আমি ফকির

Thriller

4  

আমি ফকির

Thriller

খুনীর ভয়

খুনীর ভয়

12 mins
467


এক

রংচটা দেওয়াল গুলোর দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলো নিশা "আমায় অন্য কোথাও নিয়ে চলো। নাহলে কিন্তু আমি একাই চলে যাবো। আমি এই বাড়িতে কিছুতেই থাকতে পারবোনা।"

কথাটা বলে অন্তত দু মিনিট অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর পেলোনা নিশা। কাল থেকে এই একই কথা শুনে শুনে যে ওর মা বেশ বিরক্ত সেটা নিশা ভালোই বুঝতে পারছে। চিৎকার করে নিজের চাহিদাটা আরও একবার জানিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো ও।

পুরোপুরি নিজের ঘর বললেও ভুল বলা হবে। এই ঘরেই ওর বাবা মায়ের যাবতীয় জিনিসপত্র রাখা। আসলে ঘর তো এই একটাই। আর পাশের ঐটা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একটু বড়ো বলেই নিশার বাবা মা আজ থেকে ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিশার ঘরে তিনজনের থাকার যথেষ্ট জায়গা থাকতেও মেয়ের সুবিধার জন্য এইটুকু ওনারা মানিয়ে নিচ্ছেন। কাল রাতে নিশা সারা রাত টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। বাবা মায়ের সাথে রুম শেয়ার করতে ও নারাজ। তবুও মেয়েকে খুশি করা গেলোনা। এখানে এসে থেকে একই কথা আওড়ে যাচ্ছে মেয়ে।

নিজের ঘরে ঢুকেই আরও একবার চারিদিকে চোখটা বুলিয়ে নিলো নিশা। টিনের চালের ঘরটার সারা দেওয়ালে ড্যাম্প ধরা, কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। ঘরের একটা মাত্র জানলাটা দিয়ে আলো বাতাস কিছুই আসেনা ভালো মতো। দিনের বেলাতেও ঘরটা কেমন অন্ধকার। শুধু তাই নয়, জরাজীর্ণ বাথরুমটা আবার নিচের তলায়। এই বাড়িতে টানা এগারোটা মাস থাকতে হবে নিশাকে! ইচ্ছে করছে এখনই বাড়িটা ছেড়ে পালায় ও।

এরই মধ্যে ঘরের দরজা দিয়ে বাবাকে ঢুকতে দেখে চিৎকার করে উঠলো নিশা "কতবার বলেছি আমার ঘরে এরম হুটহাট ঢুকবে না।" ওর বাবা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ও।

কলেজে ওঠার পর থেকেই নিশা বড্ড বেশি উচ্ছশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু চিৎকার আর খারাপ ব্যবহার পেতে হয় ওর মা বাবাকে। বকাঝকা করেও কোনো লাভ হয়নি। গরিব বাবা মায়ের মেয়ে হয়ে জন্মানটাকে ও দুর্ভাগ্য বলে মনে করে।

নিশার বাবা মায়ের গোদের ওপর বিষফোঁড়াটা তখন হলো যখন অনেক খুঁজেও একটা ভালো বাড়ি জোগাড় করতে পারলেননা নিশার বাবা। এর আগের বাড়িটা এক প্রকার কপাল জোরে পাওয়া গেছিলো বলতে গেলে। ওই কটা টাকার মাইনেতে বাড়ি ভাড়া দিয়ে একটা সংসার টানতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় নিশার বাবা মা দুজনকেই। কিন্ত বাড়িটা ওনাদের ছেড়ে দিতেই হল।

