ফিরে দেখা কাহিনী -----
ফিরে দেখা কাহিনী -----
তড়িৎ বাবু এবং মিনাদেবীর বাড়িতে এবার বসন্ত ফাল্গুনের উৎসব, একটু অন্য মাত্রায়, অন্য অনুভবে আবেগে হবে, সদ্য একমাত্র পুত্রের পুত্রবধূ বাড়িতে এসেছেন, মাস দুয়েক হল, বিয়ের কয়েকদিন পরেই ছেলে অনির্বাণ চেন্নাই চলে গেছে, তার কর্মস্থলে, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণ একটি বিদেশী সংস্থায় চাকরি করে, বিগত পাঁচ বছর ধরে, বেসরকারি সংস্থা, সহজে ছুটি পাওয়া যায়না, তাই এই পর্বে দোল উৎসবে নতুন পুত্রবধূ, বর্ণালী কে এই যাত্রায় শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গেই থাকতে হবে, শুধুমাত্র অনির্বাণ এর সঙ্গে প্রথম দোল উৎসব কাটবে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, আর কথা হবে হোয়াটসঅ্যাপে, ফাগুনের রঙ খেলা হবে ফেইসবুক লাইভ এর মাধ্যমে, তারপর তিন মাস পরে, বর্ণালী যাবে কিছুদিনের জন্য অনির্বাণ এর কাছে চেন্নাইতে, সেখান থেকেই হানিমুন পর্ব হবে, তাদের জীবনে। কিন্তু বর্ণালী তো এই যুগের মেয়ে, অতি আধুনিকা, বাবা মার একমাত্র আদরের কন্যা, সারাদিন ইন্টারনেটের কাল্পনিক জগতের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে, একাকিত্বের মধ্যে এভাবেই তো বড় হয়েছে, পড়াশুনা আর সোশ্যাল মিডিয়া, জীবন সংগ্রাম যে কি জিনিস, তা বর্ণালী রা জানতেই পারেনি, প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছে, চাহিদা পূরণের জন্য লড়াই করতে হয় নি, বর্ণালী দের।
তড়িৎ বাবু আর মিনা দেবী নতুন বউ বর্ণালীর এই ধরনের আচরণ মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও, সময়ের পরিবর্তনে ধারায়, আর এক সন্তানের কথা ভেবে, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। মাঝেমাঝেই মিনা দেবী বৌমাকে বোঝান, সেকাল একাল নিয়ে আলোচনা হয়, বিকালে চায়ের আসরে মীনা দেবী হাসতে হাসতে বর্ণালী কে বললেন, সামনেই তো দোল পূর্ণিমা, বৌমা, তোমরা এতদিন কিভাবে উপভোগ করেছ এই দিন টা, অবশ্য তোমাদের সময় তো পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ থাকতো, তথাপি পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, তাদের নিয়ে রঙের খেলায় তোমরা কিরকম মেতে উঠতে, বর্ণালী একটু বলো না, আমরা একটু শুনি তোমাদের এই যুগের দোল উৎসব পালনের কথা। কিছুক্ষণ নিরবে থেকে বর্ণালী এবার মোবাইলের রঙিন কাল্পনিক জগত থেকে মুখ তুলে বলতে লাগলো, মা আপনাদের সময় ব্যাপারটাই আলাদা রকম ছিল, অনেক ভাই-বোন আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যেই ছিলেন, আপনাদের ছোটবেলার দেশের খোলামেলা মাঠ ঘাট, নদী, পুকুর, দীঘিতে অফুরন্ত সাঁতার কাটা, অনেক বন্ধু বান্ধবের সাথে মেলামেশা, গল্পগুজব করে সময় কাটানো, সেখানে দোল উৎসবের তাৎপর্যটাই ছিল অন্যরকম, খেলার মাতনে আবেগ ছিল, বড়োদের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল, বেপরোয়া উশৃংখলতা ছিল না, তেমনটা, আর মা, আমাদের দোল উৎসব, ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বড় হওয়া, ভাই বোন তো আর নেই একাকী, তারপর মাঠ নেই, ঘাট নেই, আমরা বেশিরভাগ দোল খেলেছি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, একে-ওকে রং দিয়েছি ফেসবুকের মাধ্যমে, বন্ধুদের কাছে, হাসি ঠাট্টা গল্প সব তার মাধ্যমেই, আমাকে তো বিশেষ রং খেলায় উৎসাহ ই দিতেন না বাবা-মা, সবসময় বলতেন পরিবেশ খারাপ হয়ে গেছে, ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই বেপরোয়া মানসিকতায় চলে, ভয় ডর একদম নেই, বড়দের সম্মান দিতে জানে না, ছোট থেকেই নেশাদ্রব্যের দিকে ঝুঁকতে থাকে, দোল খেলার রঙের মধ্যেই ভেজাল, কেমিক্যাল রঙের জন্য শরীরের চামড়ার ক্ষতিসাধন করে ব্যাপকভাবে, আগের দিনের মতো বিশুদ্ধ রং আর নেই, সেই পরিশুদ্ধ আবির পাওয়া দুষ্কর, রঙিন ভেজালের বাজারে, এই দুইদিন তুমি বাইরে একদম যাবেনা, বর্ণালী, আর এই শাসন আর সাবধানী বাণীর মধ্যেই আমি বড় হয়েছি, মা। তুমি ঠিকই বলেছ, বর্ণালী, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে, আর ভোগবাদী দুনিয়ার হাতছানিতে, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছোট পরিবারের আবর্তে এসে, এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে, সাথে সাথে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে, নিঃসঙ্গভাবে তোমাদের বড় হতে হয়েছে, মানসিকতায় এসেছে স্বার্থপরতার মনোভাবের জটিল ধারা, তাই বর্ণালী, তোমাদের এই যুগের আধুনিক ছেলে মেয়েদের ফাল্গুনের পলাশ শিমুলের রক্তঝরা রঙিন দিনের দোল উৎসবে মাধুর্য, উদ্দীপনা, ফাগুয়ার লাল আবিরের বর্ণচ্ছটার খেলার সত্যিকারের গল্প কাহিনী জানতে গেলে আমাদের মত পুরনো দিনের মা বাবাদের কাছে আসতে হবে, শুনতে হবে মন দিয়ে, সেই মাধুর্যভরা আমাদের ছেলেবেলায় ফেলে আসা দোল উৎসব আর হোলির কথা।
জানো বর্ণালী, আমার ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্বে বিহার, বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের সিন্ধ্রি শহরে, একসময় ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি সার কারখানা, ষাট সত্তরের দশকে বাবা সেখানে চাকরি করতেন, আজ এসবই অতীত ইতিহাস, সেই সময় সেখানে সিন্ধ্রি শহরে প্রবাসী বাঙালিদের রমরমা প্রভাব ছিল কর্মে, শিক্ষায়, ক্রিয়া, সংস্কৃতি, সর্ব বিষয়েই, জানো তো বর্ণালী, শহরের চারদিকে টিলা, খোলামেলা মাঠ ঘাট, প্রচুর শিমুল পলাশ এর গাছ ছিল, শহরের এক ধার দিয়ে বয়ে গিয়েছিল দামোদর নদ, হিন্দিভাষী মানুষদের সাথে আমরা প্রবাসী বাঙালিরা দোল উৎসবের একমাস আগে থেকে প্রস্তুতিতে মেতে যেতাম, পলাশ শিমুল ফুলের রস থেকে রং বানাতেন দাদারা, আমরা মেয়েরা সাহায্য করতাম, পাড়ার ক্লাবে দোল উৎসব উপলক্ষে তিনদিন ধরে গান বাজনার আসর বসতো, আমরা মেয়েরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম আর প্রকৃতির গানে পাড়ার মাঠ মাতোয়ারা করে দিতাম, সাথে হত নৃত্য অনুষ্ঠান, " আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে," গানের সাথে প্রভাত ফেরী করে শহর পরিক্রমা করা হতো, আর হত আবির রং এর খেলা, দোলের আগের দিন, হতো বুড়ি পোড়া, আমরা ছেলেদের সাথে সমানতালে লেগে যেতাম শুকনো ডালপালা, জঙ্গল সংগ্রহের কাজে, আশেপাশে জঙ্গলে, ছোট টিলার উপরে উঠে শুকনো গাছের ডাল নিয়ে আসতাম, পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতা হতো, কে কত বুড়ির ঘর উঁচু করতে পারে, সন্ধ্যের পর আগুনের লেলিহান শিখায় সাময়িক অন্ধকার করে দেওয়া সিন্ধ্রি শহরে একটা অন্যরকম ভৌতিক রূপের প্রকাশ পেত, সেই আগুনের তাপে দেওয়া হতো বড় বড় আশেপাশের আদিবাসী গ্রামে ফলানো লাল আলু, বেগুন আর টমেটো, তাতে কাঁচালঙ্কা আর খাঁটি সরষের তেল দিয়ে মেখে, সাথে লবণ, আহা তার কি সাধ ছিল, বর্ণালী, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না, সেই স্বাদ এখনও যেন জিভে লেগে আছে, মাখনের মতো মিশে যেত তৃপ্তির বন্ধনে, আর গন্ধে, স্বাদে। সাথে সাথে আমরা মেতে যেতাম হৈ-হুল্লোড়ে, বুড়ির ঘরে আগুন জ্বলছে, তাৎপর্য ছিল, পরিবেশকে পরিষ্কার করে দেওয়া, আর জঞ্জালমুক্ত করে আগামীদিনের বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আকুল প্রচেষ্টা, আমরা সকলে মিলে চিৎকার করে বলতে থাকতাম," সেই বিখ্যাত ছড়া গান, " আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরি বোল," বলতো বর্ণালী, তোমাদের জীবনে কখনো কি এইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, হয়নি বা হবেও না, হয়তো কালের প্রভাবে, আবার মনে পড়ে যায়, বিশ্বকবির সেই বিখ্যাত ঋতু পর্যায়ের গানের কলি গুলি, " নীল দিগন্তে, ওই ফুলের আগুন লাগলো, লাগলো, বসন্তে," এখনো মনে সুরের দোলা দিয়ে যায় সেই বিশ্ব কবির গান, ----------------
অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে ----
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
হোলির দিন সকালে, নটার পরে শুরু হতো আবির রাঙানো রঙ খেলা, সকলে মিলে, প্রবাসী বাঙালিদের সাথে, হিন্দিভাষী প্রতিবেশীদের মিলেমিশে রংয়ের খেলা হত, বাড়ি বাড়ি ঘুরে গুরুজনদের প্রণাম করা হতো, আবিরে মাখানো প্রণাম, তার সাথে চলতো মিষ্টি বিতরণ পর্ব, বিকেলে আমরা মেয়েরা নতুন গরদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে, আর ছেলেরা ধবধবে শাদা আদ্দির পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বিকেলে রংয়ের খেলা হত, পাড়ার ক্লাবে, রাত্রে সকলে মিলে বসে খাওয়া দাওয়ার বিপুল আয়োজন থাকতো, সাথে চলতো গান বাজনা, নাচ সারারাত্তির অনুষ্ঠান, পাশেই হিন্দিভাষী বয়স্ক মানুষ জনেরা কীর্তনের আসর বসাতো, সেই ভোজপুরি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম পর্বের রংয়েরখেলার কীর্তন গান, আর রাম গান শুনতে আমাদের ভারি ভালো লাগতো, সেই গান শোনার জন্য বহু মানুষের সমাগম হতো, শামিয়ানার নিচে, উচ্চস্বরে কীর্তনের ঝংকার ধ্বনি দোল পূর্ণিমার রাতের আকাশে যেন এক অন্য অনন্য অনুভূতি নিয়ে আসতো মনে আর প্রানে, কখনো আবার মনকে এক হারানো বেদনায় ভরিয়ে তুলত, বিদায় নেওয়া হোলি উৎসবে কথা ভেবে।
জানোতো বর্ণালী, অনির্বাণ এর বাবার সাথে সেই আমাদের ছেলেবেলা কার সময় প্রেমের মাধ্যমেই চির বন্ধন তৈরি হয়েছিল, আর সেই সময়ে স্কুলে পড়াকালীন, আমাদের দুইজনের পরিচয়, ভালোলাগা , ভালোবাসার সূচনা হয়েছিল সেই সিন্ধ্রিতেই, কোন এক হোলি উৎসবের সকালে, তাই আজ দুই জনই জীবন সায়াহ্নে এসে, প্রবাসী জীবনের মাধুর্য থেকে অনেক লড়াই, সংগ্রাম, পরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্য, যথাসম্ভব পালন করে, আজ সেই স্মৃতি রোমন্থনের পর্বে এসে দাঁড়িয়েছি। তাই বর্ণালী, প্রতি বৎসর দোল উৎসব এলেই, আমাদের সেই দিনের ফেলে আসা ছেলেবেলার সুখ স্মৃতি মনকে আলোড়িত করে তোলে,, এই বার্ধক্যেও মনে প্রানে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, আবার কখনো তা জীবনের বিদায় বেলার ক্ষণের কথা চিন্তা করে মনকে বিষাদে ভরিয়ে তোলে বাস্তব বন্ধনের নিরিখেই।
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শাশুড়ি মা মিনা দেবীর কাছে প্রবাসী জীবনের ছেলেবেলাকার দোল উৎসবের স্মৃতি কাহিনী শুনতে শুনতে বর্ণালী অনুভবে আর আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, চোখের জল মুছতে মুছতে বর্ণালী বলে উঠলো, সত্যি মা অসামান্য আপনাদের এই দোল উৎসবের ফিরে দেখা কাহিনী, সত্যি কারেই আমরা এই যুগের ছেলেমেয়েরা বারে বারে মিস্ করবো, মা আপনাদের জীবন অনেক সার্থক আর সফল, যা জীবনভর পরিপূর্ণভাবেই উপভোগ করে এসেছেন, উপভোগ্য বর্ণনায় এই গল্প আমাদের কাছে হয়ে থাকবে, চিরদিনের ছবি হয়ে " ফিরে দেখা কাহিনী", রূপে মনের গভীরে, হৃদয়ে আর মননে, আগামী দিনের জন্য।