মহিলাদের ব্রততে।পৌষ সংক্রান্তিতে সুন্দরবনের মহিলাদের দ্বারা পালিত এই ব্রতকে কেউ বলেন সোঁদর ব্রত কেউ বলেন বাউনি পূজা । তবে নৃতাত্বিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে , এই ব্রত মধ্য প্রস্তর যুগের শেষ ভাগ থেকে চলে আসছে যখন সুন্দরবনের মানুষ শীকার ও সংগ্রহের জীবন যাপন করতো।
যদিও প্রত্নতত্ব, নৃতত্,লোকসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানের কাছে হেরিটেজ খোঁজ করে শুধু?হেরিটেজ মানে কি শুধু মাত্র ইংরেজ আমলে ১০০ থেকে ৩০০ বছরের তৈরী কিছু বিখ্যাত সৌধ বাড়ি ইত্যাদি বা রাজা রাজরাদের দ্বারা তৈরী মন্দির মসজিদ গীর্জা প্রাসাদ সৌধ ইত্যাদি। তাঁর বয়স হয়তো ১৫০০ -২০০০ , অনেক সময় ৪৫০০-৫০০০ হরপ্পা সংস্কৃতির আর -৮০০০-৯০০০যদি মেহরগড় প্রচীন হয় ।কিন্তু আমাদের চোখের সামনে আরো প্রাচীন বা আদিম সংস্কৃতির নিদর্শন রয়েছে সাধারন মানুষ সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছেন বহু বছর ধরে এই সব ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে তা আলোচনার অগোচরে রেয়ে গেছে।
আদিম কালের এই সংস্কৃতির শুরু এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।তাই অবিলম্বে সুন্দরবন সহ প্রান্তিক মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি সংরক্ষ্ণণ প্রদর্শন আলোচনা চর্চার প্রয়োজন।