Scarlett MonaLiza

Horror Fantasy Thriller

3  

Scarlett MonaLiza

Horror Fantasy Thriller

আঁধারের প্ল্যাটফর্ম

আঁধারের প্ল্যাটফর্ম

6 mins
231


কোচবিহারে পোস্টিং হয়েছে সমীর আলী। ট্রান্সফার লেটারটা পেতেই কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়েছে। ভোর ভোর উঠে স্টেশনে পৌঁছেও গেছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে শুনলো ট্রেন লেট। সমীর আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওদিকে কোয়ার্টার টাও পিছনে ছেড়ে এসেছে। এখন যদি আবার ফিরে যায় তাহলে আর আজ ট্রেন পাবে না। অগত্যা ঠিক করলো স্টেশনেই অপেক্ষা করবে। কুয়াশাবৃত ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে কোনার দিকে এখা বেঞ্চিতে লাগেজ রেখে বসে পড়লো। সংক্রান্তির আগে বোধয় এমনই ঠান্ডা পরে গ্রামাঞ্চলের দিকে। ওর মনে হলো কম্বল মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ একটু শুয়ে নেবে।

উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে দু-জন ঘমতাবৃত মহিলা ঝাঁট দিচ্ছে। তার কিছুটা দূরেই একজন দোকান খুলছে। সমীর আলীর মনে হলো এক কাপ গরম চা পেলে জমে যেত। হাতের পাতা দুটো একে ওপরের সাথে ঘষলো সে। দোকানীও ইতি মধ্যে সংসার সাজিয়ে ফেলেছে। উনুন জ্বালিয়ে কেটলি ছড়িয়ে দিল তার উপরে। সাথে নিজেও একটু হাত সেকে নিচ্ছে অগ্নিতাপে। কেটলি দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। সমীর আলী বুঝতে পরে চা-টা হয়ে এলো বোধয়। ওর মনে হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্ম টপকে ওই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে এক কাপ চায়ে চুমুক দিলে সব অলসতা কেটে যাবে। এই ভেবে সে দাড়িয়েছে এমন সময় খেয়াল করলো ঝাঁড়ুদারনি দু-জন উধাও হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার তার সময় নেই। গা-টা গরম করতেই হবে নইলে নিমনিয়া নিশ্চিত। একবার ভাবলো লাগেজ গুলো ওয়েটিং রুমে রেখে আসবে কিনা। তারপর মনে মনে নিজেকে বললো এই প্ল্যাটফর্মটা যে টিকে আছে এটাই অনেক, এর আবার ওয়েটিং রুম। নিজের মনে হেসে এগোলো। হটাৎ করে একটা ডাকে সে থমকে দাঁড়ায়। পিছন ঘুরে আশ্চর্য হয়ে যায়। সেই ঝাঁড়ুদারনি দু-জন দাড়িয়ে আছে এক হাত লম্বা ঘোমটা টেনে। পরনে কোনো শীত বস্ত্র তো নেই এমনকি দুজোরা চটিও নেই। এমন ন্যাতার মতো সারি জড়িয়ে তারা যে কিভাবে ঠাণ্ডা রুখছে তারাই জানে। তাদের মধ্যে একজন আবার বলে উঠলো সমীর আলীকে, সে যেনো প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে না যায়। সমীর আলী জবাব দিলো, সে চা খেতে যেতে চায় আর তার জন্য তাকে এই প্ল্যাটফর্মটা থেকে নামতেই হবে। এই কথা শুনে তারা একে ওপরের সাথে ফিসফিস করলো। যদিও তাদের নিজেদের মধ্যে যা কথাবার্তা হচ্ছিল সবটাই ঘোমটার আড়াল থেকে। ফলে তাদের মুখ এখনও সমীর আলী দেখতে পায়নি। ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, "আপনি এখান থেকে কোথাও যেতে পারবেন না। রাত তিনটে থেকে ভোরের আলো ফোঁটার আগে ওপদি যে এই স্টেশনে আসে সে আর কোনোদিন এখন থেকে বেরোতে পারেনা"। সমীর আলী কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। শুধু এইটুকু বললো, "তাহলে তোমরা কিকরে ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে এই প্ল্যাটফর্মে এলে?" তারপর জ্যাকেট, সোয়েটার, শার্টের হাতা তুলে হাতঘড়িটা দেখতে যাবে তখনই সবুজ আলো জ্বলে উঠলো, অর্থাৎ ট্রেন আসবে। ঘোমটার আড়াল থেকে সমীর আলীর প্রশ্নের ছোট্ট জবাব সোনা গেলো। "হাতঘড়িটা দেখলে বুঝতে পারতেন আমরা কিকোরে ওই প্ল্যাটফর্ম থেকে এই প্ল্যাটফর্মে এলাম"। "তাইবুঝি" বলে সমীর আলী হাতঘড়িটা দেখলো, আর সাথে সাথেই এই কনকনে হারকাপুনি ঠান্ডায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা ফুটে উঠল। বড়ো ও ছোটো, উভয় কাঁটাই তিনের ঘরে। ঘোমটা পরিবৃত স্ত্রী মূর্তি দুটির উদ্দেশ্যে সে বলে উঠলো, "এসবের মানে কি? আর তোমরাই বা কারা?" ওদের মধ্যে একজন বললো, "এটা যে বেগুনকোদর স্টেশন বাবু। এ তো কবেই পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। যখন এই স্টেশনে নেমেছিলেন মাস ছয়েক আগে কোনো লোক দেখেছিলেন আশেপাশে। যা দুয়েকটা ট্রেন যায় কোনো যাত্রী নামে না এখানে। যদিও দিনের আলোতে আপনিই বহুদিন পর নেমেছিলেন, কিন্তু আজ যে নামার উপায় নেই বাবু"। পাশের জন বলে উঠলো, "বড়ো ভুল সময় এসে পড়েছেন, কি আর করবেন এবার আমাদের সাথেই থাকুন"। সমীর আলী আর স্থির থাকতে পারলো না। এবার সে বলেই ফেললো, "কে বলেছে স্টেশনে কেউ নেই। আমি স্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বলেই জানতে পেরেছি আজ ট্রেন লেট। আর ওই চায়ের দোকানি তো দোকান খুললো। তোমরা কি যা তা বলছো। আমি তোমাদের সাথে থাকতে যাবই না কেনো?" যাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা, তাদেরই একজন বললো, "ঠিক করে ভেবে বলুন তো, যখন আপনি এই স্টেশনে প্রথমবার এসেছিলেন তখন কি আদেও আপনি স্টেশন মাস্টারকে দেখেছিলেন, না টিকেট নিয়ে খানিক এদিক ওদিক করে স্টেশন মাস্টারকে খুঁজে না পেয়ে সোজা গন্তব্যের দিয়ে হেঁটেছিলেন?" ছয় মাস আগের একটা কথা সমীর আলীর মনে পড়লো। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে পড়ন্ত। বর্ষার শেষে, শরতের শুরুর নীল দিগন্তে দলবদ্ধ বিহঙ্গেরা তখন সারি দিয়ে বাসায় ফিরছে। পেজা তুলোর মতো ছেড়া ছেড়া মেঘ ভেসে রয়েছে আকাশের বুকে। এসব দৃশ্য সে দেখছিল ট্রেনের জানলায় বসে। তারপর ক্যেচকুচ আওয়াজ করে ট্রেনটা এই বেগুনকোদরেই থেমেছিল। তিন সেকন্ড থেমেই আবার ইঞ্জিন চলতে শুরু করেছিলো, ততক্ষনে যদিও সমীর আলী লাগেজ নিয়ে নেমেই পড়েছিল। কিন্তু ভাঙ্গা স্টেশন ঘরের কাছে অনেক খুঁজেও স্টেশন মাস্টারকে সেদিন সে খুঁজে পায়নি। অগত্যা ঠিক করলো কোয়ার্টারেই যাবে। স্টেশন থেকে নেমে কপাল করে একটা সাইকেল রিক্সা পেয়ে গিয়েছিলো, আর তাতেই কোয়ার্টারের দিকে রওনা দিয়েছিল। পুরুলিয়ার এই স্টেট ব্যাংক ব্রাঞ্চে চাকরি করার সময় শুনেছিল স্টেশনটার সম্পর্কে। কিন্তু তখন অত পাত্তা দেয়নি কথাগুলোয়। কিন্তু আজ এই স্যাঁতস্যাতে শীতে, হাড় কম্পিত আবহাওয়ায় সেই ভৌতিক গল্পগুলো খুব মনে পড়ছে তার। এক সময় আকাশ কুচকে গুটিয়ে যায়। কালো মেঘ জমে আকাশ জুড়ে। এলোমেলো হাওয়া শুরু হয়েছে। কান ঢাকা টুপিটা সম্ভবত উড়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ল কিন্তু সেদিকে সমির আলীর খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি নিক্ষেপ হয়ে আছে আকাশের বুক চিরে নামতে থাকা হিলহিলে সাপোদের মতো অশান্ত বর্ষার দিকে। বাদলা হাওয়ায় সোয়েটার ভেদ করে হাড় ওপদি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় সমির আলী লক্ষ্য করে সামনে দাড়িয়ে কথা বলা সেই দুজন ঘমটাবৃত মহিলা উধাও হয়েছে। উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মেও চাওয়ালা সমেত গোটা দোকানটা উধাও। হটাৎ যে কোথা থেকে কি হয়ে গেল সে বুঝে উঠতে পারলো না কেবল এইটুকু ছাড়া যে তার সাথে অশোভনীয় কিছু হতে চলেছে। নইলে সে বেরোলো ভোর চারটে সাতান্ন দেখে আর এখন বাজে সোয়া তিনটে। ঘুমের ঘোরে এতটা ভুল দেখে কি বিপদেই না পড়েছে ভাবলো সমীর আলী। এই বৃষ্টি মাথায় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরণও তো দায়।

এসব কথা ভাবছে আবার সেই চেনা স্বরের ডাক। চোখ তুলে দেখে সেই দুজন ঘমটাবৃত মহিলা দাড়িয়ে আছে। এবার সমীর আলী বেশ বুঝতে পারছে কেনো শেডের বাইরে দাঁড়িয়েও তাদের শরীর ভিজছে না। ভয় ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে সে। উল্টো দিকের প্লাটফর্ম থেকে চা দোকানি চেঁচিয়ে বলছে, "কি বাবু চা খাবেন না?" মহিলা দুজনের মধ্যে একজন বলে উঠলো, "ট্রেন আসছে বাবু উঠবেন না?" এমন অভিশপ্ত বিভীষিকাময় রাত যেনো কাটতেই চাইছে না। সমীর আলী ভয় ভয় আবার হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় খুব বেশি এগোয়নি। অন্তত দু-ঘণ্টা তো অপক্ষেখা করতেই হবে সূর্যোদয়ের জন্য। আবার মহিলা কণ্ঠের স্বর বললো, "ট্রেন তো এসে গেলো বাবু"। সমীর আলীর দৃষ্টিও সেই দিকে নিক্ষেপ হয়। ট্রেনের গতির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো ট্রেনটা যেনো একটু দুলে উঠলো। তারপরই ঘটনাটা ঘটলো। প্ল্যাটফর্মের দিকে কাত হয়ে পড়ল আর সমীর আলীও তার নিচে চাপা পড়লো। অত বড় ট্রেন দূর্ঘটোনায় প্ল্যাটফর্মটায় ফাটল ধরে গেলো। কোনার দিকের দুটো থাম ছাড়া গোটা প্ল্যাটফর্মটা ধুলোয় মিশে একাকার।

ঘাম দিয়ে জর ছাড়ার মতো লাফ দিয়ে উঠে বসলো সমীর আলী। চোখ রগড়ে একটু ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারলো বড়ো সরো একটা স্বপ্ন দেখেছে। শীতের ভোরে বাঞ্জার প্ল্যাটফর্মে এমন একটা গা ছমছমে স্বপ্ন তার চেতনা উদাস করে দিলো। চঞ্চল চিত্তে উঠে বসলো বেঞ্চির উপর, দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে। সেখানে দু-জন ঘমতাবৃত মহিলা ঝাঁট দিচ্ছে। তার কিছুটা দূরেই একজন দোকান খুলছে। সমীর আলীর মনে হলো এক কাপ গরম চা পেলে জমে যেত। হাতের পাতা দুটো একে ওপরের সাথে ঘষলো সে। দোকানীও ইতি মধ্যে সংসার সাজিয়ে ফেলেছে। উনুন জ্বালিয়ে কেটলি ছড়িয়ে দিল তার উপরে। সাথে নিজেও একটু হাত সেকে নিচ্ছে অগ্নিতাপে। কেটলি দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। সমীর আলী বুঝতে পরে চা-টা হয়ে এলো বোধয়। ওর মনে হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্ম টপকে ওই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে এক কাপ চায়ে চুমুক দিলে সব অলসতা কেটে যাবে। এই ভেবে সে দাড়িয়েছে এমন সময় খেয়াল করলো ঝাঁড়ুদারনি দু-জন উধাও হয়েছে। এই দৃশ্যের আকর্শিকতায় সমীর আলী একটা ধাক্কা খেল। বুকটা ঢীপঢীপ করে উঠলো। সে বুঝতে পারছে এবার কেউ বা কারা তাকে ডাকবে, উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে যেতে নিষেধ করবে। হটাৎ মনে হলো হাতঘড়িটা দেখা দরকার। এই ভেবে বাঁহাতটা মুখে সামনে এনে জ্যাকেট, সোয়েটার, শার্টের হাতাটা একটু সরালো আর জীবনের সব থেকে বড় ভয়ের সম্মুখীন হলো। ঘড়ি জবাব দিচ্ছে সোয়া তিনটে। সমীর আলীর এবার আরো ঠাণ্ডা লাগছে। সৈত প্রবাহ বাড়ছে তার শিরায়, সাথে হালকা ঝড় শুরু হয়েছে। তারই মধ্যে খুব চেনা মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো। দেহাতি ভাবে তাকে ডেকে বারবার বারণ করছে উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে না যেতে। সমীর আলী জানে পিছন ফিরলেই এই কণ্ঠের মানুষের বা বলা যায় মানুষদের সে দেখতে পাবে। কিন্তু অদেও কি তাদের মানুষ বলা যায়?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror