মডেল হত্যা রহস্য (১)
মডেল হত্যা রহস্য (১)
(1)
" সকলি তোমারি ইচ্ছা,
ইচ্ছাময়ী তারা তুমি
তোমার কর্ম তুমি করো মা,
লোকে বলে করি আমি
সকলি তোমারি ইচ্ছা। "
সকালের চা খেতে খেতে খবরের কাগজটা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিল বিক্রম। একটু পড়েই ওর ট্রেন। সেই মতো সবকিছু গোছগাছ করে নিয়েছে। হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে মনে মনে বলে উঠল-আবার এই অসময়ে কে ফোন করে কে জানে।
একরাশ বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বিক্রম দেখে ওর সিনিয়র ডি.আই.জি অরুণ সান্যাল ফোন করছেন। বিক্রম খবরের কাগজটা ভাজ করে রেখে তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে
বলে-গুড মর্নিং স্যার।
ওর কথার উত্তর না দিয়ে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ডি.আই.জি অরুণ সান্যালের গম্ভীর গলা ভেসে এল-বিক্রম, তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিসে চলে এসো।
ডি.আই.জি স্যারের জরুরী তলবের নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ কারণ আছে ভেবে বিক্রম বলল-ঠিক আছে স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি।
***
অনেকদিন বাদে ও অফিস থেকে একসপ্তাহের জন্য ছুটি নিয়েছিল। কয়েকদিন আগে একটা জটিল কেসের সমাধান করায় ওর এই ছুটিটা দরকার ছিল। সেইমতো দেশের বাড়ি যাবে ঠিক করেছিল। অফিসের কাজের জন্য ও কলকাতায় এই ফ্ল্যাটে একাই থাকে। আর ওর সঙ্গে একজন সবসময়ের কাজের লোক রামু থাকে। রামুও ওর দেশের বাড়ি বসিরহাটেই থাকত। কলকাতায় চাকরিসূত্রে থাকতে যাতে ওর কোনো অসুবিধা না হয় সেই জন্যই ওর মা রামুকে ওর কাছে পাঠিয়েছিল। সেই থেকে ওরা দুজনে এই ফ্ল্যাটে থাকে। অনেকদিন পর বাড়ির সব লোকজনদের সাথে দেখা হবে ভেবে সবার জন্য পছন্দমতো উপহারও কিনেছিল। কিন্তু শেষমেশ ওর যাওয়া হবে না বলে বাড়িতে ফোন করে জানাবে ভাবল। তারপর কী মনে হতে আর ফোন করল না। ওর জায়গায় রামুকে একাই পাঠিয়ে দেবে ঠিক করল।প্রথমে তো রামু কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ওর খাওয়া-দাওয়ার কি হবে ভেবে রামু যেতে চাইছিল না।তারপর বিক্রম ওকে বলে যেকটা দিন রামু থাকবে না সেকটা দিন হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে নেবে। তাতে রামু যাওয়ার জন্য রাজি হয়। আর যেই ভাবা সেই কাজ। অফিসে যাওয়ার আগে রামুকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো আর উপহারের প্যাকেটগুলোর উপরে সবার নাম লিখে দিলো।
তারপর চটপট তৈরি হয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে বিক্রম অনলকে ফোন করল। কিন্তু অনেকক্ষণ ফোন বেজে যাওয়ার পর ওপ্রান্ত থেকে যান্ত্রিক গলার স্বর শোনা গেল-
"আপনি যে নম্বরে ফোন করছেন সেটি এখন উত্তর দিতে পারছে না। দয়া করে কিছুক্ষণ পর পুনরায় চেষ্টা করুন।"
(2)
ফোনটা রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করতেই ওপ্রান্ত থেকে অনলের গলা ভেসে এলো-গুড মর্নিং স্যার। সরি স্যার, আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন ধরতে দেরী হল। আপনি এই সময় ফোন করলেন...
-(ওকে থামিয়ে দিয়ে) তুমি থামলে আমি বলতে পারি কেন ফোন করেছি।
-সরি স্যার। আপনি বলুন কেন ফোন করেছেন।
-তাড়াতাড়ি অফিসে চলে এসো। আমিও যাচ্ছি।
-স্যার, আপনি তো ছুটি নিয়েছিলেন তাই তো আমি...
-(ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে) যেটা বললাম আপাতত সেটা করো। বাকি সব কিছু অফিসে এলেই জানতে পারবে। আর দেরী করবে না।
-ঠিক আছে স্যার।
বিক্রম ফোনটা রেখে দিলে অনল মনে মনে ভাবে-এবার কী হবে? অফিসে না গেলে চাকরি থাকবে না আর বউয়ের কথামতো আজকে রান্না না করলে বাড়িতে আর থাকার জায়গা হবে না। হে ভগবান, এখন আমি কোন দিকে যাব?
হঠাৎ পিছন থেকে অনল শুনতে পেল ওর বউ শ্যামলী কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে,
-জানো মা, আজকে ও আমাকে সারপ্রাইজ দেবে।
-....।
-হ্যাঁ, আজকে ও বলেছে আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে।
ওপ্রান্তের কোনো কথাই অনল শুনতে পেল না কিন্তু এটা ভালোই বুঝল যে সকাল সকাল শ্যামলী যার সাথে কথা বলছে সে আর কেউ নয় ওর শাশুড়িমা, ননীবালাদেবী। এই মহিলাকে ও একটু সামলেই চলে। কখন কোন কথা ধরে কী বলবেন বোঝা বড়ো মুশকিল। আজ পযর্ন্ত তো ওনার মেয়েকেই(শ্যামলী) বুঝল না আর উনি তো তার মা। অনল এমনিতেই শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। বাবা-মা ছোটবেলাতেই মারা গেছে। সেই থেকে মাসি-মেসোর কাছেই মানুষ। তারাও দুবছর হলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। চাকরি পাওয়ার পর এই ফ্লাটটা ও কিনেছিল। এখন এখানে ও আর ওর স্ত্রী শ্যামলী থাকে। ওদের আপনজন বলতে শুধু শ্যামলীর বাবা-মা। শ্যামলী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আর ওর কোনো জেঠু, কাকুও নেই। তাই ওনারাই(শ্যামলীর বাবা-মা) মাঝে মাঝে আসেন এখানে ওদের ফ্ল্যাটে। কয়েকদিন ওদের সঙ্গে থেকে আবার ওনারা নিজেদের বাড়ি চলে যান।
শ্যামলীর কথা বলা হয়ে গেলে অনল ওকে বলল-শোনো, আমাকে এক্ষুনি অফিস যেতে হবে।
-তাহলে রান্নার কী হবে?
-আমি তোমার জন্য চিলি চিকেনটা করে ফেলেছি। ভেটকি পাতুরিটা নাহয় অন্য একদিন করে খাওয়াব।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
শ্যামলী চুপচাপ মেনে নেওয়ায় অনল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শুধু বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মনে মনে একবার ভগবানকে ডেকে নিয়ে বলল-"আজকে যেন স্কুটিটা খারাপ না হয়ে যায়। তাহলে আজকেও পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।"
স্কুটিটা এমনিতে ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে একটু গন্ডগোল করে। কতবার ভেবেছে এটা বিক্রি করে নতুন একটা নেবে কিন্তু প্রতিবারই শ্যামলী বাধা দিয়েছে। এতে নাকি ওর বাবার সঙ্গে কাটানো অনেক স্মৃতি আছে। মাঝে মাঝে ওর শ্বশুরমশাইয়ের জন্য খুব কষ্ট হয়। উনিও আজ পর্যন্ত নিজের বৌয়ের কথার ওপর কোনো কথা বলতে পারেননি। আর ওনার মেয়েও হয়েছে মায়ের পুরো কার্বন কপি। কিছু বলতে গেলেই হুমকি দেয় বাপের বাড়ি চলে যাবে।
যাই হোক এত সবকিছু ভাবতে ভাবতে ও দিব্যি যাচ্ছিল কিন্তু ভগবান মনে হয় ওর প্রার্থনা শোনেনি। তাই তো মাঝ রাস্তায় হঠাৎ ওর স্কুটিটা বন্ধ হয়ে গেল। অনেকবার চেষ্টা করেও কিছুতেই চালু করতে পারল না। অগত্যা ওটাকে ঠেলতে ঠেলতে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দোকান দেখতে পেয়ে সেই দোকানে স্কুটিটাকে ঠিক করিয়ে নিলো। পুরো দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর যদিওবা স্কুটিটা ঠিক হলো এবার নতুন ঝামেলা শুরু হলো খুচরো নিয়ে। ওর মোট হয়েছে চারশো চব্বিশ টাকা। কিন্তু ওর কাছে পাঁচশো টাকার নোট। আর ওই প্রথম খদ্দের তাই দোকানদারের কাছে খুচরোও নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে দোকানদার কারোর থেকে চেয়ে আনতে পারবে খুচরো। কিন্তু একেই অনেকটা দেরী হয়ে গেছে এরপর যদি ও আরও অপেক্ষা করে তাহলে হয়তো আজকে ওর চাকরিটাই চলে যাবে। তাই বাকি টাকার মায়া কাটিয়ে ওই টাকায় দোকানদারকে মিষ্টি খেতে বলে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আরও একঘন্টা পর ও অফিসে এসে পৌঁছালো। অফিসে এসেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল বিক্রম ওর ঘরে নেই।
ও মনে মনে ভাবল-তার মানে এখনও মিটিং শেষ হয়নি। আমি বরং এখানেই অপেক্ষা করি। আজ যে কপালে কী আছে কে জানে।
******