SHUBHAMOY MONDAL

Drama Crime Thriller

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Crime Thriller

মায়া-মারীচ

মায়া-মারীচ

17 mins
391


একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট। দুর্ঘটনার কবলে পরে একটা গাড়ি। গাড়ির মধ্যে ভয়ানক আহত অবস্থায় পাওয়া গেলো একই পরিবারের তিনজনকে - স্বামী-স্ত্রী-কন্যা। তিনজনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, কন্যাটিকে জীবিত ও তার মা বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তার।

নয়ন, নিজে উকিল হলেও, তার অতি কাছের ঐ তিনজন মানুষের এই পরিণতিতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো সে! এর প্রায় মাস দুই তিন পর, ঐ দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া, তার সেই মাসতুতো বোন নিজের বাড়িতে ফিরলো।

কিন্তু মাস খানেক যেতে না যেতেই, আর এক বিপত্তি। হঠাৎ কিছুদিন ধরে তার মধ্যে নাকি স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ ধরা পড়ছে। খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। সব সময় কারা নাকি ওকে কি সব বলছে - ওর স্বর্গে যাবার সময় হয়ে গেছে, আর আয়ু নেই নাকি ওর - এইসব।

নয়নের এই বিষয়টা কেমন গোলমেলে লাগে। তার ঐ বোনের হঠাৎ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার কোন কারণ সে বুঝে উঠতে পারে না। তার হবু ভগ্নীপতি নিজে ডাক্তার, সেও চিকিৎসা করে হবু স্ত্রীকে সুস্থ করতে পারছে না দেখে, তার চিন্তা আরও বাড়ে। এরই মধ্যে একটা ভয়ানক জিনিস হাতে পেয়ে আরও ঘাবড়ে যায় সে।

তাই সে হাজির হয়, তার পুরানো পাড়ারই এক দাদা এবং শখের গোয়েন্দা হীরক সেন ওরফে হীরুর কাছে। হীরু নিজেও নয়নকে ছোট থেকেই দেখে এসেছে। তাই তাকে দেখে হেসে বললো - কি ব্যাপার উকিল ভাই, আজ এদিকে?

নয়ন - আসলে আমি এসেছি, একটা বিষয়ে তোমার সাহায্য দরকার, তাই। আমার মাসি এবং মেসোমশাই, মানে সর্বশ্রীর বাবা মা হঠাৎ মাস তিনেক আগে মোটর অ্যক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তুমি তো ওদের চেনো, আর ঘটনাটাও জানো!

সর্বশ্রীও চোট পেয়েছিলো, কিন্তু সেই শুধু প্রাণে বেঁচে গেছে। হাসপাতাল থেকে ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো - ওর হবু বর অমল। কিন্তু সে জেদ করে নিজের বাড়িতেই ফিরে এসেছে। তার জন্য, চব্বিশ ঘন্টা তাই একজন আয়াকেও রাখতে হয়েছে বাড়িতে।

এছাড়া, শারীরিক ভাবে বেশ কিছু কাজ করতে সে একা অক্ষম এখনও। তাই বাড়িতেই স্পেশাল মেডিক্যাল অ্যরেঞ্জমেন্টও করাতে হয়েছে। আমাদেরই আর এক বন্ধু, মিলন, যে ইঞ্জিনিয়ার, ওকেও তো চেনো তুমি, সে নিজে এসে ক'দিন ঐ বাড়িতে দাঁড়িয়ে থেকে, সে'সবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

যাই হোক, বেশ সুস্থই হয়ে উঠছিলো সর্বশ্রী, হঠাৎ তার মধ্যে নাকি স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ ধরা পড়ছে। খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। সব সময় কারা নাকি ওকে কি সব বলছে - ওর স্বর্গে যাবার সময় হয়ে গেছে, আর আয়ু নেই নাকি ওর - এইসব।

কেমন একটা আড়ষ্ট, ভীতু ভাব আর অসংলগ্ন সব কথাবার্তা বলছে। জীবনে বেঁচে থাকার যেন ইচ্ছেটাও সত্যিই ও হারিয়ে ফেলেছে। অমল তো দিনরাত তাকে নিয়ে পরে আছে, কিন্তু তার কোন বিশেষ উন্নতির লক্ষণ নেই। 

ওর সামনে প্রকাশ না করলেও, অমল নিজেও যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। সর্বশ্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসে তো, তাই ওর এই হাল দেখে সে বেচারা ভয়ানক ভেঙে পড়েছে। 

যাই হোক, আমি তোমার কাছে যে কারণে এলাম - মেসোমশাইয়ের ব্যাঙ্কের লকার থেকে গয়না গাটি ও জিনিসপত্র এনে রাখা হয়েছিলো সর্বশ্রীর আলমারীতে। সেদিন আলমারী খুলে টাকা বের করতে গিয়ে একটা ভয়ানক জিনিস পেলাম, এই দেখো - বলে, নয়ন একটা খাম এগিয়ে দিলো। 

হীরু খামটা খুলে দেখে একটি পারিবারিক ছবি - স্বামী স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, আর সামনের চেয়ারে বসে তাঁদের ফুটফুটে মিষ্টি মেয়েটি। তাঁদের দুজনের মাথার ওপর দুটো লাল ক্রস দেওয়া, আর মাঝখানে লেখা আজ থেকে মাস তিনেক আগেকার একটা তারিখ!