নতুন বাড়ি দেখতে এসেই আতঙ্কে ছিলেন নিশার বাবা। উনি নিশ্চিত বুঝেছিলেন মেয়ে কিছুতেই রাজি হবেনা এই বাড়িতে থাকতে। কিন্তু আর তো কোনো উপায়ও নেই এই মুহূর্তে। তবুও মাত্র এগারোটা মাস যে দেখতে দেখতে কেটে যাবে এই বলেই মনকে সান্তনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই বাড়িতে এসে থেকে মেয়ের ব্যবহার ওনাদের সাথে মেয়ের দুরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শাসন করতেও এখন ভয় করে ওনাদের। মুখ বুজে সবটা সহ্য করছেন তাই। মেয়েকে অন্যান্য বাবা মায়ের মতো সবকিছু দিয়ে খুশি করতে না পারার অপরাধবোধও কিছুটা দায়ী ওর এই ব্যবহার সহ্য করার পেছনে।

দরজাটা বন্ধ করে খাটের ওপর এসে শুলো নিশা। আগের বাড়িতে অনেক ছোটবেলা থেকেই থেকেছে ও। বলতে গেলে তার আগের কথা নিশার মনেই পড়েনা । বাবা বলেছিলো এরপর একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠবে। কিন্তু নিয়ে এলো এই বাড়িতে! বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতেও কি বিচ্ছিরি! দেখে মনেই হয়না এই বাড়ির ভেতর মানুষ থাকতে পারে। সরু, এঁদো একটা গলির ভেতর চারতলা এই বাড়ি। বাড়ির একতলাটায় নাকি কোনকালে জুতোর কারখানা ছিল। এখন সেখানে তালা। দিনের বেলাতেও অন্ধকারে ডুবে থাকা সিঁড়িটা তালা বন্ধ কারখানাটার পাশ দিয়ে দোতলায় উঠে এসেছে। প্রচুর ভাঙাচোরা টব আর শুকনো ঝোপের দরুন দোতলাটাও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দোতলার ঘরগুলোর সবকটাই বহুদিন বন্ধ। ওগুলো নাকি একসময় ভাড়া দেওয়া হতো। তারপর কি একটা কারণে দোতলাটা আর ভাড়া দেওয়া হয়না। বাড়ির তিনতলায় এলে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। এইজায়গাটা একটু খোলামেলা। তিনতলা বাড়িওয়ালার বাসস্থান। তবে বাড়িওয়ালা অন্যত্র থাকেন, এখানে একেবারেই আসেননা । চারতলায় ছাদ। ছাদের ওপরের ঘরগুলোতেই একমাত্র মানুষের বসবাস এই বাড়িতে। তবে সবকটা ঘর নিয়ে এতদিন একটাই বড়ো পরিবার থাকতো ছাদের ওপর। পরিবারটি উঠে যাওয়ার পরই নিশারা এসেছে। বাকি ঘড়গুলোতে এখনও ভাড়াটে আসেনি। তাই এখন সারা বাড়িতে কেবল নিশাদের এই একটিই পরিবার।

বিছানায় শুয়ে নিশা অনেক্ষন ধরে এদিক ওদিক করছিলো। এইরকম একটা বাড়িতে কিভাবে ও ওর বন্ধুদের নিয়ে আসবে! ওর বন্ধুরা যেমন বাড়িতে থাকে তা দেখার পর আগের বাড়িতেই ওদের ডাকতে ওর লজ্জা করতো। নিশা বলেছিলো ওর বন্ধুদের, ওরা নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করলে একটা বড়ো পার্টি থ্রো করবে। এবার বন্ধুদের কি বলবে ও! এই ভাড়া বাড়িটায় মরে গেলেও নিশা বন্ধুদের আনতে পারবে না।

হঠাৎ দরজায় টোকা শুনে উঠে বসলো ও। দরজার বাইরে মা খাবার থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। সারাদিন রাগ করে কিছুই খায়নি মেয়েটা। আবারও দু চার কথা শুনিয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো নিশা। সবকিছুই অসহ্য লাগছে ওর। জানলাটা দিয়ে একটু একটু হাওয়া আসছে। ব্যাগ থেকে হেড ফোনটা বার করে কানে লাগিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো নিশা। পৌনে বারোটা বাজে। জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের গলিটা দেখা যায়। স্ট্রিট লাইটের নীচে একটা বিড়ালকে দেখতে পেলো নিশা, হেঁটে গলি ধরে সোজা বেরিয়ে যেতে যেতে অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। জানলার বাইরে সামনের বাড়িটার অন্ধকার দেওয়ালে এসে পড়া আলোটা হঠাৎ ঝুপ করে নিভে যেতেই নিশা নিশ্চিন্ত, বাবা মা আলো নিভিয়ে দিয়েছে, এবার ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। আরও কিছুক্ষন জানলার পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে এবার হেড ফোন আর মোবাইলটা টেবিলের ওপর রাখলো নিশা। ব্যাগ থেকে সিগেরেটটা বার করে জ্বালিয়ে জানলার ধারে ফিরে এলো। মনে মনে কি যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল তারপর।

সিগেরেটটা শেষ করেও বাইরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। ঠান্ডাটা হঠাৎই কেমন বেড়ে গেলো মনে হচ্ছে। প্রচন্ড শীত করছে। জানলাটা এবার বন্ধ না করলেই নয়। জানলার পাল্লাটা ধরে টানতে গিয়েই ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হলো। বাড়িটার দরজা জানলা সবই জরাজীর্ণ, এমন আওয়াজ হয়। নিস্তব্ধ ঘরটাতে শব্দটা হঠাৎই যেন চিৎকার করে উঠলো। খানিক চমকে উঠেছিলো নিশা। খানিকটা ধাতস্ত হয়ে জানলাটা পুরোপুরি বন্ধ করে পেছনে ফিরতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। জিনিসপত্রে ঠাসা অন্ধকার ঘরটায় টিনের চালের ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে যেন কারা বসে আছে ওর সামনে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নিশা সেই দিকে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। নিশা একভাবে দাঁড়িয়ে, এক দিকে চেয়ে। হঠাৎই ও দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো ছাদের ওপর। চারিদিকে এখন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। চাঁদের আলো বেছানো ছাদের মেঝেতে গাছের পাতা গুলো আলোছায়ার নকশা এঁকে দিয়েছে। নিশা এগিয়ে গেলো কার্নিশের দিকে। কার্নিশের ওপর হাত রাখতেই শরীরটা শিরশির করে উঠলো। শ্যাওলা ধরা কার্ণিশটা ভেজা ভেজা, অসম্ভব ঠান্ডা। হাতটা সরিয়ে নিলো ও। কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে পেছন ফিরে দাঁড়ালো নিশা। দেখতে লাগলো নিজের ঘরটা, মা বাবার ঘরটা আর পাশের তালা বন্ধ ঘর গুলো। এরপরেই ঘরগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো ও। থামলো সিঁড়ির কাছে এসে। দেওয়ালের ছায়ায় সিঁড়ির অনেকটা ঢেকে গেছে। বাকিটা ঝলমল করছে জোৎস্নায়। দারুন মায়াবী লাগছে দেখতে। সিঁড়ি ধরে নেমে এলো নিশা নিচে। এখানেই ওদের, মানে ওপরের ভাড়াটিয়াদের ব্যবহারের বাথরুমটা। বাথরুমটার পাশে অনেকটা খোলামেলা জায়গা। এটা অনেকটা ছোটো একটা ছাদের মতোই। বাড়িওয়ালার জন্য সংরক্ষিত তালাবন্ধ গ্রিলের দরজার পাশ দিয়ে হঠাৎই গাঢ় অন্ধকার নেমে গেছে নিচের দিকে। নিশা নেমে এলো ধীরে ধীরে দোতলায়। অন্ধকার, খুব অন্ধকার। আন্দাজে এগিয়ে চললো নিশা। মাঝেমাঝে এটা সেটায় পা লেগে যাচ্ছে। হঠাৎই খুব জোরে একটা হোঁচট খেলো নিশা। পড়ে গেলো মেঝেতে। মেঝেটা ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা, ঠিক যেন বরফের মতো।


দুই

চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটায় হুড়মুড় করে উঠে বসলো নিশা। এখনও ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। সামনে মাকে বসে থাকতে দেখেই কেঁদে উঠলো। আজ তিনদিন ধরে ও এমনটাই করছে। এতদিন ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও আজকের ঘটনার পর বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন নিশার মা। সোমবার সকালে এই বাড়িতে এসেছেন ওনারা। বুধবার রাত থেকেই ঘটনাগুলোর সূত্রপাত। হঠাৎই মাঝরাতে ওনাদের ঘরের দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে শুরু করে নিশা। ও নাকি বাথরুমের পাশে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। তারপর থেকে দিনের বেলাতেও ও নাকি সবসময় কাউকে দেখতে পায়। সেদিন থেকে নিশার মা নিশার সাথেই ঘুমাচ্ছেন রাতে। কিন্তু মায়ের সামনেও নিশা কান্নাকাটি করে, ও নাকি কাউকে দেখতে পায়। কাল মাঝরাতে হঠাৎ নিজের পাশে মেয়ের অনুপস্থিতি টের পেয়ে নিচে নেমে আসেন নিশার মা। বাথরুমে না পেয়ে অন্ধকার দোতলায় খুঁজতে এসে মেয়ের অজ্ঞান দেহটাকে পড়ে থাকতে দেখেন উনি। এখন নিশার মায়েরও দৃঢ় বিশ্বাস যে নিশা এতদিন যা বলেছে তা ওর মনের ভুল নয়। উনি নিজের চোখে দেখেছেন রাতের অন্ধকারে দোতলাটা কি অস্বাভাবিক, কি ভয়ঙ্কর দেখায়। পুরো বাড়িটাতেই কেমন গা ছমছম করে।

নিশাকে এবার জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন ওর মা কালকে রাতে ও দোতলায় কেন গেছিলো। ওকে কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। হারিয়ে ফেলেছিলো নিশা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ। নেমে গেছিলো ওই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। আর তারপরই একটা মেয়ে, অন্ধকারেও পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে নিশা। একটা মেয়ে, খোলা চুলে ঢাকা মুখটা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো ওর দিকে। তারপরই ঠান্ডা হাত দুটো দিয়ে ওর গলাটা টিপে ধরে। চিৎকার টুকুও করতে পারেনি নিশা।

মেয়েকে আবার জড়িয়ে ধরেন ওর মা। হঠাৎই নিশার বাবা ঘরে ঢুকতেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করেন বারবার, ফোনে পাওয়া গেছে কিনা। নিশার বাবা জানান বাড়ির মালিক ফোন ধরেছিলেন।

এই বাড়ি অনেক পুরোনো। বাড়িওয়ালার বাবার আমলে প্রচুর ভাড়াটেতে গমগম করতো বাড়িটা। দোতলার কয়েকটা ঘর ছেলেদের মেস হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। তবে বাড়িটার বয়েস বাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই বাড়ির যত্ন করেননি ওনার বাবা। ধীরে ধীরে ভাড়াটে কমতে থাকে। ওনার বাবা মারা যাওয়ার পরপরই এই বাড়ি মোটামুটি খালি হয়ে গেছে। এখনকার বাড়িওয়ালা সাউথ কলকাতার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন। আরও অনেক প্রপার্টির মালিক উনি। এই বাড়িটা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যাথাও নেই ওনার। শুধু ছাদের ওপরের ঘর গুলোতে অনেক পুরোনো সেই পরিবারটা থাকতো। টাকা জমাচ্ছিলো। এখন বাড়ি করে উঠে গেছে। নিশার বাবা নিজে থেকেই বাড়িটায় থাকতে চেয়েছিলেন বলে ওনাদের দেওয়া হয়েছে, তাও এগারো মাসের এগ্রিমেন্ট। নিশার বাবার কাকুতিমিনতি দেখেই ভাড়া দিয়েছিলেন বাড়িটা। নাহলে ওনাদের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো যে। কিন্তু বাড়িওয়ালা ওনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে এই বাড়ি পুরোনো হলেও কোনো ভূতের উপদ্রবের কথা কোনোদিনও শোনা যায়নি। আর দোতলার ঘর গুলো জীর্ণ অবস্থার জন্য বসবাসের অনুপযোগী, সেই জন্যই তালা বন্ধ।

স্ত্রী আর মেয়েকে ভালো করে এই কথা বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন নিশার বাবা। মেয়ের কান্নাকাটিতে ওর মা'ও খুব ভেঙে পড়েছেন। কিছুই শুনতে চাইছেননা।

পরদিন নিশার বাবাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কাল মাঝরাতে নিশা ওর মায়ের গলা টিপে ধরেছিলো। তারপরই নিশা অজ্ঞান হয়ে যায়। আজ সকালে তিনতলার সিঁড়ির কাছে একটা মা সহ তিনটে বিড়াল বাচ্চার ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া গেছে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে নিশাকে। ডাক্তার বিশেষ কিছুই বলেনি, কেবল দুটো ওষুধ লিখে ছেড়ে দিয়েছে। নিশার মা কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন ওর বাবার কাছে, খুব শিগগিরই যেন উনি অন্য বাড়ির ব্যবস্থা করেন। এই ভুতুড়ে বাড়িতে উনি মেয়েকে নিয়ে আর থাকতে চাননা। উনি নিশ্চিত বাড়িওয়ালা সত্যি কথা বলছেননা, কিছু একটা উনি লুকিয়েছেন। নিশার মুখটার দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন নিশার মা।

ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছেন নিশার বাবা। ওই কটা টাকার একটা চাকরি ছিল যা দিয়ে উনি ওনার মেয়েকে খুশি করতে পারেননি। সেই চাকরিটাও যে এভাবে চলে যাবে কে জানতো। একটা ফ্ল্যাট কেনার বড় ইচ্ছে ছিল নিশার বাবার। কিন্ত ফ্ল্যাট তো কোন ছাড় এখন রোজকার খাওয়াটাও কদিন জুটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিশা বড়ো হয়েছে। বাবার পরিস্থিতি সবটাই জানে ও। তবুও প্রতিদিন ওর হাতখরচের পরিমান বেড়েই চলেছে। টাকা না পেলে কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে মেয়েটা। মেয়ের ব্যবহারে চোখে জল আসে ওনার। আর এখন আবারও ওনার চোখে জল চলে এলো, মেয়ের অসহায় মুখটার দিকে চেয়ে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে মেয়েটা। একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এতো টাকা কোথায়। আর এতো তাড়াতাড়ি আরও একটা বাড়িই বা কিভাবে জোগাড় করবেন উনি। এই বাড়িটাই তো অনেক কষ্ট করে পাওয়া। এতো কম ভাড়ায় আর বাড়ি পাওয়া তো অসম্ভব। অবশেষে নিশার মা ওনাকে শেষ পথটাই বেছে নিতে অনুরোধ করলেন। নিমরাজি হয়েও বাধ্য হয়েই নিশার বাবাকে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকা কটায় হাত দিতে হলো।


তিন

গাড়ি থেকে জিনিসপত্র সব নামানো হয়ে গেছে। পাঁচতলা বিল্ডিংটার সামনে এসে দাঁড়ালো নিশা। চারতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটটা ওদের। নতুন বিল্ডিংটার এই ফ্ল্যাটের মালিক বিদেশ চলে যাচ্ছেন তাই ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিলেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে ভবিষ্যতের চিন্তা আপাতত দূর করতেই হলো নিশার বাবা মাকে।

নতুন রং করা ঝাঁ চকচকে ঘর গুলো দেখে নিশার দু চোখ চিকচিক করে উঠলো। নিশা ওর পছন্দ মতো ঘরটা বেছে নিলো।

দু মাস কেটে গেছে। এই ফ্ল্যাটে এসে থেকেই নিশার সব ভয় উধাও হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় এখন মাঝেমাঝেই রাত অবধি নিশা ওর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে কিসব জানি করে। নিশার বাবা এখনও রোজ কাজের খোঁজে বেরোন। আর ওর মা রাস্তার মোড়ে ঠ্যালা গাড়িতে একটা রুটির দোকান দিয়েছেন। এইভাবে আর টানতে পারছেননা ওনারা। মেয়ের অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেদিন অনেক রাত্রে দোকান গুছিয়ে ওর বাবা মা বাড়ি ফিরলে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে নিশা এক হাজার টাকা চেয়ে বসে ওর বাবার কাছে। টাকা না পেতে বাবার গায়ে হাত তুলতেও পিছুপা হয়নি নিশা। পাঁচশো টাকা আদায় করে নিজের ঘরে এসে দরজা দিয়ে দিয়েছিলো ও। বাবা মায়ের কান্নার আওয়াজ কানে এসে পৌঁছয়নি নিশার। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশা সেদিন।


চার

নিশার ঘুম সেদিন ভেঙেছিল। মাথাটা তখনো ঝিমঝিম করছে। চোখ মেলে তাকালেও আবছা ঠেকলো চারিদিক। নিশার হাতের মুঠোয় তখনো পাঁচশো টাকার নোটটা গোঁজা। বিছানায় বসে ঢুলছিল ও আরও কিছুক্ষন। হঠাৎই যেন নেশাটা একেবারে কেটে গেলো। এই গরমকালে ওর হঠাৎ এতো শীত করছে কেন? আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, অন্ধকার। আর তার মাঝে কোথা দিয়ে যেন একটু একটু আলো এসে পড়েছে। চোখটা ভালো করে রগড়ে নিয়ে উঠে বসলো নিশা। ভয়ে কেঁপে উঠলো ওর সারা শরীর। কারা যেন বসে আছে ওর সামনে। "কে?" বলে কয়েকবার কাঁপা গলায় ডেকে উঠলো নিশা। উত্তর না পেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সেই দিকে। গলা শুকিয়ে এলো ওর। কি দেখছে ও এটা! এগুলো তো ওর বাবামায়ের ঘরে থাকার কথা। ওর ঘরে এগুলো কি করে এলো! হঠাৎই ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হয়ে ঠান্ডা হাওয়ার একটা স্রোত এসে ধাক্কা মারলো নিশাকে। নিশা কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এটা হতে পারেনা, কিছুতেই পারেনা। এটা তো সেই দরজাটা। দরজাটা খুলে গেছে। ও কোথায় এখন? বিস্ফারিত চোখ দিয়ে দরজার বাইরের সেই জ্যোৎস্না বেছানো ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে নিশা। মেঝেতে গাছের পাতার ছায়া গুলো হাওয়ার সাথে সাথে দুলছে। হঠাৎই কাকে যেন দেখতে পেলো নিশা। ওকে যেন দু হাত বাড়িয়ে ডাকছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই রাতে, নিশার বানানো গল্পটায়। নিশা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা। এগিয়ে গেলো তাকে অনুসরণ করে। দোতলায় আসার পর হুঁশ ফিরলো নিশার। অন্ধকার ওকে গিলে খেতে আসছে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে কিসে জানি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল নিশা। নিশা জানে ওটা একটা ইঁটের টুকরো। দোতলার ভাঙাচোরা টবগুলোর পাশেই পড়ে থাকা সেই বড় ইঁটের টুকরোটা। এইভাবেই তো নিশা সেদিনও পড়ে গেছিলো ঐটায় হোঁচট খেয়ে। তবে সেদিন ওর ভয় করেনি। সেদিন ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর বাড়িটার ভাঙাচোরা অবস্থার সুযোগ নিয়ে বানিয়েছিলো গল্পটা। দিনের পর দিন নাটক করেছে ও। বোকা বানিয়েছে ওর বাবা মাকে। হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ এসে কানে লাগলো। আওয়াজটা আসছে তিনতলার সিঁড়ির কাছ থেকে। কোনো সন্দেহ নেই ওটা বিড়ালের ডাক। ঠিক যেখানে ঘুমন্ত বিড়াল গুলোকে পেনের আঁচড়ে শেষ করে দিয়েছিল ও একদিন। দরদর করে ঘামছে নিশা। আজও ও ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু উঠতে গিয়েই চোখে পড়লো মেয়েটাকে। মাথায় খোলা চুল। ঠিক সেদিনের মতো। নিশা জানে এবার কি হতে চলেছে। প্রানপনে ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু ও পারছে না। হাত দুটো ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আরও আরও আরও এগিয়ে আসছে। চেপে ধরলো ঠান্ডা হাতদুটো নিশার গলা। চিৎকার করতে পারলো না নিশা। কিন্তু, কিন্তু মেয়েটার মুখটা যে ওর বড় চেনা। সেদিন নিশা মেয়েটার মুখ দেখতে পায়নি। হয়তো গল্পে সেদিন অতটা প্রয়োজন ছিলোনা। কিন্তু আজ ও দেখতে পেলো। একেবারে পরিষ্কার। নিশার গলা চেপে ধরেছে আর একটা নিশা। হুবহু এক। ও আর পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিশা মেরে ফেলছে নিশাকে। গলা টিপে নিশা মেরে ফেললো। নিশাকে মেরে ফেললো।


অন্তিম

বড় রাস্তার মোড়ে রুটির দোকানটা এখন বেশ রমরমিয়ে চলছে। এখন আর সেই ঠ্যালা গাড়ি নেই। একটা ছোটো খাটো ফাস্টফুড শপে পরিণত হয়েছে দোকানটা। রুটিসহ আরও নানা রকম খাবার তৈরী হয় এই দোকানে। দম্পতিটি দ্বারা চালিত এই দোকানের নাম "নিশা ফাস্টফুড সেন্টার"

থানা পুলিশ করেও মেয়েকে আর খুঁজে পাননি ওনারা। ওই বাড়িটাতেও খোঁজা হয়েছিল কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ওনারা এটাও জানতে পেরেছেন ওই বাড়ি সম্পর্কে বাড়িওয়ালা সেদিন কোনো মিথ্যে কথা বলেননি। ওই বাড়িটার জায়গায় এখন ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গেছে। ওনারা ধরেই নিয়েছেন মেয়ে আর বেঁচে নেই। দুঃখ কষ্ট অতিক্রম করে মেয়েকে মনে রেখেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন ওনারা।

কিন্তু ওনারা জানেননা নিশা এখনও আছে, ওই বাড়িটাও এখনও আছে, শুধু বাস্তব জগত থেকে ওদের অস্তিত্ব মুছে গেছে। ওই বাড়ির ভেতর এখনও ও প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে। প্রতিদিন ও নিজেই নিজেকে গলা টিপে মারে। আবার চোখ মেলে তাকায়। ভয় পায়। কাঁদে। চিৎকার করে। কিন্তু কেউ শুনতে পায়না ওর কান্না। কাঁদতে কাঁদতে আবার পালাতে যায়। আর তখনই দুটো ঠান্ডা হাত ওর গলা টিপে ধরে। শুধু ওই বাড়িতেই নয় আরও কত বাড়িতে কত নিশা নিজের গলা টিপে নিজেকেই খুন করছে রোজ। এই নিশাদের আমি দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।


                                                              সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller