Anindya Biswas

Tragedy Others

3  

Anindya Biswas

Tragedy Others

' ডিভোর্সী '

' ডিভোর্সী '

7 mins
174


"এই তিতলী, এই দাড়া, দাড়া বলছি, বাপরে বাপ কি দস্যু হয়েছে মেয়েটা, দাড়া পারছিনা , এই কই গেলো?"-- তিতলির পিছনে ছুটতে ছুটতে মহুয়ার ডাক।

মহুয়া রায়। ডঃ মহুয়া রায়। জেলা হসপিটাল এ নতুন এসেছেন। শান্ত, স্থিত,পরম দয়ালু, আবার কাজেকর্মে ভীষন পটু। অল্প দিনেই বাকি সহকর্মীদের সম্মান ও সমীহ আদায় করে নিয়েছে। পেশেন্ট মহল, আসে পাশের মানুষজন ভীষন সম্মান করে মহুয়াকে।


মহুয়ার একমাত্র মেয়ে তিতলী। ভালো নাম মৃগানকিকা রায়। ৩-৪ বছর বয়েস। জামাই রজত কর্মসূত্রে বাইরে থাকে। তাই মেয়েকে নিয়ে মহুয়া একাই থাকে কোয়ার্টারে। মাঝে মধ্যে মা বাবা , শ্বশুর - শাশুড়ি এসে দেখে যান।


মেয়ে ছোট হওয়ার কারণে মেয়েকে নিয়ে মাঝে মাঝে অফিসে নিয়ে আসে মহুয়া। এই দিকটায় কাজের লোক পাওয়া কষ্ট। সবসময় আসেও না।


তিতলী ছোট। মিষ্টি, দুরন্ত। আবার ভীষন ভাবে মিশতে পারে সবার সঙ্গে। হসপিটাল এ সবার সঙ্গেই তার খুব ভাব। 


" তিতলী তুমি কিন্তু আজ ভীষন দুষ্টু করছো, দাড়াও না মা "-- মহুয়া হাঁফ ধরে যাচ্ছে। সত্যি দিনে দিনে যা দস্যু হচ্ছে না মেয়েটা।


দৌড়াতে দৌড়াতে হটাতই তিতলী এক পেশেন্ট (রজত) এর গায়ে ধাক্কা লেগে গেলো। তাল সামলাতে না পেরে রজত হুড়মুড়িয়ে পড়লো। তার বগলে ক্রাচ।


"এরাম, সরি সরি, হায় হায়, এটা কি করলি তিতলী, আপনি কিছু মনে করবেননা, সরি -- একই রজত" বলে মহুয়া থেমে গেলো।

রজত ও ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে থ।


মহুয়ার বিয়ের দেখাশোনা যখন চলছিল, তখনই হটাৎ রজতের সঙ্গে আলাপ। রজত ইঞ্জিনিয়ার ছিলো। সরকারি দপ্তরে। মার একটা সমস্যা নিয়ে মহুয়ার চেম্বার এ এসেছিল। তখনই আলাপ। আলাপ ক্রমশই বন্ধুত্বের দিকে গড়ায়।


রজত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও গল্প, কবিতা লেখা তার সখ। আর মহুয়া তো বইপোকা। রজতের এই লেখালেখি করার স্বভাব তাকে ভীষন ভাবে আকৃষ্ট করতো। ভীষন উৎসাহ যোগাত। রজতের শান্ত শিষ্ট অন্তর্মুখী স্বভাব -- মহুয়ার কাছে একটা প্রশান্ত বাড়ির মত মনে হতো।


আলাপ ক্রমশ গভীরের দিকে যেতে মহুয়া একদিন রজতকে বলেই ফেললো " আমাকে কি মনে হয় তোমার?" রজত হালকা হেসে বলতো " ভালো বন্ধু, আর কি?" -- মহুয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলতো," বন্ধু তো, যাও তাহলে, কথা বলবেনা।"পরক্ষনেই রজতের উদাস হওয়া দেখে সব ভুলে যেত। 


তবে সবসময় মনে হতো, রজত কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে। তার মন আরো অনেক গভীর, অনেক অতল। ডুবতে চায় মহুয়া সে গভীরে, কিন্তু ডুবতে দেয়না রজত।

 ওদিকে মহুয়ার বাড়িতেও দেখাশোনা চলছে। অবশ্য মহুয়ার মা বাবা মহুয়ার পছন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুললেন না।

মহুয়া সে কথা রজতকে জানাতেই রজত তাকে তার মা বাবার সম্মতিতে সায় দিতে বললো। তবু মহুয়া দমল না। তার জানতেই হবে রজত কি লোকায়। 


মহুয়া " বিকেলে পার্ক এ দেখা করবে?, জরুরি কথা আছে।"

রজত "কেন;কিছু হয়েছে?"

মহুয়া ফোন রেখে দিল।


বিকেলে দেখা হতেই মহুয়া একটানে রজতের হাত নিজের মাথায় দিয়ে বললো " আমার মাথার দিব্যি খাও আর বলো, কি লোকাচ্ছ?"


রজত " এই, কি পাগলামি করছো, ছাড়ো , কি লোকাব "-- কিন্তু মহুয়ার শক্ত চাউনি আর মুঠি, দুটোকেই অগ্রাহ্য করতে পারলনা।


রজত " বলছি, হাত ছাড়ো, বলবো বললাম তো"


হাত ছাড়িয়ে রজত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবার মনে করতে হবে তার অন্ধকার দিনগুলো।


রজত " শোনো মহুয়া; এই কথা ঠিকই; আমি তোমাকে ভীষন ভালোবাসি, খুবই পছন্দ করি,কিন্তু তোমার কাছে আসতে চাইনা আমি। পালিয়ে থাকতে চাই। "-- বলে একটু থামলো।


মহুয়া: " কেনো?"


রজত:" আসলে তোমাকে বলা হয়নি, বা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল আমার। আমার একবার বিয়ে হয়েছিল। সবই দেখেশুনে। কিন্তু বিয়ের পরে জানলাম আমার স্ত্রীর আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছেই ছিলনা। চাপে পরে বিয়ে করেছে। ভেঙে গেছিলাম। তবুও মন শক্ত করে ভালোবেসে গেছি। স্বামী হিসেবে যতটুকু কর্তব্য আমার; করার চেষ্টা করেছি। রক্ত জল করা পরিশ্রম করেছি, যদি সে একটু তাকায় , একটু ভালোবাসে, একটু বোঝে।কিন্তু বিধি বাম। বদলে জুটতো খালি উপেক্ষা, গালী গালাজ। সে ভালোবাসতো ঠিকই, তবে নিজের প্রয়োজনে । স্বামী - স্ত্রীর যে একটা মানসিক খোরাক আছে, মানসিক যোগাযোগ আছে, সেটা আমি কোনোদিনও পাইনী। বদলে খালি জুটেছে মানসিক নির্যাতন। ভীষন ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এই বুঝি কিছু খারাপ হয়। অনেক কষ্টে বের হয়ে এসেছি । সাংঘাতিক মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। বাঁচার ইচ্ছেই ছিলনা।"- বলে রজত ঢোক গিলল। মহুয়া থ ।


" তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম চেম্বার এ, জানিনা কেনো , হটাতই আবার সবকিছু ভালো লাগছিল। তারপর তোমার সঙ্গে মিশে, কথা বলে আমার অনেক দিন পর খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারতাম । কিন্তু আস্তে আস্তে মনে হতে লাগলো, আমি তো ডিভোর্সী। কারণ হয়তো আমি জানি; কিন্তু সমাজ হয়তো মানবে না। আমাকে গ্রহণ করতে সহজে চাইবেনা। তাই দূরে সরে থাকতাম। চায়নি আমার সঙ্গে জড়িয়ে আমার "মহু" - র কোনো বদনাম রটে, তার মা বাবার সমাজের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ।"


মহুয়া "মহু?-- বাঃ সুন্দর তো। এত কিউট নাম" বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

রজত ড্যব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ভাবছে এই মেয়ের মাথায় কি কিছুই ঢোকেনি। 


 মহুয়া :" শোনো মিস্টার, আমি কাকে বিয়ে করবো, না করবো, সেটা আমার ডিসিশন। আমার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে - ভালো খারাপ বোঝার। তোমার সাথে মিশেই বুঝেছি তুমি একটা আদ্য প্রান্ত পত্নিনিষ্ট, মাতৃভক্ত ভদ্রলোক - কীকরে দুজনকে এক আসনেই রাখা যায়, সেটা জানো। তুমি ডিভোর্সী দেখে আমি রাজি হবনা, সেটা কিভাবে ভাবলে। পাগল যতসব। দুচ্ছাই।"

রজত :" কিন্তু?"

মহুয়া :"কোনো কিন্তু নয়, বাড়ি যাবো, অনেক কথা আছে মা বাবার সঙ্গে , তুমিও যাও, গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম দাও" বলে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো।


রজত এর আজ ভীষন হালকা লাগছে। মনে আবার রামধনু মেলে উঠেছে।


বাড়িতে গিয়ে মহুয়া মা - বাবার কাছে সব কথাই খুলে বললো । খালি ডিভোর্সের প্রসঙ্গ এড়িয়ে। মা বাবাও হাসতে হাসতে সম্মতি দিলেন । 


মা:" পাগল মেয়ে , এতদিন লুকিয়ে রেখে দিলি? তা ছেলেটাকে একবার দেখা।"


মহুয়াও হাসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক।

তার এই অবস্থা মা বাবার চোখ এড়ায় না। কিন্তু কিছু বলেনা।


" কি জানি , কথাটা না জানিয়ে ঠিক করলাম না ভুল, জানলে জানি কি বলে"- মহুয়া আনমনে ভাবছে। এর মধ্যেই রজতের ফোন। কেটে দিল ফোনটা।


দুদিন কোনো কথা নেই দুজনের মধ্যে।

হটাতই মহুয়ার বাবার রাগের মুখে প্রবেশ। 


বাবা: " এই কে কোথায় আছো, এক্ষনি বেরিয়ে আস। শুনছো, মহুয়ার মা, মেয়েতো আমাদের মান - সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল। ছি ছি ছি। ভাবতেও পারছিনা। শেষ অব্দি এই দেখতে হবে?"

মহুয়ার মা:" আরে কি হয়েছে, এত কি রাগ? কি করল মহুয়া।" 


"ডাক দাও তোমার মেয়েকে, এখনই ডাকো"


" কি জানি করলো? মহুয়া; মা আমার , একবার আয় তো, তোর বাবা ডাকছে "

মহুয়া আসতেই বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলো যা বুঝার।

মহুয়া " বাবা, আমি জানি বলাটা ঠিক হয়নি, বললাম হলে আস্তে আস্তে"


বাবা:" কবে বললে হলে, বিয়ের পর?"

 মহুয়ার মা"আহ, তুমি চুপ করো তো, কি হয়েছে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা ।"

 বাবা: " তুমি জানতে মহুয়ার যে ছেলেকে পছন্দ, সে একটা ডিভোর্সী"

 মহুয়ার মা: " সেকি, কই নাতো?"

 

 মহুয়া :" সবই বললাম হলে মা, আস্তে আস্তে।"

 

 মহুয়ার বাবা: " কোনো জোরে আস্তে না, এ বিয়ে হবেনা।"

 

 মহুয়ার মা: " কিন্তু মেয়ের পছন্দ টাও তো একবার দেখে নাও, একবার কথা বলে দেখি, ভালও তো হতে পারে।"

 অবশেষে অনেক পীড়াপিড়ির পর মহুয়ার বাবা রাজি হলেন। কিন্তু তিনি মনে মনে অনড়।

 

একদিন রজত এলো । কথাবার্তা বলতে বলতে মহুয়ার মার বেশ ভালো লাগলো। সত্যি ছেলেটা ভালো। কিন্তু মহুয়ার বাবা এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন।


মহুয়ার বাবা :" কত কামাও?"

রজত বললো।

" ডিভোর্স এর কারণ জানা যাবে?"

রজত সবই খোলাখুলি বললো।

মহুয়ার বাবা : " শোনো, বাবা হিসেবে আশা করি তুমি বুঝবে, যে মহুয়ার জন্য আমি ভালো একটা ছেলেই খুঁজব। সেরকম পাত্র আমার নজরেও আছে । অনেক বেশি রোজগারও করে । আমারই বন্ধুর ছেলে। তো তাকে ছেড়ে তোমার কাছে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো কেনো?"

 রজত এর মুখে কালো অন্ধকার।


মহুয়ার বাবা:" তার উপর তুমি ডিভোর্সী। তা যেই কারণেই হোক না কেনো । মহুয়া একটা প্রতিষ্ঠিত ডক্টর। সমাজে তার একটা সম্মান আছে। তোমার বা তোমাদের বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক আছে শুনলে কি বলবে, কোনো ধারণা আছে তোমার? "

মহুয়া:" বাবা !"


" তুই চুপ কর, বুঝবিনা, কোথাকার না কোথাকার ছেলে। বউ এনে আবার তাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির লোক কেমন নেই ঠিক, এমন ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে ভাসিয়ে দিতে পারিনা।"


রজতের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।


রজত:" শুনুন, আপনি আমাকে এইভাবে কথা বলছেন, আমি সহ্য করছি। কিন্তু আমার মা বাবার বেপারে এভাবে বলার আপনাকে অধিকার দিল কে?"


মহুয়ার বাবা:" দেখছ ডিভোর্সীর কথার ধার, এই শিক্ষে দিয়েছে"


রজত (প্রচন্ড রাগে):" কেনো আমি কি পাপ করেছি একটা অসুস্থ, বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বার হয়ে? যেখানে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত খালি মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছি, নিজের মান সম্মান সব হারিয়েছি? বার বার নিজের মা বাবার অপমান দেখেও চুপ করে রয়েছি? নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি? আপনি যাই বলুন স্যার, আমি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নাই, আমি ডিভোর্সী বলে, আমার একমাত্র যেটা ভাবনার জায়গা ছিলো, সেটা তো আপনি প্রকাশ্যে দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু রোজ সকালে আয়নাতে নিজেকে আমি ডিভোর্সী হিসেবে দেখিনা আমি, দেখি এক বীরকে, যে এত সমাজ , এত সংস্কারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছে, একটু ভালো থাকার জন্যে। আশা করি মানুষ হিসেবে আমার অতটুকু পাওনা আছে নিজের কাছে।"


ঘুরে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো," সরি মহূ, আমি তোমাকে ভালোবাসি ঠিকই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি একা তোমাকে বিয়ে করতে চাইনা, তোমার পুরো পরিবারকে আপন করতে চাই। তোমার মা বাবার দ্বিধা আমাকে নিয়েও ঠিক।কোনো ভুল নেই তাদের। কিন্তু আমিও বোধয় ভুল না।"


মহুয়া :" না রজত, ভুলটা আমারই।" বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।


রজত কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেলো। আর কোনো যোগাযোগ নেই তাদের। রজত ও বদলি হয়ে চলে গেলো।মহুয়াও ভুলে গেছিল আস্তে আস্তে। সংসার জীবনেও মোটের উপর খুশি।


আজ অনেকদিন বাদে দেখা হওয়াতে দুজনেই নির্বাক, নিষ্পলক। তিতলী ও কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।


অনেক কষ্টে মহুয়ার মুখে এলো:" ভালো আছো?"


রজত:" হ্যাঁ, তুমি?"


মহুয়া কিছু বললোনা। নিঃশব্দে তিতলির হাত ধরে বেরিয়ে এলো।


তিতলী :" মাম্মাম, তুমি কি চিনতে আঙ্কেল টাকে? কে ওটা ?"

মহুয়া (অন্যমনস্ক ভাবে):"হ্যাঁ, চিনি ,' ডিভোর্সী ।"


তিতলী:"মানে কী? "


মহুয়া (অপ্রস্তুত ভাবে): "বুঝতে হবেনা, চলো।"


 রজত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভাবছে,হয়তো আজ তারই হতো সব। কিন্তু কাউকেই আর মনে ধরেনি। কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছেও করেনি। এগোয়নি।

 

কারণ সেতো ' ডিভোর্সী '। ছেলে। তার কথা তো শুনবেনা কেউ।


 





 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy