Apurba Kr Chakrabarty

Thriller Others

3.8  

Apurba Kr Chakrabarty

Thriller Others

হানা বাড়ির মেসঘর

হানা বাড়ির মেসঘর

6 mins
2.0K


বর্ষার রাত, সেদিন আকাশ ছিল নির্মল,পূর্ণিমার চাঁদে আলো ঝলমল করছিল। খাতড়ার কমলা সিনেমা হলে আমি আর অমিত, রাতের খাবার খেয়ে নাইট শোয় সিনেমায় গেছি, রাত আট থেকে সাড়ে দশটার শো। আমার মেসের পার্টনার সেদিন ছিল না।

মেস বলতে যা বোঝায়,তেমন নয়। পুরোন আমলের বাড়ি ,সদর দরজার ঢুকেই বরাবর ত্রিশ ফুট লম্বা ছ ফুট প্রশস্ত বারান্দা সংলগ্ন ডান দিকে দুটি ঘর, বারো বাই দশ বা তার বেশী,আর উচ্চতা এগার ফুটের কম নয়। বারান্দার দক্ষিনে বেশ কটা ধাপ সিঁড়ি নেমে অপ্রশস্ত নিচু উঠান। যার বামদিকে কোমর সমান সিমেন্ট বাঁধানো সুগভীর বড় কুয়ো ,সঙ্গে জল তোলার দড়ি বালতি কপিকল।কুয়োর দক্ষিন সংলগ্ন বাথরুম পায়খানা, আর উঠানের ডান দিকে রান্নার ঘর।

বাথরুম পায়খানার ও রান্নার ঘরের ছাদ বেশ নিচু , ছফুট মানুষের মাথা ঠেকে যাবে। কেমন বেশ পুরোন যেন খানিক বসে গেছে । আর তারপর সবার দক্ষিনে দুটো অব্যবহারকৃত ঘর ও সরু বারান্দা, নিচু ছাদ,ভাঙ্গাচোরা জানালা ,বহু দিনের পুরোন অনুমান হয়।জীর্ণ দুটো দরজার কপাটেই তালাচাবি লাগানোই থাকত।

চারদিক বাড়ির অবশিষ্ট অংশে আটফুট প্রাচীর থাকায় বাড়িটি পাশাপাশি বসতি থেকে পৃথক। সেসময়ে খাতড়ার যা বাড়ির ভাড়া, এতবড় নিরিবিলি বাড়ির ভাড়া বেশ কমছিল।এবাড়ীতে অনেক দিন কেউ বাস করত না, ফাঁকাই ছিল।

মালিক আমার পার্টনারের একটু পরিচিত, নিকট এক গ্রামের বাড়ী ,চাষবাস ছিল তার পেশা।এবাড়ী তার স্ত্রী ধন।শ্বশুরের একমাত্র কন্যা। তাই শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যুর পর এবাড়ি মেয়ে জামাইয়ের দখলে ছিল।

মেস বাড়ির পাশাপাশি দুটো ঘরে, দুই বন্ধু  থাকতাম। বাড়ির ঘর ভাড়া, রান্নার মাসীর বেতন  আর বিদ্যুতের বিল, আধাআধি ।আর মাসে খাবার মোট মিলের সংখ্যা হিসাব করে, মাস শেষে কার কটা মিল,সে ভাবেই টাকার ধার্য হবে সিদ্ধান্ত হয়। সবে  তখন কিছুদিন, এই মেসের বাসিন্দা।

অমিত কুলকার্নী থাকত তাদের ব্যাঙ্কের নিজস্ব লিজ নেওয়া ঘরে।কম ভাড়ার ফ্যামিলি কোয়ার্টারে, যদিও সে অবিবাহিত। কর্নাটকের ছেলে, অল্প বাংলা বুঝতে বলতে পারে। ভুতের সিনেমার ভক্ত।

সেদিন শো ছিল "ওহি ভয়ানক রাত", ভুতের সিনেমা দেখতে যখন হলে ঢুকলাম, চাঁদনী রাত, হালকা হাওয়া ছিল, মনোরম পরিস্কার আবহাওয়া। কিন্ত হলে শো দেখা দুই আড়াই ঘন্টার মাঝে ,এমন প্রতিকূল ঝড়জল রাতে পরিনত হবে,স্বপ্নে ভাবি নেই।যদিও ভরা শ্রাবনের আকাশকে বিশ্বাস করা বোকামি।

সিনেমার শো যখন শেষ হোলো, হল থেকে বের হয়ে দেখি ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক,মেঘের তীব্র গর্জন, আর অবিরাম বৃষ্টি। সঙ্গে ছাতা ছিল না। অগত্যা হলের সামনে সেডের নিচে অপেক্ষা করতে হল।লোডশেডিং এর জন্য সারা শহর অন্ধকারে ডুবে আছে,কেবল সিনেমা হলের সামনের  দিকে জেনারেটর কটা টিম টিম আলো জ্বালা আছে , যার আলো  সিনেমার হল থেকে এক দেড় শো মিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

রাতের শো, আবার ভুতের সিনেমা! মানুষ জন বেশ কম। অনেকের ছাতা সঙ্গেই ছিল,কেউ বা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াল। ভাগ্যবান কারোর বাড়ির লোক ছাতা এনে , তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল।রাত প্রায় সাড়ে এগারটা বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল । আমরা গুটিকয়েক হতভাগা যে যার মত বাড়ির দিকে রওনা হলাম। 

অমিত, করালি মোড়ের ঠিক আগে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে ডানদিকে বাঁক নিয়ে,গুড নাইট জানিয়ে চলে গেল। আরও দুজন তারা অন্য পথে চলে গেলে। নির্জন নিশুতি রাত,মেঘে ঢাকা কালো আকাশ। ঘন আঁধার বর্ষা ভেজা এত রাতে,কেমন যেন, একা ভীষণ ভয় করছিল। টর্চ জ্বেলে পুরোন কোর্ট দিকে মেসের পথে হাঁটতে লাগলাম। গার্লস স্কুলের কাছটা বেশ নিচু রাস্তা, বৃষ্টি হলেই জলে জমে ,জল নামতে অনেক সময় লাগে,একফুটের কাছাকাছি জল।

বৃষ্টিটা আবার টিপ টিপ শুরু হল,চামড়া সু জলে ভিজে ভারী ,এত জল ভেঙ্গে চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল । আর তার চেয়েও বড় সমস্যা ভয় যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলছিল।সিনেমার কিছু ভৌতিক ভয়ঙ্কর দৃশ্য ভাবার চেষ্টা না করলেও যেন, আপনা আপনিই মনে চলে আসছে।

মানুষ তো দুরে থাক কুকুর বিড়াল আজ যেন সবাই নিরাপদ আশ্রয় থেকে বের হয়নি। নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশে নিজের চলার প্রতিধ্বনি কেউ যেন পিছু নিয়েছে মনে হচ্ছিল। বার বার পিছনের দিকে তাকালেই কেমন গা ছমছম করছিল, সারা শরীরে কাটা দিচ্ছিল।

হঠাৎই কোন অসমতল গর্তে পা ঢুকে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোন মত ব্যালেন্স করে নিজেকে রক্ষা করলাম কিন্ত টর্চটা হাত থেকে রাস্তার জলে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ, জল থেকে তুললাম, আর জ্বলছে না। অনেক চেষ্টা বিফল হল,এবার গাড় অন্ধকারে টর্চ ছাড়াই টিপি টিপি বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটছিলাম।ততক্ষণ আমার নির্জন ফাঁকা মেস বাড়ি কাছে চলে এসেছি।

পকেট থেকে চাবির থোকা বার করে ,সদর দরজার চাবিটি ,অন্ধকারে অনুমানে ধরে এগুচ্ছি।  রাস্তার ডান দিকে ঘন ঘাসে ভর্তি প্রাঙ্গন,তারপর মেস বাড়ী সদর দরজা। সদরের চাবি খুলে ,বাহিরের এক কড়ায়, তালাটা ঝুলিয়ে লাগালাম।  অন্ধকারে  হাতড়ে আমার শোবার ঘরের চাবি অনুমানে হাতে ধরলাম। অকেজো টর্চ, বাম হাতে এমন ভাবে ধরলাম যেন বাড়ির ভিতর কেউ মানুষ বা অশরীরী থাকলে,অন্তত, একটা প্রতিরোধ করতে পারি।

আচমকা দরজার খুলেই দ্রুত আমার শোবার ঘরের দরজার দিকে ধাবিত হলাম।কেমন যেন বাদুর বা ঐ জাতীয় কিছু ঝটপট শব্দে উড়ে গেল, তীব্র আতংক আর ভয়ে দেখার চেষ্টা করার মত পরিস্থিতি আমার  ছিলনা। ভাগ্য ভালো,ঠিক ঘাটে লেগে চাবি খুলল, ঘরে ঢুকেই খিল লাগালাম। 

ঘন কালো অন্ধকার ঘরে ভীষণ ভয় হচ্ছিল, মানুষ নয় কোন ভয়ঙ্কর দর্শন বা আকৃতির ভুত প্রেত নেই তো! টেবিল হাতরে দেশলাই জ্বালিয়ে মোমবাতি ধরিয়ে যেই নিশ্চিত হয়েছি,কোন ভুত প্রেত অন্তত ঘরের ভিতর নেই। তখনই আমার ঘরের দরজার  বাইরে কেউ যেন তীব্র আঘাতে ধাক্কাধাক্কির শুরু করল। দরজার ভীষণ মজবুত তবু মনে হচ্ছিল ভেঙ্গে যাবে। কেমন ভয়ে কাঁপুনী ধরেছে, খাটে উঠে ,মোমবাতির আলো নিবিয়ে নীরবে অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইলাম। দেশলাই হাতে রাখলাম। ধাক্কাধাক্কির বন্ধ হয়েছিল, সদর দরজার কপাট ভয়ে লাগাতে ভুলেই গেছি খেয়াল হল। কিন্ত আবার আমার শোবার ঘরের কপাট খুলে সদরের দরজা লাগাবার সাহস আমার ছিল না।

 ভাবলাম তবে কী কোন দুষ্ট লোক বা চোর ডাকাত সদর খোলা পেয়ে ঢুকেছে! বা এখনও আছে! সহসা আবার শব্দ, মনে হল সদর দরজাটা কেউ ধাক্কাধাক্কির করে ভেঙ্গেই দেবে। চুপচাপ অন্ধকারে নীরবে বসে আছি। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও কেমন জোরে মনে হচ্ছে। একটু পর কেমন এক করুন আর্তনাদ না কান্না! আমার পিলে চমকে দিচ্ছিল! কুকুর ছানা! না বিড়াল! না মানুষের বাচ্চা! ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না।

আমাদের গ্রামের জাগ্রত ,বাবা ঈশানেশ্বরের পুষ্প মা মাদুলীতে ভরে,লাল সুতোয় তাবিজের মত বাম হাতের বাহুতে বেঁধে দিয়েছিলেন। এসবে আমার আস্থা থাক , আর না থাক,মায়ের বিশ্বাসে আঘাত না দিতে, এই লাল সুতোয় বাঁধা মাদুলীতে ভরা বাবা ঈশানেশ্বরের পুষ্প ধারন করে থাকতাম । আজ আমি এই মাদুলী পুষ্প চেপে ধরে বাবা ঈশানেশ্বর কে আকুল ভাবে ডাকতে লাগালাম।

কিছুক্ষণ পর কান্নার আওয়াজটা  ক্ষীণ হতে হতে থেমে গেল।

অবসন্ন ক্লান্ত শরীরে বিছানার উপর বসে বসেই কেমন ঘুমিয়ে গেছিলাম। আবার আমার ঘরের দরজায় তীব্র ধাক্কাধাক্কির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল ।একটু পর থামল।

ঘুম আর আসে নেই।ভোড়ের আলো ঘরের পশ্চিম দিকের জানালার ফাঁক দিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। ভোড়ের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। অনেক বেলা হল। তবু দরজা খুলতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। বাথরুম যাবা ভীষণ জরুরী, টন টন করছে,তবুও সব কষ্ট সহ্য করে নীরব বসেছিলাম ।

ঘড়িতে সকল আটটা। রান্নার মাসী দরজায় কড়া নেড়ে বাবু বাবু বলে হাঁকের আওয়াজে দ্রুত কপাট খুলে সদর দরজা খুলে দি,পরক্ষণেই খেয়াল হল আমি তো কাল রাতে সদর দরজার কপাট বন্ধ করতেই ভুলে গেছিলাম! কে দরজা লাগাল! খিল দিল! তবে কী কেউ বাড়ির ভিতরেই আছে!

রান্নার মাসীর বাপু রে! তীব্র ভয়ার্ত্ত চিৎকারে ছুটে তার নিকট গেলাম। মাসী কেমন নির্বাক ভয়ার্ত্ত মুখে দেখাল রান্নার ঘরে এক কুকুর ছানার আধ খাওয়া মৃত দেহ, পেটে নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে আছে। গতরাতে করুন কান্না আর্ত চিৎকার, তবে এই করছিল! মাথায় কোন কাজ করছিল না। কে সে, এই কুকুরের বাচ্চাকে জ্যান্ত খেল! আমার ঘরে ধাক্কাধাক্কির করল একবার নয় দুবার! আর কেই বা সদরের দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে খিল দিল ?

  রান্নার মাসীকে সব রাতের ঘটনা বলেই দিলাম। কেমন ভয়ে বির্বণমুখে বাড়ি থেকেই সে চলে গেল, আর এ বাড়ীর কাজে আসেনি।আর আমি এই দিনই এই মেস বাড়ী ছেড়ে অন্য মেসে পালাই। দুদিন পর আমার পার্টনার এলে সব বললে সেও বাড়ি ছেড়ে ছিল ।

এ ঘটনার কোন সদুত্তর আজও পাই নি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller