Tohidul Islam

Others

4  

Tohidul Islam

Others

ওরা কারা

ওরা কারা

14 mins
349


ওরা_কারা

তহিদুল ইসলাম

রায় বাড়ির পূজো সেরে নরহরি ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাড়ি ফিরছেন। সঙ্গে আপনার ছায়াসঙ্গী। সময় সময় তাঁর সাথে মজা করতে জোছনা রাতে গাছের আড়ালে; লুকিয়ে পড়ছে সে।

রায় বাড়ি অর্থাৎ জমিদার বাড়ি কাশীপুর গ্ৰামের পর একটা সুবিশাল মাঠ পেরিয়ে তারপর শাল বাগানের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অচীনতলা প্রায় দেড়-দু ঘন্টার পথ।

নরহরি, আপনার নায্য পাওনা রায় বাহাদুরের নিকট বুঝে নিয়ে প্রণামী টা ধুতির ট্যারে গুঁজে নিলেন। একটা নতুন গামছার এক প্রান্ত বাম হাতে পেঁচিয়ে অপর প্রান্তে দু-কিলো চাল, শ'তিনেক ডাল আর একটু প্রসাদ বেঁধে ঘাড়ের উপর দিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে দেন । রায় বাড়ি থেকে বেরুতেই অনেক রাত হয়ে গেল তার ।

আশ্বীন মাসে পূর্ণীমা তীথিতে জোনাক ভরা এক মায়াবী রাত; যত বাড়তে থাকে; হাটের লোকজন কিংবা রাস্তার শ্রান্ত পথচারী অবশেষে বাড়িমুখো হলে পথঘাট শুনশান হতে থাকে। নিঝুম নিস্তব্ধ রাতে রাত্রীদেবী রাস্তার দুইধারে ঝোঁপ ঝাড়ের তলায় তার আঁধার কালো আঁচলখানি যেন বিছিয়ে দিয়েছেন।

কাশীপুর গ্ৰামের পর নরহরি মাঠের মেঠোপথ ধরেন। স্বভাবজাত ভাবেই তিনি হরিনাম গে'য়ে ওঠেন, গুনগুন স্বরে দ্রুত পা চালাচ্ছেন । আবার মাঝে মধ্যে মনের; আনন্দে হরিনাম বলে চিৎকার করে উঠেন । রাতের দ্বি-প্রহরে; ফাঁকা মাঠের ব্যাকুল নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিধ্বনিটা কানে এসে লাগলে সহজেই অনুমেয় শুনশান নির্জন প্রান্তর কতটা বিরহ কাতর। অদূরেই পেঁচা ডেকে উঠলে লক্ষণটা ভালো ঠেকল না তাঁর।

এই রাস্তা দিয়ে নরহরিকে প্রায় যাতায়াত করতে হয়। তাই রাস্তাটা হাতের চেটোর মতই তাঁর কাছে পরিচিত। রায় বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোনও কোনও দিন চাঁদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়, কথা হয়। তারা পাশাপাশি চলার সময় দুজনে কথা বলে। পাশ থেকে তাদেরে কথোপকথন শুনতে কৌতূহলী মুখগুলো জড়ো হলে, নরহরি র গা'টা ভারি হয়ে আসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

একটা আফশোস বারবার বেজে ওঠে, একটা বিড়ি, একটা দেশলাই….ভয়টা গায়েব হয়ে যেত হয়তো। এজন্য বুম্বাদা কতদিন বলেছে, বলিও; নরহরি, তামাক সেবন করো । নইলে পস্তাবে পরে। এর গুনাগুন জানো ? এই যেমন ধর, মাথায়; কাজ করছে না, বিড়ির পাছাটা ফুকে ধরিয়ে ঠোঁটে ধরলে, একটা সুখটানে নিমেষেই কিস্তিমাত। দেখবে, মাথা থেকে কাজগুলো পরপর বেরিয়ে আসছে । আবার, অন্ধকার রাতে একা আসতে ভয় পাচ্ছো, একটা বিড়ি খরচ করো, ভূতপেত্নী কখনো তোমার ; ত্রি-সীমানায় ঘেঁষবে না। বুঝলে নরহরি, মাথায় কিছু ঢুকলো ? 

অমন আজেবাজে ভাবনা, দুর্ভাবনা গুলো যখন মাথায় চেপে বসেছে, তখন সাঁড়াশি চাপা বুকটা উঠছে আর পড়ছে, হাতপা আড়ষ্ট হয়ে আসছে । বাতাস কেটে হনহন করে ছুটতে চায়লেও ছোটা যাচ্ছে না। ছুটেও লাভ হবে না তেমনটি । পথটা তো এইটুকু নয়, তিড়িং করে তিন লাফ দিয়ে পার হয়ে যাবে। কাছে পিঠে নাঁকিসুর ধ্বনিত হলে নরহরি থমকে দাঁড়ালেন।

– নঁ-রঁ-হঁ-রিঁ

জোছনা ধোঁয়া ফাঁকা মাঠ, গভীর রাত্রিতে তাও আবার ব্যঙ্গাত্মক নারীকণ্ঠ, ভাবতে বেশ অবাক লাগছে তাঁকে! কণ্ঠটা ফের বাতাসে এলো,

– নঁ-রঁ-হঁ-রি ! বঁলিও নঁরহরিঁই !!

নরহরি এবারে চমকে উঠলেন ! মেয়েলি কণ্ঠে কি তাকে ভয় দেখানোর অপচেষ্টা করছে ! না বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পথহারা পথিকের; সর্বস্ব লুট করতে চায়ছে ! উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেলেন ! পরমুহূর্তে সমস্ত উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে ক্ষণিকের জন্য পৌঢ় ব্রাহ্মণ অষ্টাদশী যুবক হয়ে উঠলেন ! দম্ভের সাথে বলেন, যাগ্গে ওসব ! অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাবে কে? আমার সম্পদ বলতে,পিঠে চালের পুঁটুলি আর প্রণামী হিসেবে ক'টা কয়েন। এই তো ,

এই বলে নিজেকে সাহস যোগাচ্ছেন। পরক্ষণেই সংশয় জাগলো তাঁর, কানটা ঠিক আছে তো ! যে কণ্ঠটা কানে এলো, ঠিক শুনেছি তো ! না; অন্য কোনো ……!' ভাবতে গিয়ে গা'টা শিউরে উঠলো, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা চোরা শীতলস্রোত বয়ে গেল।

নরহরি আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, জোছনা ভরা রাত, জনহীন প্রান্তর। প্রাণী বলতে সে একাই । রাস্তার ধারে জোনাক ধোঁয়া ছোট বড় ঢিবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । যা দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হল না, মায়াবী পূর্ণীমা রাতে রাস্তার ধারে ঝোঁপ ঝাড়গুলো জ্যোৎস্না মেখে নিজেদের মধ্যেই আত্মগোপন করেছে। সামনে দুইটা বুড়াবুড়ি একে অপরকে জড়িয়ে রাস্তার উপর আলিঙ্গনাবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে । এভাবেই তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে, গ্রীষ্মের তাপদাহে একসাথে সুখেদুখে ,প্রায় দ্বি শতবর্ষীয় এক বিশালাকার মহীরুহ বট-অশ্বত্থের পরিবারটি।

ব্রাহ্মণকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে আবারো কণ্ঠ টা কানে এলো, এই যে মশায়, এই দিকে।'

নরহরি সামনের গাছটির দিকে লক্ষ্য রাখতেই, একটা ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য, ' হ্যাঁ,হ্যাঁ আপনাকেই বলছি!'

ভয়ের পরে ভয়, ভয় শুধুই ভয়,

আর সাহস ধরলে ডাকাবুকো হৈ।

এই ভেবে সাহসের চরম শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এবারে গলাটাকে চড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কে?? কে ওখানে ?? 

— আমরাই গো, প্লিজ , একটু এইদিকে ….

—ওখানে যাওয়ার নেই । আপনারাই আসতে পারেন….

-- আলোয় যে আমাদের অস্তিত্ব নেইগো , সমস্যা টা এইখানে। এই বলে মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ।

নরহরিও কৌতুহলের সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করে বসেন,

-- কেন ??? আপনারা কী তাহলে  ???

-- বলব, বলব। সঅঅব বলব, আপনার সংশয় সন্দিহান সব দূর করবো। আপনি যদি ….

কথাগুলো শেষ না হতেই নরহরি গুটিগুটি পায়ে গাছ তলায় আসেন, উপরের দিকে বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করেন কই ? কোথায় আপনারা ? 

-- এইতো গো,গাছের উপর

--গাছে !!! গাছে কেন? আজকাল তো গাছে ভূত থাকছে।

ঔৎসুক্য নরহরি দু'পা সামনে এগোতে ঝপাং করে নামার শব্দ পেল দুজনের । গাছের তলায় তখন আধো অন্ধকার, কাউকেই দেখা গেল না। তাদের নামার শব্দের সূত্র ধরেই জিজ্ঞেস করলো,

– নিশুতি রাতে আপনারা এইখানে কি করছেন ? চারিদিকে ফাঁকা মাঠ ! কাছেপিঠে কোথাও বাড়িঘর নাই, মানুষ নাই, বিপদে পড়লে কি করবেন আপনারা ?

— বিপদ ! বলে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল নারী কণ্ঠটা। হেসে বললো, আমাদের বিপদ নাই। আমরাই বিপদে ফেলি মানুষজন কে। 

কথাগুলো ভাল ঠেকছে না, নরহরি সাহস ধরেও সাহস হারাচ্ছেন। নারিকণ্ঠের ফাঁদে পড়ে কতেক টা দিশেহারা অবস্থা তার। পালাতে চায়লেও পালানো সম্ভব নয়। কেননা এতোক্ষণ সে ওদের নাগালেই রয়েছে। কোন অসুবিধা হয়নি,ক্ষতিও করেনি ,তাহলে ওদের সাথে ঠাট্টা তামাশা করাই যেতে পারে ।এই ভেবে নরহরি  জিজ্ঞেস করলেন হেসে,

— তাহলে আপনারা কিগো ? ভূত ,না এলিয়েন ?

— যেকোনো একটা ত হবেই,কথা যখন বলছি।

-- ঠাকুর মশাই অনেক হল, এবারে বিষয়ে আসা যাক। আমরা বিপদগ্ৰস্ত, বিপদে পড়েই আপনার কাছে এসেছি। বলেই মেয়েটার কণ্ঠটা ভারী হয়ে আসলো। মেয়ে মানুষের কান্না শুনে নরহরির দয়া হল। তাকে অভয় দিয়ে তার কষ্ট শেয়ার করতে বললো।

-- পাশে একটা ছায়ামূর্তি দেখিয়ে মেয়েটা বলল, আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসি, জন্ম জন্মান্তরের সাথী। আমরা এখন বিয়ে করতে চায় ! কিন্তু…

নরহরি'র মনে একটা খটকা লাগলো, তবে ধর্মশাস্ত্রে পেয়েছেন, আদৌও তা ঘটে কিনা,জানা নাই তাঁর। এখনকার ইঁচড়ে পাকা ছেলেমেয়ে গুলো মোবাইল পেয়েছে । মোবাইল দেখে দুদিন পেরেম করে দাবী করে বসে, ' তারা নাকি জন্ম জন্মান্তরের সাথী।' সে যাইহোক, তাকে ফের অভয় দিয়ে জানতে চাইলেন।

-- কিন্তু কী? সেটা বল ।

পুরুত মশাইয়ের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে মেয়েটা অপ্রস্তুত ছিল। সে মুখ নীচু করে আঙ্গুল কাটছিল। তা দেখে পুরুষ ছায়ামূর্তি টা জানালো , আমাদের দুজনের বিয়ের বয়স না হওয়ায়, সমাজ বাল্য বিবাহ মেনে নিতে রাজী নয়।

ঠাকুর মশাই গলাটা খানিক চড়িয়ে বললেন, তারা ঠিক বলেছে! আপনি থেকে একধাপ নীচে নেমে কতেকটা তাচ্ছিল্যের সুরেই বললেন, তোমাদের বিয়ের বয়স না হতেই বিয়ের ফুল ফুটে গেছে।যত্ত সব ! ঠাকুর রাগত স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের নাম কি ? বাড়ি কোথায় ? 

মেয়েটা এবার মুখ তুলে ঠাকুর কে জিজ্ঞেস করলো ইহজীবনের নাম বলবো ? না, পূর্ব জনমের নাম বলবো ? 

মেয়েটার কথাগুলো কেমন যেন গোলমেলে লাগল ঠাকুরের। সে কাদের সামনে দাঁড়িয়ে ! তারা মানুষ ? না মানুষ রূপে অন্য কিছু? উত্তর না মেলা একই প্রশ্ন বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছে ঠাকুরের ভিতর আর কেঁপে কেঁপে উঠছে । সে যাইহোক,তাদের বিয়ের ইন্টারভিউ টা নিয়ে নিই। এই ভেবে নরহরি একটা বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসলেন । হেসে বলেন,

-- তোমাদের যত গুলো নাম আছে ,সব গুলোই বল না।

– ভূত! স্বামী হত্যাকারী ভূত !

ভূতের কথা শুনেই নরহরি র আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার উপক্রম অবস্থা। থরথর করে কাঁপছে সে, বুকটা উঠছে আর পড়ছে , গলাটা শুকিয়ে কাঠ, পালাবার জো নাই, শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে , কথা বেরুচ্ছে না ,চোখের পাতা আস্তে আস্তে নেমে আসছে, চোখ বুঁজে যাচ্ছে তার । অর্ধ নিমিলিত চোখে শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। কিন্তু তারা সত্যি বলছে তো ! চালাকি করে ভূতের ভয় দেখাচ্ছে না তো !

সত্য মিথ্যার যাচাই কী করে করবে সে। মেয়েটাকে একবার স্পর্শ করতে পারলে, না, ঠিক হবে না সেটা । মেয়েমানুষ কখন কী ভাববে আবার বাড়তি ঝামেলাও ঝুটতে পারে।

মেয়েটা তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণের হাত দুটো চেপে ধরে বলে , আমাদের বাঁচান ঠাকুর মশাই , আমাদের বাঁচান। বলেই আবারও কাঁদতে লাগলো সে ।

মেয়েটার স্পর্শে একটা ঠান্ডা অনুভূত হল ঠাকুর মশাইয়ের। আর তার হাড্ডিওয়ালা হাতের চাপে যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে তার হাত।

একটা আশ্বাস দিয়ে ঠাকুর মশাই তাদের বয়েস জিজ্ঞেস করলেন।

-- চোদ্দ বছর। চোদ্দ বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির রাতে আমরা দুজন প্রাণ ভয়ে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মানব দেহ ত্যাগ করি।

ব্রাহ্মণ কৌতুহলের সঙ্গে মেয়েটা কে জিজ্ঞেস করলো, কেন ? শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মরতে হল কেন ? কোথাও পালিয়ে যেতে পারতে না ?

-- সে একটা ব্যপার ! ব্রাহ্মণের অনুরোধে মেয়েটা জীবনের ঝাঁপী খুলে বসল---


সুন্দরবন লাগোয়া পাহাড়পুর গ্ৰাম। গ্ৰামের একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা নিরানন্দ চলছিল । বাড়িতে একটা চাপা প্রতিক্ষা বিরাজ করছিল। পরিবারের সদস্য ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, বাবা-মা, কাকা-কাকিমা, কাজিন থাকা সত্ত্বেও বাড়িতে একটা অপূর্ণতা বিদ্যমান ছিল ,যা সবাইকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল । তারা সবাই মিলে একসাথেই থাকছে, খাচ্ছেদাচ্ছে ,বেড়াচ্ছে , আনন্দ ফুর্তি করছে অথচ তাদের এই অনিঃশেষ আনন্দ স্রোতে খুশির লেশমাত্র খুঁজে পায় না তারা। বাড়িতে টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও একটা না বলতে পারা অভাব অনুভব করতো তারা। যেটা উপার্জনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়।আবার চায়লেও পাওয়া যায় না।

তাদের এই দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মা মধুচন্দ্রিমা'র কোল আলো করে আমার জন্ম। বাড়িতে একটা খুশির জোয়ার লাগলো, সবার চোখেমুখে যেন আনন্দ উপচে পড়ছে । বাড়ির সকলে আদর করে আমার নাম রেখেছিল আদৃতা।

তারপর বাড়িটা বেশ চলছিল। বাড়ির সবাই হাসি মুখে রাতে ঘুমোতে যেত আবার পরের দিন খুশি মনে তারা একসাথে একটা নতুন দিনের সূর্যোদয় দেখত। হঠাৎ করে একদিন তার ছন্দপতন ঘটল।

আমি তখন চোদ্দ।নবম শ্রেণীর ছাত্রী। পাশের বাড়ির দাদা জয় আমাকে পড়াতে আসত। আবার অন্য সময়েও আসত,গল্প করত। তার গল্পও ভালো লাগত আমাকে । একসময় আমরা দুজনে এক রকম বন্ধু হয়ে উঠি।

একদিন লক্ষ্য করলাম, বাবা রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়িটাকে মেরামত করে রং করালেন । বাড়ির ভিতরে সৌন্দর্যায়নে মা কাকিমা রা আলমারি ,শোকেস গুলো ডেকোরেট করলেন । সত্য কথা বলতে কী ঠাকুর্দা'র পুরোনো বাড়িটাকে নববধূর সাজে আবিষ্কার করলাম।

ব্যপারটা কী জানতে চায়লে , মা ঘরে শোকেসে শাড়ি গুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে ছোটো করে বললেন ,' বাড়িতে লোক আসবে। মায়ের কথা বুঝতে পারলাম না। বোঝার মত তখন আমার বয়েসও হয়নি। কাকিমা'র কাছে গেলে তিনি হেসে বললেন, ' নতুন জামাই নেব । নতুন জামাই,কার বিয়ে---- কথার কোনো খেই খুঁজে পেলাম না। তার প্রয়োজনও বোধ করিনি।

এক ঝলমলে সন্ধ্যায় ছাদনাতলার মুখরতায় একটা প্রস্ফুটিত কমল কোমল মনের প্রশ্নের আওয়াজ টুকুও পৌঁছল না, সত্যি কথা বলতে কেউ কানে নেয়নি তখন । আমাকে টেনে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল। চোদ্দ আর বিয়াল্লিশের হাত চারখানা হাতে নিয়ে পৌরহিত্যে থাকা ঠাকুরদা আশির্বাদ করলেন।

তখন আমার বাবা মা বাড়ির সকলেই টাকার মোহে অন্ধ ছিলেন ।আর আমার স্বামী অমিত আগরওয়াল, কলকাতা শহরের একজন নামজাদা ব্যবসায়ী ,তার স্বপ্নের রাজকন্যা নাকি আমি --- আমার আগত লাবণ্যময় রূপ যৌবনে অন্ধ ,অন্ধের বজ্রকঠিন হাতে একটা পদ্মের কুঁড়ি সমর্পণ করলেন । গদগদ কন্ঠে ঠাকুর্দা বললেন বাবা, আমার কচি মেয়ে, নাবালিকা সেএএএ .. ।'আর বলতে পারলেন না , অনেক বলার ছিল তাঁর । কেঁদে ফেললেন তিনি ।

বাবা মায়ের সুখে আমার সুখ ভেবে নিয়ে স্বামীর ঘর করছিলাম আমি। তার নেকড়ে ক্ষুধার্তের খাবার আমার নরম মাংস, বুকের মাংসলপিন্ড। তার সেই পৈশাচিক অত্যাচার সয়েছি মুখ বুজে, রাতে বৃষ্টি নামতো বালিশে । এভাবেই কত রাত কেটেছে আমার।

কথাগুলো এক শ্বাসে বলে আদৃতার গলাটা ভারী হয়ে আসে। সে এক বুক ব্যথা নিয়ে একচিলতে বিষন্নতার হাসি হাসল। আদৃতার হাসিটুকু ব্রাহ্মণের কানে এসে তিরের মত বিঁধল। পরের ঘটনা বলার জন্য অনুরোধ করলেন তাকে,

তার পর, আমার প্রতি তার আকর্ষণ ফুরিয়ে গেল ।একটা বছরেই আমি পুরোনো হয়ে গেলাম ।

তখন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত সে। আবার কোনো রাতে ফিরতও না । বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ত , জেগে থাকতে হত আমাকে। ও বাড়ি আসবে দরোজাটা খুলে দিতে হবে ,ওর গায়ের গন্ধ মাখা জামাটা চেঞ্জ করাতে হবে । বিছানা করে ওকে শুইয়ে দিতে হবে।

অবশ্য রাতের খাবার আর লাগত না তার, ক্ষুধামন্দা আর কি। পানশালায় ওকে আদর করে কত মেয়ে খাওয়াত, ওও খেত কত মেয়েকে , তার কোনো হিসেব রাখিনি আমি।

শ্বশুরালয়ে ষাটোর্ধ্ব শ্বশুর-শাশুড়ি, তাদের আলালের দুলাল আর ছেলের বউ নিয়ে চার সদস্যের পরিবার। পঞ্চদশী বৌমা এক চঞ্চলা হরিণী শ্বশুরালয় নামক খাঁচায় বন্দী সে। বন্দিদশা তাকে একলা পেয়ে ভাবিয়ে তুলতো,

মনিকা, সুস্মিতা, সোমা আর অনিমেষ, তাদেরকে ভীষণই মিস্ করতাম আমি । ওরা এখনও স্কুলে যায়, একসাথে ক্লাস করে। টিফিনের সময় আমাদের ক্লাসরুমের পেছনে ঝুপড়ি গাছটার তলায় ওরা বসে আড্ডা মারে, দারুণ আনন্দ পায় তারা । ওরা সবাই মাধ্যমিক দিবে এবার। আর আমি স্বামীর ঘরে সংসার ঠেলছি।

দুপুর গড়িয়ে দিনের শেষে গোধূলি বেলায় সোনালী রোদ মেখে আমি,গুবলু কাকা, মেজকার ছেলে পিকলু, মেয়ে অনন্যা, আর আমাদের বাড়ির পেছনে বিরেন জেঠুর মেয়ে ঝুমা সবাই আমাদের বাড়ির সামনে বকুল গাছটার তলায় বসে আমাদের সান্ধ্যকালীন হাসির আসর বসত । গল্প বলে কে কতটা হাসাতে পারে তার একটা অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা প্রায় প্রতিদিনই চলত। আড্ডা শেষে প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণে ক্যাটবেরী জুটত, গাটের পয়সা খসলেও ভীষণ আনন্দ পেতাম আমরা । আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর শুনেছি , বকুল গাছটার তলায় তেমন আর কেউ বসে না।

বাড়িতে কাজের মাসির ডাকে আমার চৈতন্য ফেরে। তিনি বিরক্তির সঙ্গে বলেন ,বৌমা, এখনও চান হয়নি তোর ! সকালে চা বিস্কুট খেয়েছিস ! আর এখন তিনটি বাজতে চললো ! আর পারছি না বাবা ! টেবিলে খাবার ঢাকা থাকলো ,খেয়ে নিস ! কথাগুলো শুনিয়ে গজর গজর করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে ।

ঐ রকম কতদিন হয়েছে,তার ইয়ত্তা নাই। তখন আমার স্নানের ঠিক ছিল না, খাওয়ার ঠিক ছিল না, না ছিল শরীরের প্রতি কোনো যত্ন। দিনে দিনে আমি শ্রীহিন একটা পোড়া কাঠ ----- ঐশ্বর্যশালী শ্বশুর মশাইয়ের রাজপ্রাসাদসম অট্টালিকার ভিতরে ক্লান্ত ,অবসন্ন , পথ ভোলা এক পথিকের মতোন ঘুরে বেড়ায় । তবুও কারোর হেলদোল নাই।

আমার হাসব্যান্ডের বন্ধু বিজয় মালব্য । অমিতের বিজনেস পার্টনার সে । উনি আমাদের বাড়িতে প্রায়শঃ আসতেন । আমাকে সারাক্ষণ মনমরা দেখে উনি জিজ্ঞেস করতেন , বৌদি , তোমার কিসের কষ্ট ? এমন কী হয়েছে, কারোর সঙ্গে কথা বলো না ? তোমাকে তো সব সময় দেখি নির্জীবের মত থাকো । আচ্ছা বৌদি, তোমার কষ্টটা শেয়ার করা যায় না?

প্রথম প্রথম তার কথায় সাড়া দিতাম না। কিন্তু যে মানুষটা মনের কষ্ট বুঝতে পারে, অপরের কষ্টে যার কান্না আসে ,ব্যথা পায়; সেখানে একা মনের কষ্টে গুমরে মরার চেয়ে কারুর সাথে শেয়ার করে নিজেকে হালকা করাটা হয়তো বেঁচে থাকার রসদ হতে পারে। এতে কোনো দ্বিধা নেই ।

আস্তে আস্তে বিজয়ের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেটা আমিও চাই ছিলাম, আমার একলা ঘরে একাকিত্ব জীবনে একজন কে। যে আমাকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্নের জাল বুনবে, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাবে ।

ওও সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার ঘরে আসত, গল্প শোনাত রাজার দেশের দুই প্রেমিক যুগলের প্রেম কাহিনী। ওরা দুজনে রাজার দেশ ছাড়ে, এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে পালিয়ে আসে, এক গভীর জঙ্গলে ভিতরে ঘর বাঁধে তারা ।

ও নানান ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে যখন সাক্ষাৎ করতে আসত , তখন তাকে দেখে আমার ভীষন হাসি পেত। ও যখন আমার ঘাড়ে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বলত, তোমার জন্য আমি সব করতে পারি প্রিয়া। সব পারি। ওর কথাগুলো আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম তখন। আবারও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম আমি ।

প্রথমে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, পরে অমিতও জানতে পারে বিজয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা । শুরু হল গঞ্জনার ঘর, চলত অকথ্য অত্যাচার।

আমার জন্য প্রতিনিয়ত পাওনা থাকত লাঞ্চনা উঠতে বসতে কথা শুনতে হত আমাকে, পান থেকে চুন খসলেই দুটো কথা শুনিয়ে দিত তারা।

উৎসুক্য ব্রাহ্মণ আগ্ৰহের সঙ্গে ব্যপারটা জানতে চায়লেন যে, পরকীয়া তো এখন সরকার স্বীকৃত,তাই না ? ,তবে…

এবারে আদৃতা একটু হাসলেন। যেখানে হাসির ইচ্ছে নেই,পরিবেশ নেই, রাতের কালো ঠোঁটে হাসির পাপড়িগুলো মেলতে না পেরে চুপসে যাওয়ার মত একটা মোলায়েম হাসি। হেসেই বলেন,

ওটা তো একটা বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ। আর সম্পর্কে কারোর স্বীকৃতি লাগেনা কখনো । সম্পর্ক এমন একটা বস্তু : যেটা গড়তে, ভাঙতে কারোর অনুমতি লাগেনা। যার সঙ্গে সম্পর্ক তার স্বীকৃতিই যথেষ্ট । অপরের স্বীকৃতিতে কখনো সম্পর্ক টেকে না, বাঁচিয়ে রাখতে পারে না তাকে । সম্পর্ক এমন একটা বস্তু: যা দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, অনুভব করা যায় মাত্র ।

সম্পর্কের ক্যাঁচর ক্যাঁচর রেখে এবারে গল্পে আসা যাক,

সেই রাতে বিজয় আমার ঘরে। অমিত অনেক রাত করে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে সে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে উলঙ্গ ছোরা হাতে অতর্কিতে হিংস্রের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের উপর । আমিও অন্ধ অক্টোপাসের মত অমিতকে ঝাপটে ধরি বিজয়ের জীবন বাঁচায়, তার পালাবার পথ করে দিই । শুরু হয় অমিতের সাথে আমার ধস্তাধস্তি। এ যেন একটা তিরবিদ্ধ হিংস্র বাঘের সঙ্গে আরেকটা নীরিহ হরিণীর অসম লড়াই। নেশাগ্ৰস্ত অমিত একসময় উপুড় হয়ে পড়লে, উন্মুক্ত অস্ত্রে বুকের এফোড় ওফোড় হয়ে যায় তার । পূর্ণ চৌবাচ্চার উন্মুক্ত নলের স্পিডে রক্ত বেরুচ্ছে , ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে । আর, ও নলি কাটা পশুর মত গোঙাচ্ছে, সেকি গোঙানি তার ।

ওর বিকট রকম গোঙানি দেখে আমি ভয় পেয়ে যায়। আমি স্থীর ভাবে দাঁড়াতে পারছি না। আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কোন্ পাকচক্রে পড়ে এ কি ঘটে গেল ! আমি বুঝতে পারছি না!

ওও আর গোঙানাচ্ছে না। ওর নিথর দেহটা মেঝের উপর পড়ে রয়েছে । ওও ওর চোখ দুটো পলকহীন, নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আর ,আর যেন বলছে , তুই স্বামীর হত্যাকারী ! তুই খুনি ! তোর হাতে আমাকে মরতে হল।

সেই রাতেই আমি পালিয়ে আসি । এসে বিজয়ের বাড়িতে উঠি । তাকে জানায়, ঘটে যাওয়া অঘটনের পুরো ঘটনাটা ।

পুলিশ আমাদের পিছু ধাওয়া করলে, বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে আসি, রাতে একটা গভীর জঙ্গলের ভিতরে দুজনে গা ঢাকা দিই । রাতটা ছিল বিভীষিকাময় একটা দুর্যোগপুর্ণ রাত্রি। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিতে যখন পৃথিবীকে উলটপালট করছে,  মুহূর্মুহূ বজ্রপাতে পৃথিবীটা নাজেহাল, সেই মুহূর্ত টা স্বরণে আসলে আমার শরীর শিউরে উঠে এখনো।

সেই শ্বাপদ সংকুল বন বনানী, অরণ্যের ভিতরে অমন ভয়াল ভয়ঙ্কর ভীষণা রাত্রিতে প্রমাদ গুণল অসহায় দুটি প্রাণী। ওদেরকে লক্ষ্য করেই যেন হাজার হাজার টর্চের তীক্ষ্ণ আলো বর্ষণ সিক্ত জঙ্গলের ঘনান্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে, তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে জঙ্গলের চারিদিক দিয়ে, পালাবার পথ নাই, লুকোবার জায়গা নাই এমন একটা প্রতিকুল পরিস্থিতি। ওহ্ মাই গড! ভগবান কে স্বরণ করি তখন!

বৃষ্টির জলে ভিজে আমরা দুজনে থরথর করে কাঁপছি, দাঁতে দাঁত কাটছে, হাত পা আড়ষ্ট হয়ে আসছে,চলার শক্তি নাই। শুধু কাঁদছি আর কাঁদছি আমি । বিজয়কে বলেই ফেললাম, আমি যদি তাদের হাতে ধরা পড়ে যায় , সেও ভালো। তবুও ধরা দিও না তুমি, পালিয়ে যেও।

কথা গুলো বলতে বলতে আদৃতা দলা পাকানো গলায় একগাল অনাবিল অনাড়ম্বর হাসি হেসে আবার বলতে শুরু করে সে,


আমার বিজয় কাপুরুষ নয় , আবার আমাকে ফেলে পালাবার পাত্র নয় সে। বেগতিক পরিস্থিতি দেখে আমাকে ঘাড়ে তুলে নেয় অতি সন্তর্পণে সেই দুর্যোগপূর্ণ ঝড়বৃষ্টির রাতের জঙ্গলের বিপদ বিলি কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকে সে। এক সময় জঙ্গলের বাইরে আমরা আসলাম ।

পেছনে জঙ্গল, সামনে উত্তাল সমুদ্র ক্ষোভে ফুঁসছে সে। নির্ঘাত মৃত্যু। তবুও প্রাণ ভয়ে প্রাণের আশ্রয় পেতে আমরা ঝাঁপ দিই উত্তাল সমুদ্রে। সমুদ্রও তার শীতল আঁচল তলে লুকিয়ে নিল আমাদের দুজনাকে।

দিনটি বছর চোদ্দ আগের এই দিনে ।

ছায়ামূর্তি দুটি দূরে সরে যাচ্ছে, ছোট হয়ে আসছে, অবশেষে মিলিয়ে গেল , আর দেখা গেল না তাদের ।

নরহরি দু-হাত দিয়ে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখে, তার ঘরে শুইয়ে রয়েছে সে। বামনি আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলতে বেরিয়েছে সে। এসেই পূজো দেবে।


__________


Rate this content
Log in