হীরু ভালো করে ছবিটা দেখে বললো - সর্বশ্রীর বাবা মা কি এই তারিখেই মারা যান? মানে এটা ওনাদের তিনজনেরই ছবি তো?

নয়ন ঘাড় নাড়ে - হ্যাঁ, সর্বশ্রী কিন্তু এই ছবিটার ব্যাপারে কিছুই জানে না বললো। তাহলে এটা কি হুমকি ছিলো কারও? ওর মা বাবা কি তবে অ্যক্সিডেন্টে মারা যায় নি, মেরে ফেলা হয়েছে? 

সর্বশ্রীর মধ্যে এই যে পাগলামির লক্ষণ ধরা পরেছে, এটাও কি রীয়েল? সেও আততায়ীরই আর একটা ষড়যন্ত্রের স্বীকার হচ্ছে নাতো? এই সব চিন্তা করেই তোমার দ্বারস্থ হয়েছি। 

তুমি তো জানোই, আমি ছোট থেকে ওদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছি। আমার সমস্ত পড়াশুনা ওদের ঐ বাড়িতে থেকেই কম্প্লীট করেছিলাম আমি। তাঁরা আমার নিজের মা বাবার থেকে তো কোন অংশেই কম নন আমার কাছে।

হীরু - তুমি বর্তমানে থাকো কোথায়, নিউ আলিপুর বললে তাইতো? সর্বশ্রী কি এখনও ঐ নিজেদের বাড়িতেই আছে? তাহলে আমি কেসটা নেবার আগে একবার সেখানে যাবো!

নয়ন - হ্যাঁ হ্যাঁ চলো না। আমার সঙ্গেই গাড়ি আছে, আর আমি এখন ওখানেই যাবোও ভাবছিলাম। তুমি কেসটা নিলে, আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হই। বুঝতেই পারছো, নিজের বোনের থেকে তো কম না সে। তাই দুশ্চিন্তায় আমিও নিজের কাজে কোন রকম কনসেন্ট্রেট করতে পারছি না।

দুজনে তখনই বেরিয়ে পরলো সর্বশ্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। হীরুর মাথায় তখন ঘুরছে বেশ কিছু জটিল চিন্তা ভাবনা - নয়নের ঐ কথাটা যদি সত্যি হয়, মানে সর্বশ্রীর বাবা মা যদি খুন হয়ে থাকে তো, ওর পাগলামির পিছনেও আততায়ীর হাত নেই - এমনটা তো আর বলা যায় না!

হীরু ওর ঐ মাসি মেসো সম্পর্কে একটু ডিটেলসে জানতে চাইলে, নয়ন জানালো - সর্বশ্রীর বাবা ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক, একটা ভীষণ নির্বিবাদী মানুষ। আর ওর মা ছিলেন গৃহকর্ত্রী ও বেশ নিষ্ঠাবতী পূজারিনী। দিনের অনেকটা সময় তাঁর ঠাকুর ঘরেই নাকি কেটে যেতো!

হীরুর দুশ্চিন্তা আরও বাড়লো - তাঁদের ঐ রকম সরল সাধাসিধে মানুষের পরিচয় পেয়ে। ঐরকম নির্বিবাদী মানুষের এমন শত্রু থাকা কি সম্ভব, যে তাঁদের প্রাণেই মেরে ফেলতে চাইবে!

কেসটা কেমন জটিলতর লাগছে, প্রথম শুনে যেমন সহজ লাগছিলো তার, তেমনটা নাও হতে পারে। খাবারে বিষক্রিয়া করিয়ে, মানুষকে পাগল বানিয়ে ফেলা - কোন নতুন বিষয় তো নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অমলের চোখে তো সে'টা ধরা পড়ে যাবার কথা! তাহলে - অন্য কোন রহস্য?

সর্বশ্রীর বাড়িতে গিয়ে, নয়ন নিজের চাবি দিয়েই মেন গেটের লক খুলে ভেতরে ঢুকলো। হীরুকে নিয়ে দোতলার ঘরে যাবার আগেই আয়াকে ডাক দিলো একটা। সর্বশ্রীর ঘর থেকে একটা বছর পঁচিশ ত্রিশেকের যুবতী, আয়া বেরিয়ে এসে তাদের নিয়ে গেলো ঘরে।


সর্বশ্রীর বিছানাটা বড় বড় নার্সিংহোমে ব্যবহৃত হয়, এমন মানের উৎকৃষ্ট শ্রেণীর একটি বেড। তার সাথেই অ্যাটাচ্ড আছে একটি অটোমেটেড অ্যালার্ম - প্রেসক্রিপশন মতো ঠিক তার খাবার সময় অনুসারে বাজে। তার এক পাশে মুভেবল ডাইনিং টেবল ও তার ওপরে খাবার মুখ পর্যন্ত এগিয়ে নেবার সুন্দর ব্যবস্থা। 

হীরু বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলো পুরো ঘরটা - সেই বেড, ডাইনিং টেবল, পিছনের বুকসেল্ফ, নতুন করে করা ওয়ারিংএর নকশা, লাইট, ফ্যান, সাউণ্ড সিস্টেম সবকিছু। আর সবথেকে বেশি নজর রাখলো সর্বশ্রীর মুখমণ্ডল, কথাবার্তায় তার অভিব্যক্তির প্রকাশ এবং আয়াটির চাল চলন ও হাবভাবের দিকে।

নয়ন সর্বশ্রীর সঙ্গে পরিচয় করালো হীরুর - শুধুই তার এক বন্ধু হিসাবে, যেমন প্ল্যান করে রেখেছিলো তারা। হীরু সারাক্ষণ চুপচাপ তাদের ভাই বোনের, আয়ার কথাবার্তা শুনে গেলো। শেষে একটাই প্রশ্ন করলো - ঘরের ওয়্যারিং কি রিসেন্ট পাল্টানো হয়েছে?

সর্বশ্রী জানালো যে, তাদের অ্যক্সিডেন্টের পর এই বাড়িতে ফেরার সময়, এই ঘরটাই তিন দিকে খোলা আর বেশ ভালো ছায়া পড়ে বলে - তার থাকার জন্য এটাকেই ঠিক করা হয়েছিলো৷ এই ঘরটা আগে খুব একটা ব্যবহার হতো না। তাই মিলন এসে ঘরের লাইট, পাখা, সাউণ্ড সিস্টেম, ওয়্যারিং সবকিছুই নতুন করে, একদম পারফেক্ট রিঅ্যারেঞ্জ করে দিয়ে গেছে।

হীরু - তুমিই বলে দিয়েছিলে কিভাবে তোমার এই ঘরে এগুলো সাজানো হবে? 

সর্বশ্রী - না না ও নিজের থেকেই করেছে। ওর টেস্ট আমার সাথে বরাবরই খুব ম্যাচ করে তো।

হীরু - তোমার বেডের নিচে একটা কুকুরের বগলেশ দেখছি, কুকুরটা কোথায়?

উত্তরটা দিল আয়া - কি হয়েছে ওর জানিনা, কিছুদিন ধরেই ভুলো কিছুই খেতে পারছে না, জানেন? খাবার দিলেই কেমন ভয়ে কুঁকরে যাচ্ছে। ভয়ানক শরীর খারাপ ওর। কি যে হলো ওর কে জানে?

হীরু - ওকে খাবার দেয় কে? 

সর্বশ্রী - আমি। আমি যা খাই, তাই নিজের পাত থেকে আলাদা করে, আগে ওকে দিই। ও আমার খাবারই খায়।

হীরু তখন নয়নকে বললো - তুমি ভুলোকে নিয়ে গিয়ে বরং তোমার বন্ধু, ঐ ভেটিরিনারী ডাক্তার, লক্ষ্মণকে একবার দেখিয়ে নাও না। নয়ন তার প্রস্তাবে সাগ্রহে রাজী হয়ে, ভুলোকে নিয়ে সেই গাড়িতেই আবার দৌড় দিলো। হীরুও তার সঙ্গে গেলো।

ডাঃ লক্ষ্মণ ভুলোকে ভালো মত করে পরীক্ষা করে বললো - ফোবিয়া, নিউরোসিসে আক্রান্ত হয়েছে ভুলো। যেভাবেই হোক সেটার প্রভাব খাবারের সঙ্গে জড়িত, আর তাই ঠিকমত না খাওয়ার ফলেই, ওর শরীর ভেঙে পড়েছে। ওর অন্য কোন রোগ নেই।

তাই, আপাতত ভুলোকে লক্ষণের তত্ত্বাবধানেই ছেড়ে, ফেরার রাস্তা ধরলো তারা। নয়ন কোর্টে গেলো, আর হীরু ঢুকলো লাইব্রেরীতে। গুচ্ছেন খানিক বই পত্র ঘেঁটে, কি কি সব নোট করলো সেখানে বসে বসে।

লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এসে, একটা কল করে অ্যাপয়ন্টমেন্ট নিয়ে, সে তখনই তার স্যার ও বিশিষ্ট মনস্তাত্বিক ডঃ এস আর অধিকারীর বাড়ি পৌঁছালো। প্রায় ঘন্টা খানেক তাঁর কাছে পরামর্শ নিয়ে, হীরু আবার সর্বশ্রীর বাড়িতে গেলো।

তার ব্রোচের একটা ডায়মণ্ড নাকি ওখানে পরে গেছে বলে জানালো সে সর্বশ্রীকে। তারপর, সেটা খোঁজার অজুহাতে, সে আবার তার ঘরের ওয়্যারিং, সেই বুকসেল্ফ, ডাইনিং টেবল, বেড, অ্যালার্ম - সব বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলো ভালো করে।

তারপর আয়াটির কাছে গিয়ে, তার সঙ্গেও বেশ ভাব জমিয়ে নিলো। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তার পুরো নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, আর আগে কোথায় কোথায় কি কি কাজ করেছে, তার সব ডিটেলস নিয়ে নিলো। 

ওখান থেকে বেরিয়ে, সোজা হাইকোর্টে নয়নের চেম্বারে গেলো। নয়নের সাথে ওখানেই কিছু কথাবার্তা বলে তাকে নিজের কনফিডেন্সে নিয়ে নিলো। তারপর তাকে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যেতেই হাজির হলো গিয়ে অমলের বাড়িতে। 

নয়ন তাকে জানালো যে হীরু তার পাড়ারই এক শুভানুধ্যায়ী দাদা। ওর মাসি এবং মেসোর মৃত্যু নিয়ে পুলিশের কিছু সন্দেহ আছে। এই বিষয়ে, হীরুও সেদিন স্পটে থাকায়, কিছু কিছু বিষয়ে নিজে থেকেই সে হেল্প করছে তাদের। সেজন্যই এখানেও আসা তার - সর্বশ্রীর চিকিৎসার বিষয়ে কিছু নাকি জানার আর বলার আছে। 

হীরু অমলকে সর্বশ্রীর চিকিৎসার ব্যাপারে, স্যারের কথা মতই কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলো। যথারীতি সে জানতে পারলো - আপাতত সর্বশ্রীকে 'ডোপামিন' দিয়েই স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে। আর খুব দরকার পড়লে, 'স্টেরোটোনিন' দিচ্ছে। স্যারের কথামত, তার চিকিৎসা পদ্ধতিটা স্কিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বুঝলো হীরু। 

অমল, সর্বশ্রীকে স্কিজোফ্রেনিক ধরে নিয়েই, তার চিকিৎসা শুরু করেছে দেখে, হীরুর কপালে একটা ছোট ভাঁজও পড়লো। কিন্তু খুব দ্রুত সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে, অমলকে বললো - যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলবো অমল বাবু? 

অমল - বলুন।

হীরু - সর্বশ্রীর রোগটা মানসিক, এটা আপনি ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু তার চিকিৎসাটা মনে হয় ভুল হচ্ছে। সে মোটেই স্কিজোফ্রেনিক নয়, সী ইজ সাফারিং ফর্ম ফোবিয়া, এণ্ড আই থিঙ্ক ইট ইজ স্টিল এ্যাট আর্লি স্টেজ। 

তাই, আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, ওকে নিয়ে ডঃ এস আর অধিকারীর কাছে যান। এই মুহুর্তে মানসিক রোগের চিকিৎসা সব থেকে ভালো উনিই করছেন। এই ওনার কার্ড, ওনাকে দেখান - আশা করি সর্বশ্রী দেবীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার দ্রুততর উন্নতি হবে। 

আর পারলে সর্বশ্রী দেবীকে ঐ বাড়ি থেকে বের করে আনুন। আপনার কাছে বা নয়ন বাবুর ওখানে রাখুন, হাতে নাতে ফল পাবেন। আমার কথাটা আপাতত শুনুন। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই এসব কেন বলছি, তার ব্যাখ্যাও দেব। কিন্তু এখন না, এইটুকুই আপাতত বলার আর কি!

নয়ন - হীরক বাবুর কথাটা শোনা উচিত অমল। উনি না ভেবে চিন্তে, এমনি এমনিই কাউকে কিছু করার কথা বলার মত মানুষ নন। আমি ওনাকে বহু বছর ধরে চিনি - উনি আমার সিনিয়রও ছিলেন একসময়। আর অধিকারী স্যারের নাম আমিও শুনেছি, খুব ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট।

হীরুর কথাটা মানতে চাক না চাক, নয়নের কথাটা ফেলা অমলের পক্ষে তখন সম্ভব ছিলো না। তাই অগত্যা বোধ হয়, খানিকটা নিমরাজী হয়েই, সে সর্বশ্রীকে ডঃ অধিকারীর কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো, পরদিনই।

ওদিকে, স্যার হীরুকে বেশ কিছু বিষয়ে ফলো আপ করে নিতে বলেছিলেন। সেগুলো সব করে, পরদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে এসে, সব খুলে বললো তাঁকে। রাতে ডিনার করা অবধি, তাঁরা একটানা সেই সব নিয়ে ডিটেলে আলোচনা করে, প্রত্যাশামতই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন দুজনেই।

হীরু পরদিন সকালেই নয়নকে কল করে, তার ঐ ইঞ্জিনীয়ার বন্ধু, মিলনের অপিসের ঠিকানাটা জোগাড় করে নিলো। আর ঐ আয়াটার বাড়ির ঠিকানাতেও গিয়ে, সেদিন সকালেই একটা চক্কর দিয়ে এলো সে। মেয়েটির সম্পর্কে কোনো কিছু বিশেষ খারাপ রীপোর্ট পেলো না সে।

নিজের তদন্তের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা প্রমাণ জোগাড় করতে, এরপর হীরুকে একবার যেতে হলো সেই থানায়, যেখান থেকে সর্বশ্রীদের কার অ্যক্সিডেন্টের কেসটা ফাইল হয়েছিলো।

কেসটা দেখছিলো রাজর্ষি মণ্ডল নামের এক এস আই। তাঁর চেম্বারে গিয়ে তো হীরু অবাক - আরে এ তো একসময় তারই মেসে, পাশের ঘরে থাকা এক ভাই। খুব ভালো সম্পর্ক তার সাথে ওর বরাবরই। কিন্তু সে যে এই থানায় বদলি হয়ে এসেছে, সেটা তার স্মরণে ছিলো না।

যাক গে, বেশ সহজেই নিজের জরুরী কোয়ারীর পার্টগুলো ভেরিফাই করে নিয়ে, রাজর্ষিকে তার নিজের তদন্তের কথা জানিয়ে, কেসটা কিভাবে খুব দ্রুত ক্লোজ হবে, সেই নিয়ে আলোচনা করে ঘরে ফিরলো হীরু।

সেইদিনই বিকেলে মিলনের অপিসে গিয়ে, তার বিজনেস পার্টনার রবির সঙ্গে দেখা করলো সে। প্ল্যান মতো, নয়নের কল পেয়ে ঠিক তার আগেই, মিলন তখন অপিস থেকে বেরিয়ে গেছে - নয়নের সঙ্গে দেখা করতে! হীরু সেখানে গিয়ে রবির সঙ্গে আলাপটা জুড়লো তারই শালিকার নাম নিয়ে। 

তারপর ঠিক সুযোগ মত ঢুকে গেলো মিলনের বিষয়ে। মিলনের ভীষণই ব্যক্তিগত বিষয়ে, তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানার খুব দরকার ছিলো। সেগুলোই জেনে নিলো সে রবির কাছ থেকে।

হীরুর কাছে এখন পুরো কেসটা, জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে। শুধু কার কার সামনে, সব কিভাবে প্রকাশ করবে, সেটাই ঠিক করে নিয়ে, নয়নকে জানিয়ে দিলো - সবাইকে পরদিন সন্ধ্যে সাতটায়, তার বাড়িতে হাজির করতে।

যথারীতি পরদিন সন্ধ্যায়, নয়নের বাড়িতে এসে হাজির সবাই - অমল, লক্ষ্মণ, নয়ন, সর্বশ্রী, ওর আয়া, এমনকি মিলনও। হীরু সেখানে পৌঁছালো, সাথে রাজর্ষিকে নিয়ে, একদম ঘড়ি ধরে ঠিক সাতটায়।

নয়নের বসার ঘরেই হাজির ছিলো সবাই। সে রাজর্ষির সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর সবাই সোফা এবং চেয়ারে নিজের নিজের আসন গ্রহণ করলে, নয়ন হীরুর আসল নাম ও পরিচয় প্রকাশ করলো।

তারপর হীরুকেই দায়িত্ব দিলো পুরো ঘটনার পিছনে, প্রকাশিত অপ্রকাশিত সমস্ত সত্যতাকে তুলে ধরতে। হীরু তখন তার তদন্তের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে শুরু করলো সকলের সামনে -

প্রথমেই বলি, সর্বশ্রীর বাবা মা দুর্ঘটনায় মারা যান নি, তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছিলো, খুব বুদ্ধি করে যেটাকে দুর্ঘটনার রূপ দেওয়া হয়েছিলো। আর সর্বশ্রীও কোন মানসিক রোগী নন, কিন্তু হ্যাঁ মানসিকভাবে যথেষ্ট পর্যুদস্তা, এটা অবশ্য মানতেই হবে। 

রাজর্ষি কিছু বলার জন্য উসখুস করছে দেখে, হীরু বললো - যারা পুরো বিষয়টা জানেন বা জানেন না, তাদের সকলের স্বার্থে আমি সম্ভাব্য ঘটনাটা শুরু থেকেই বলছি - ভুল হলে, সর্বশ্রী দেবী আপনি ধরিয়ে দেবেন, কেমন?

অমল, মিলন, লক্ষ্মণ আর নয়ন এরা আশৈশব বন্ধু। একেবারে হরিহর আত্মা, গলায় গলায় বন্ধুত্ব। ক্লাস ওয়ান থেকেই একসাথে তারা পড়াশুনা, খেলাধূলা সব করে এসেছে।

তাদের চালচলন, কথা বার্তা, হাব ভাব এমনকি পছন্দ অপছন্দও প্রায় একই ধরণের ছিলো, সেই ছোট থেকেই। তবে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে, যখন মানুষের চরিত্র নিজের মত আকার ধারণ করতে শুরু করে, মৌলিকতাগুলো তখনই ধরা পরে।

ওদেরও ধরা পরলো। উচ্চমাধ্যমিক অবধি সবাই সায়েন্স নিয়ে একসাথে পড়েছিলো। তারপর তারা আলাদা আলাদা অভিমুখে চলে যায়, বলা যেতে পারে যেতে বাধ্য হয়।

তার প্রথম এবং অন্যতম কারণ ছিলো জয়েন্টের রেজাল্ট। অমল ছিলো ফিজিক্স আর ম্যাথের ভক্ত, কিন্তু জয়েন্টে মেডিকেলে টপার হলো সে। আর মিলন ছিলো বায়োলজির পোঁকা, সে টপ লিস্টে এলো ইঞ্জিনিয়ারিং এ।

লক্ষ্মণ আবার ফিজিক্স, ম্যাথ, বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি সবগুলোতেই উচ্চমাধ্যমিকে লেটার পেলেও, জয়েন্টে ভালো পজিশনই পেলো না। অগত্যা সে চলে গেলো ভেটিরিনারি পড়তে।

বেচারা নয়ন পরে রইলো একা। সে তার বন্ধু হারানোর দুঃখে, সায়েন্স ছেড়ে ইংরাজী নিয়ে বিএ অনার্সে ভর্তি হলো। গ্র্যাজুয়েশনের পর সে বেছে নিয়েছিলো এল এল বি কোর্স। আর এখন তো সে হাইকোর্টে জমিয়ে প্র্যাকটিশ করছে, আপনারা সবাই জানেন।

অমল ডাক্তারি করছে, প্লাস তার ঐ মেডিকেল কলেজের সে প্রফেসরও। মিলন নিজেরই একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম খুলেছে। লক্ষ্মণ ভেটিরিনারি সার্জেন, সেও সরকারী হাসপাতাল ও কলেজের প্রফেসর। 

চারজনেই এখন ওয়েল এসটাবলিশ্ড। নিজের নিজের পেশাগত পার্থক্য থাকলেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে। নিজেরাই কিছুটা আত্মীয়তাও তৈরী করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে।

লক্ষ্মণ আর নয়ন দুজনেই একে অপরের সম্বন্ধি ও ভগ্নীপতি। অমল বিয়ে করেনি এখনও - শুধু নয়নের এই মাসতুতো বোনের, পড়া কম্প্লীট হয়নি বলে। সর্বশ্রী এবছরেই এম এ কম্প্লীট করলে, বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা দুজনের। 

পাকা কথা হয়েই আছে দুই পরিবারের মধ্যে - বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। আর তাদের দুজনের প্রেমের সম্পর্কটাও বেশ পুরানো - সেই উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকেই, অমল ভালোবাসে সর্বশ্রীকে।

শুধু মিলনই বিয়ে থা করার পক্ষপাতী নয়। তার এই রকম সিদ্ধান্তের কারণটা বন্ধুদের কেউই ঠিক জানতো না - মানে মিলনই কাউকে বলেনি। এই একটা বিষয়ে কথা উঠলেই ও বরাবরই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়।

তবে, সম্প্রতি একটা পার্টীতে একটু বেশি ড্রিঙ্ক করার পর নাকি, ওর বিজনেস পার্টনার রবিকে সে বলেছিলো - একটি মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে সে ভালোবাসতো, এমনকি এখনও ভালোবাসে। কিন্তু সেই মেয়েটিই নাকি, আগে কয়েক বছর তার সাথে সম্পর্কে থাকার পর, সে অন্য কাউকে ভালবাসে জানিয়ে, তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো!

মিলনের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন, সেই মেয়েটি তাকে জানতেই দেয়নি কোন দিন যে, সে আরও একজনকে ভালোবাসে। অথচ মেয়েটির পছন্দ বলেই, ডাক্তারি না পড়ে, মিলন ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলো। 

আর নিয়তির কি পরিহাস - এখন সে জানতে পেরেছে যে, মেয়েটির সেই অন্য প্রেমিকটা নাকি ডাক্তারই! বাবা মায়ের ইচ্ছা - তাঁদের জামাই হবে কোন ডাক্তার। তাই নিজের পছন্দটাও সে নাকি তাঁদের কথা মতো বদলে নিয়েছে। 

সেই ডাক্তার ছেলেটিকে নিশ্চয়ই, ঐ মেয়েটি - মিলনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কখনও জানায় নি। কিন্তু মিলনকে সেই ছেলেটির বিষয়ে, সব কথা জানিয়েই, তাদের রিলেশানের ব্রেকাপ করেছিলো সে !

আজকালকার স্মার্ট মেয়েরা যে রীতি পছন্দ করে আরকি - প্রেম করবে নিজের পছন্দে, কিন্তু বিয়ে করবে বাবা মায়ের পছন্দ করা, কোনো সফল এবং ভবিষ্যত সুনিশ্চিত এমন পুরুষকে। 

অবশ্যই সব মেয়ে এমন হয় না এটা আমি ভীষণ ভাবে মানি, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেই বলছি - মিলনের ঐ প্রেমিকার মত এই ধরণের মেয়েরাও আছে।

তাই, মিলন এই বিষয়ে স্বাভাবিক কারণেই কোন আলোচনা পছন্দ করে না। আর এই সব জানার পর, বন্ধুরাও কেউই ওকে এই নিয়ে বিরক্ত করে না। মেয়েটার নাম কাউকে কখনও বলেনি, তবে ভালোবেসে তাকে নাকি মেখলা বলে ডাকতো সে।


কি সর্বশ্রী দেবী, ঠিক বলছি তো? মিলনের সাথে আপনি যা করেছেন, তা ভয়ানক অন্যায় - এটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না! না না, অস্বীকার করে লাভ নেই, আপনি নিজেও সেটা মন থেকে মানেন বলেই, প্রেমিকের দেওয়া "মেখলা" নামটা ছাড়তে পারেন নি আজও, তাই তো?

সর্বশ্রী মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিলনও তাই। শুধু অমল যেন অশান্ত হয়ে ওঠে। তার মুখের অভিব্যক্তিতে একটা ক্রোধের লক্ষ্মণ ফুটে উঠেই যেন মিলিয়ে যায়। নিজেকে সংবরণ করে নেয় সে। হীরুর চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা।

হীরু মিলনকে বললো - প্রেম কি কখনও কারোর বাবা মায়ের আদেশ মেনে হয় মিলনবাবু? যদি কারো মনে ভালোবাসা থাকে সত্যিই, তাহলে তার অন্য প্রেমিকই বা আসবে কোথা থেকে, আর একাধিক প্রেমিকই বা থাকবে কেন? তবু আপনি ওর বাবা মাকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন, নিজের প্রেমিকাকে হারানোর জন্য? 

ওদিকে দেখুন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংটা আপনি নিজে যতটা ভালো জানেন বা বোঝেন, ততটা তো আপনার শাগরেদ বোঝে না। তাই তার কাজের ত্রুটি ধরে তাকে খুঁজে পেতে, পুলিশকে খুব বেশি দৌড়াদৌড়িই করতে হয়নি। 

পুলিশকে দেওয়া বয়ানে, সে আপনার কথায়, সর্বশ্রীর বাবার গাড়িতে করা, তার কেরামতির কথা সব স্বীকার করেছে। আমায় নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না যে, সর্বশ্রীর বাবা মায়ের ঐ গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য আসলে শুধু আপনিই দায়ী! রাজর্ষি, ওকে কাস্টাডিতে নে ভাই।

সকলে উঠতে যাচ্ছিলো, হীরু তাদের থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলো - দাঁড়ান, ঘটনার গো অর্ধেকটা শেষ হলো। অর্ধেক এখনও তো বাকি। মিলন যদি সর্বশ্রীর বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য দোষী হয়, তো সর্বশ্রীকে মারার চেষ্টার জন্য - অমলবাবুও দোষী।

অবাক হচ্ছেন নাকি অমলবাবু? আমি আপনার প্ল্যানিং ধরতে পারতাম না, যদি সর্বশ্রীর কুকুরটা, মানে ভুলো, অসুস্থ না হতো। বাবা মায়ের মৃত্যুর শোক, সঙ্গে নিজেরই প্রাক্তন প্রেমিকের তাতে যুক্ত থাকার ঘটনায় আঘাত পেয়ে, মানসিক ভারসাম্য নিশ্চয়ই হারাতে পারতেন সর্বশ্রী। কিন্তু তার প্রভাব ভুলোর ওপর পরবে কিভাবে?

খাবারে যে ওষুধটি মিশিয়ে আপনি খাওয়াতেন - সর্বশ্রীকে দূর্বল করার জন্য, তা যে ভুলোও খেতো, সেটা আপনি বোধ হয় জানতেন না। আর প্যাভলভের সেই কুকুরের ওপর খাবার নিয়ে করা পরীক্ষাটা আমারও জানা।

খাবার সময় বেল বাজানোর যে ব্যবস্থা আপনি করিয়েছিলেন বন্ধুকে দিয়ে, তাতে খেতে বসে সর্বশ্রী একাই রোজ মৃদু বিদ্যুতাহতা হতেন না - ভুলোও তাঁর সাথেই শক পেতো। খাবার সময় রোজ রোজ নানা ধরণের বিপজ্জনক ঘটনা, যা আপনি কৃত্রিম ভাবে ঘটাতেন, তার প্রভাবগুলো ভুলোর ওপরও পড়েছিলো।

অ্যালর্ম ঘড়ির নিচে লাগানো স্পীকারে, রোজ সর্বশ্রীকে ভয় দেখিয়ে যেসব কথা শোনাতেন, শুধু তারই প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলো ভুলো। স্যার, ডঃ এস আর অধিকারী আমায় দীর্ঘদিন সাইকোলজি পড়িয়েছেন। তাঁর শিক্ষা তো মাথায় ছিলোই, তার ওপর তিনি নিজে আমায় এই তদন্তে সাহায্যের হাত বাড়ানোয়, আপনার ফাঁদটা চিনতে বিশেষ কষ্ট পেতে হয় নি।

মিলনবাবুর কাজকে সমর্থন করিনা কখনই, তবু তাঁর রাগের একটা কারণ বুঝতে পারি। কিন্তু আপনি সর্বশ্রীকে মারতে চাইছিলেন কেন? সে তো আপনাকে বিয়ে করবে বলেই, মিলনকে ছেড়ে এসেছিলো?

অমল - আপনি যেসব অ্যালিগেশন লাগাচ্ছেন আমার এগেন্স্টে, তার প্রমাণ দিতে পারবেন তো?

হীরু - নিশ্চয়ই। আপনারই প্রেসক্রাইবড করা, সর্বশ্রীর ঐ পথ্যের টেস্ট রীপোর্ট আছে আমার কাছে। আয়ার বয়ান বলছে, ঐ পথ্য আপনিই স্থির করেছেন। সর্বশ্রী দেবী নিজে এবং নয়নও তার সাক্ষী। আরও কিছু বলার আছে, তবে সে সব থাক। আপনি বরং নিজেই বলুন না, কেন ওকে মারতে চাইছিলেন?

অমল বেশ কিছুক্ষণ মাথা নত করে থেকে, বললো - সর্বশ্রীকে আমি বা মিলন দেখেছিলাম উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়, যখন ও নাইনে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো। ওর প্রেমে আমি তখন থেকেই পাগল। মিলনও বোধ হয় তাই।

কিন্তু ও কোনোদিন জানতেই দেয়নি যে, সে একই সাথে আমাদের দুজনকেই নিয়ে খেলছে। আমার বা মিলনের ডাক্তারী বা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে যাওয়া, ওর ইচ্ছে অনুসারেই বদলে গিয়েছিলো। যাই হোক, অ্যাক্সিডেন্টের পর ও বাড়ি ফিরলে, মিলন যখন ওর বাড়ি গিয়ে কাজ করাচ্ছিলো, তখনই একদিন তাদের বেশ অন্তরঙ্গ অবস্থায় ঘরে দেখতে পাই। 

তারপর, ওর বই খাতা পত্র সব ঘাঁটতে গিয়ে, ওর 'মেখলা' নাম এবং সেই নামেই সম্বোধন করে, তাকে লেখা মিলনের প্রেমপত্রগুলো পাই। বুঝতে পারি - ওই হলো সেই মেয়েটা যে, মিলনকে ধোঁকা দিয়ে, আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলো। 

ওকে এত দিন ধরে পাগলের মত ভালোবেসেছি। কিন্তু সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম, সেই প্রেমের মূল্য চোকাচ্ছে আজও - আমারই বেস্ট ফ্রেণ্ড মিলন! বন্ধুর জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম - আমার পরিণতিও মিলনেরই মতো হতে পারতো, আরও কোন বেটার অপশন তখন সর্বশ্রী পেলে।

যাই হোক, সব জেনেও তবু শান্ত ছিলাম। কিন্তু সর্বশ্রীর প্রতি ক্রোধ জন্মালো, যখন জানতে পারলাম - আবার মিলনের সঙ্গে সে পুরানো রীলেশানে যেতে চায় বলে, নিজের ডায়েরীতে লিখে রেখেছে ও। আমার তো মনে হয়, ওদের ঐ কার অ্যাক্সিডেন্টের পিছনে - শুধু মিলন না, তার সাথে সাথে সর্বশ্রীরও হাত আছে।

কারণ, আমার সাথে রীলেশন ব্রেক করে, বিয়ে ভেঙে দেবার কথাও নাকি, ও বলেছিলো ওর মাকে। তিনি সেকথা জানিয়ে, আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন একদিন - আমাদের মধ্যে কেন বা কি নিয়ে, মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে, এসব জানবেন বলে।

এরপরেও কি বলবেন, আমি ভুল করছিলাম ওকে পাগল করে তুলে? আমি ওকে প্রাণে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারিনা, কিন্তু কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মেয়ের পক্ষে - এইভাবে নিজের খাম খেয়ালে পুরুষদের জীবন নিয়ে খেলা তো সম্ভব নয়। সেটা প্রমাণ করতেই - ওকে পাগলী রূপে দেখতে চেয়েছিলাম।

হীরু - ভুল, ভীষণ বড় ভুল করেছেন অমলবাবু। আপনার নিজের চিন্তাধারাই সুস্থ নয়। যে সমস্যার কথা আপনি বলছেন, তার দাওয়াই ওকে পাগল বানানোয় নেই। বাইরে থেকে যাকে ভীষণ উচ্ছ্বল দেখায়, ভিতরে সে ততটাই নিঃসঙ্গ হয় সাধারণত। আমার ধারণা, সর্বশ্রীও তাই। 

বাবার পড়াশুনায় ডুবে থাকা আর মায়ের পূজাআর্চায় ব্যস্ততা - ভিতরে ভিতরে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিলো তাকে। তাই, ওর আচরণে ঐসব ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন আপনি। ওকে ভালোবেসে, মানসিকভাবে ওর অনলম্বন হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই, ওকে নিজের করে পাবার চেষ্টা করা উচিত ছিলো আপনার।

আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, স্যারের কাছে দুটো তিনটে সীটিং নেওয়া আপনারও ভীষণই জরুরী। কিন্তু আপাতত, একটি অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসা করার সুযোগে, তারই ক্ষতির চেষ্টা করার জন্য, রাজর্ষি আপনাকে কাস্টাডিতে নেবে। ভয় নেই, আপনার বেল পেতে অসুবিধা হবে না, কিন্তু রেজিস্ট্রেশনটা বোধ হয় যাবে।

আমার কাহিনী শেষ। অমলবাবু এবং সর্বশ্রীদেবী আপনাদের দুজনেরই - দ্রুত মানসিক ব্যাধি থেকে আরোগ্যলাভের কামনা করি। চলো হে নয়ন, তুমি আমায় একটু বাড়িতে ড্রপ করে দাও। রাজর্ষি তো এখন ওদের নিয়ে থানায় যাবে। রাত হয়ে গেছে, বেরিয়ে পড়া যাক।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama