Tohidul Islam

Abstract Others

4  

Tohidul Islam

Abstract Others

ফকির বাবার রুমাল

ফকির বাবার রুমাল

9 mins
273


#ফকির_বাবার_রুমাল

#তহিদুল_ইসলাম


তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মুন্সীগঞ্জের তালুকদার পরিবারের মৌলানা শাহরিয়ারের ডানপিটে ক্ষুদে ছেলের দূরন্তপনায় বাড়ি শুদ্ধ গোটা পাড়া অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ছেলেকে কোনো ভাবে বাগে আনা যাচ্ছে না দেখে ছেলেকে নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন তারা এবং একটা নামী স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হল।


স্কুলের নবাগত ক্ষুদে ছাত্রের দুষ্টুমিষ্টি চেহারা আর তার দুরন্তপনা সবাইকে আকৃষ্ট করে তুলেছিলো । তার আভিজাত্য পূর্ণ হাঁটা চলা , তার বাঁকা চোখের চাহনি , বিশেষ করে তার কথা বলার ভঙ্গিমাটা ছিল দারুণ । সে সহজেই সব বয়েসি ,সব ধরনের মানুষের সাথে মিশতে পারতো । তার মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো সবাইকে মোহিত করে তুলতো । অল্প দিনের মধ্যে ক্ষুদে বালকটি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা দের মন জয় করে তাঁদের চোখের মণি হয়ে ওঠে। 



প্রথম থেকেই সে ভালো ছাত্র ছিল; বিশেষ করে বিজ্ঞানের উপর তার অগাধ পান্ডিত্য লক্ষ করা যায়।


শিক্ষা শেষে শহরে একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে জুওলজি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং প্রফেসর নুর আলম সাহেব নামে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন।


তিনি ছাত্রজীবন থেকে সমাজের কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আর অলৌকিতা ফুৎকারে উড়িয়ে দিতেন। কোনো কিছুতে বিশ্বাস আনার আগে তাকে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে ভালো করে যাচাই করে নিতেন । 


তিনি সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু , কিন্তু রক্ষনশীল সমাজ তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

        -----------------------------

একদিন বিকাল বেলায় প্রফেসর নিজ কর্মস্থল থেকে গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে ভীষণ'ই শরীরটা ক্লান্ত বোধ করলেন।বাড়ি এসে বিছানা নিলেন । পশ্চিমাকাশের সূর্যটা আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল আকাশ চুম্বি অট্টালিকা ওপারে।রাত্রি রাণি, তাঁর কালো চুল এলিয়ে দিলেন, প্রতিদিনের মতো আজকেও ধীরে ধীরে আঁধার ঘনিয়ে এলো ধরণীর বুকে । রাতে ডিনার না করেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন কর্মব্যস্ত জীবনে অবসন্ন দেহে।


 রাতের আঁধারে পাখিদের কিচিরমিচির , বহু দূর থেকে মোরগের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে ,পুব আকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠলো, কে যেন আকাশের মুখখানি কাঁচা সোনা গলিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ।


ভোর রাতের দিকে প্রফেসরের ঘর থেকে একটা অস্পস্ট ভয়ার্ত গোঙানির আওয়াজ মিমের কানে এলো। সে এক অজানা আশঙ্কায় বারান্দায় এসে বাবার ঘরে দরজায় কান রাখলে আওয়াজ টা স্পস্ট শোনা গেল।তার তীব্রতাও ছিল প্রবল । তার অনেক করে ডাকে সাড়া না দেওয়ায় লোকজন দরজা ভেঙে তাঁকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে।


প্রফেসর সাহেব কে হাসপাতালে তোলা হলে , ডাঃ এন ভি রামান্না স্ট্রোকের কথা জানান । বেনস্ট্রোক। বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছুই বলা যাবে না তা জানিয়ে দেন । 


বাহাত্তর ঘন্টা কেটে গেলেও পেশেন্টের কোনো ইমপ্রুভ না হওয়ায় ডাঃ বাবু ভগবান কে ডাকতে বললেন। যান্ত্রিক সভ্যতায় যেখানে বিজ্ঞানের জয়জয়কার , চিকিৎসা পদ্ধতির অসম্ভব উন্নতির পরেও ডাক্তারের অমন হতাশাজনক এডভাইসে রুগির লোকজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন । এক অ-জানা আশঙ্কায় মুহূর্তের মধ্যে তাদের আঁকড়ে ধরে থাকা অনেক আশার গ্লাসটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল । 


তারা শেষ পর্যন্ত প্রফেসরের ডিসচার্জ করিয়ে নেন, অনেক অনুনয় করে, " স্যার, প্রফেসরের জন্য আপনারা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন , এখনও তা অব্যাহত রয়েছে । এজন্য আপনাদের মেডিক্যাল টিম কে অনেক অনেক ধন্যবাদ । আমরা,ওঁনার ডিসচার্জ চায়ছি। ওঁনার পুরোনো পৈতৃক ভিটে নাড়িরটান ভাই-বোন বৃদ্ধামা চাচা-চাচিমা ,পাড়া প্রতিবেশী ছেলেবেলার বন্ধুরা অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে আছেন । তাদের সবার প্রিয়জন প্রফেসর সাহেবের তাজা মুখখানা শেষ বারের মত দেখবে বলে।" 


প্রফেসরের গাড়ি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলে দেখা গেল অভিমুখ পরিবর্তন করল…..



ব্যস্ত শহরের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায়,একটা ঝাঁ চকচকে এপার্টমেন্টের ভিতরে বিদায়ের সানাই নীরবে করুন সুরে বেজেই চলেছে। অধ্যাপক নুর আলম সাহেবের হাতের মুঠোয় বিদায়ের টিকিট খানা জ্বলজ্বল করে উঠলো, কখন যে সমস্ত মায়া ত্যাগ করে তিনি পরপারে পাড়ি জমাবেন, তা…...


প্রফেসর নুর আলম সাহেব সমাজের ছোট বড় সকলের কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধার সাথে সমাদৃত হতেন । পাড়া গাঁয়ের লোকজন তাঁকে মাস্টার মশাই বলে ডাকতেন । তাদের ভালোবাসার পুষ্পবৃষ্টিতে আজীবন নিজেকে ভিজিয়েছেন । তবে বাতির নীচে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি নিন্দুকেরাও তার পিছু ছাড়েনি । প্রফেসর সাহেব কখনো এসবে কান দিতেন না । তবুও তাঁকে যে অস্বস্তিতে ফেলেনি তেমনটি নয়।


         ------------------


প্রফেসরের গাড়ি পৌছনোর পর বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। ছোটো বড় সব বয়েসের ,সব ধরনের মানুষের আনাগোনা শুরু হয় । যদিও বাড়ির অন্দরে সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তবুও তাদের ভেতরে আগ্ৰহ , ভালবাসার একটু কমতি নেই। তাদের ভেতরে একটা আবেগ কাজ করছে, আবেগতাড়িত হয়ে , " যায়,দেখে আসি……. মাস্টারের বাড়িটা তো দেখা হবে।" 


আর পাঁচ জনের মত এক ফকির বাবা ঠকঠক শব্দ করে বাড়ির মেন গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। গেটের সামনে এসে আপনার কাঁধে ঝোলানো ঝোলা থেকে একটা ঝিকিমিকি রুমাল বের করে সামনে মেলে ধরলেন। একবার উপরের দিকে তাকিয়ে তাঁকে ঠোঁট নাড়াতে দেখা গেল , বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র পাঠ করে সশব্দে তিন তিনটে ফুঁ দিয়ে রুমালের এককোণা বেঁধে গেটের একপাশের গ্ৰিলে ঝুলিয়ে দিলেন । 


গেটের ভেতর থেকেই নজর রাখছিল দারোয়ান । তাঁর অমন কান্ড দেখে বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,


--কী হচ্ছে ওটা ?


-- শা'লাকে এবার বেঁধে ফেলেছি ! উনি এখন বিপদমুক্ত।


-- মানে?


--মৃত্যুদূতকে ,মানে যমরাজ কে আটকে দিয়েছি। মাস্টারকে এখন মন্ত্রপূত জল পান করালেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।


ফকিরের কথায় দারোয়ান স্মিত হাসলেন। একটা কথা মনে পড়ে গেল তার , পাগলে কিনা বলে আর ….। হেসে বললেন,


-- চলে যান এখান থেকে।


--আমি ! আমি চলে গেলে মাস্টারের ক্ষতি হয়ে যাবে ! উনি মারা যাবেন ! ওনাকে বাঁচাতে হবে! ওনার জলপড়া লাগবে !


ফকিরের কথায় ভারী আশ্চর্য হল দারোয়ান । একটু ক্ষুদ্ধও হলেন। রাগত স্বরে তাঁকে চলে যেতে বলে গ্ৰিলে বাঁধা তাঁর রুমাল টা খুলতে গেলেন।


--না, না ! দারোয়ানজি অতে হাত দিবেন না! ওটা খুললে মাস্টারের বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে যাবে । এই যে এখানে দেখুন , রুমালের কালারটা পাল্টে কেমন সবুজ হয়ে গেছে , তার মানে উনি এখন সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত । যখন রুমালের কালার লাল হতে থাকবে তখন জানবেন মাস্টারের মৃত্যু আসন্ন । তাঁর মৃত্যুর ছব্বিশ ঘন্টা আগে এটা সম্পূর্ণ লাল হয়ে যাবে ।


রুমালের রং পরিবর্তনে তেমন আশ্চর্য নয়, এখন হরহামেশাই দেখা যায় মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা অর্থাৎ জাদুকরেরা হাত চালাকির মাধ্যমে এসব করে থাকে । আশ্চর্য হচ্ছে ,ফকিরের সাহস দেখে ! যে লোক ছোটোবেলা থেকে তুকতাক ছাড়ফুক,তন্ত্রমন্ত্র বিশ্বাস করেনি , তাঁকে জলপড়া দেওয়ার কথা বলছে । ভারী অবাক হল সে । গেটের সামনে থেকে তাঁকে সরিয়ে দিতে গেলে একটা শোরগোল পড়ে গেল।


লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো। তাদের লক্ষ্য থেকে উপলক্ষ্যই প্রধান হয়ে উঠলো। এখন সবার নজর ঐ ফকিরের উপর,,


ফকিরের মাথায় একটা সাদা ওড়নার ফেটি, বেশ পরিপাটি করে বাঁধা , ফেটির তলে ধবল সাদা চুল ঘাড়ের নীচে লটকাচ্ছে । তাঁর গোলগাল মুখমন্ডল,উন্নত নাসা আর টল পড়া গালে আবক্ষ চুম্বিত দাড়ি। গায়ে তালি দেয়া সাদা পাঞ্জাবি ,পরনের ধুতি পথের ধূলোয় মুখ ঢেকেছে । তাঁর বাম কাঁধের ঝোলাটি সামনে পিছনে দোল খাওয়া দেখে হালকায় মনে হল তা। হাতে পেতল বাঁধা তেলচিটচিটে লাঠি। পায়ের জুতো জোড়ার শুকতলা ক্ষয়ে গেছে ।


ফকিরকে নিয়ে এপার্টমেন্টের সামনে হৈচৈ পড়ে গেলে প্রফেসরের বাড়ির লোকজন ভীষণই অস্বস্তিতে পড়ে । ভেতরে পেশেন্ট মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন , কপালে চিন্তার ভাঁজ , চোখে মুখে তাদের বিরক্তির ছাপ ।


তবুও চুপ। মনকে বুঝিয়ে মনাগুন চেপে রাখা তার চেয়ে অস্বস্তি আর কী হতে পারে! তাদের এখন দিশেহারা অবস্থা।


লোহাকে যেমন পুড়িয়ে লাল করলে বাঁকানো সহজ,তেমনি মানুষের দুর্বল দিকগুলোতে আঘাত করলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে গড়ে মাথা রাখে। তার এই অনিচ্ছাকৃত কারণে সমাজের সাথে আপনার বিশ্বাসঘাতকতা করা কিংবা আপনার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত আসুক …. , তাহোক , তবুও তো সাময়িকের জন্য হলেও পরিবারে খুশির হাওয়া আসতে পারে।


পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধে ঢেঁকি গিলা অবস্থা সমাজের চোখে নাস্তিক নামের কিছু লোকজনের । বিশেষ করে তারা মেয়েদের প্রাণের আকুতির কাছে হার মানে । মেয়েদের কষ্ট হয় যখন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বাঁধা পড়ে তারা । যেটা দু'দিন আগে বা পরে ঘটতে পারত। মেয়েরা কিছু হারাতে চায়না ,সব কিছু বুকে আগলে রাখতে চায় ।


মেয়েদের বিশ্বাসের ধাতুটা অতি সংবেদনশীল । সহজেই তারা বিশ্বাস করতে পারে আবার একটুতেই ভেঙে খানখান হয়ে যায় । অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস খালি কলসীর আওয়াজের মতোন । 


ফকির বাবার কথায় আস্থা রেখে প্রফেসর সাহেবের পরিবারের মেয়ে সদস্যরা তাঁকে দেবতার আসনে বসিয়ে দিল। এবং ফকিরকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল।


           --------------


ফকির বাবা ,অধ্যাপক নুর আলম সাহেবের দিকে তাকিয়েই জানান ," এনার সময় সীমিত । আপনারা শিগগির ঝোরের জল (শুকনো খালবিল, নদী নালার তলদেশ থেকে অটোমেটিক উপরে উঠে আসা জলের স্রোত ) ম্যানেজ করুন। তাকে মন্ত্রপূত জল পান করাতে হবে।


ওনার বিধান মতো দুষ্প্রাপ্য জলের খোঁজে শয়ে শয়ে লোক বেরিয়ে পড়ল । কিছুটা জানা, কিছু টা অজানা মায়ার পেছনে ছুটে চলল তারা । তবুও যে মন না শোনে কাথা । কথায় আছে , যতক্ষণ শ্বাস,ততক্ষণ আশ।


আশ পাশের নদীনালা, খালবিল , পুকুর,ডোবা'য় কোথাও ঝোরের জল মেলাতে না পেরে সবাই নিরাশ হয়ে ফিরে আসল । তবে একজন মুরুব্বী মানুষ হাতের ইশারায় জানলেন , " একটু বিশ্রাম নেয়ার পর পুরো বিষয়টি জানাচ্ছি ।" বলেই আপনাকে আস্তে আস্তে ভেঙে একটা আর্ম চেয়ার নিতে দেখা গেল তাকে । তার আসন গ্ৰহণ দেখে বোঝা গেল তিনি ভীষণই ক্লান্ত ছিলেন।



শালবনির জঙ্গলের ভেতরে মজা নদে ঝোরের জলের স্রোত বয়ে যেত। এটা লোকমুখে শোনা । জিজ্ঞেস করে সোনার গাঁ'য়ে যাওয়ার মতোন পৌঁছে দেখা গেল , দুর্ভাগ্য বশতঃ হোক আর কালের বিবর্তনে হোক তা শুকিয়ে এখন গবাদিপশুর বিচরণক্ষেত্র । আজ সেখানে পালের পাল গরু মহিষ চরছে আর রাখাল বালকেরা ডান্ডা গুলি খেলছে।


এদিকে প্রফেসরের অবস্থা আরো সংকট জনক হওয়ায় বাড়ির ভেতরে একটা স্তব্ধতায় বিরাজ করছে ,কখন বর্ষা নামবে , ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাদের সমস্ত ব্যথা যন্ত্রনা আর কষ্ট গুলো ।


তার কথায় ফকির বাবা স্মিত হাসলেন। তিনি মুরুব্বীর মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এবং পূনরায় তাদের বাতলে দিলেন ,' শালবনির জঙ্গলের ভেতরে যে মজা নদীটি রয়েছে , এখন সেখানে ঝোরের জল গড়িয়ে পড়ছে। আশাকরি এবার নিরাশ করবে না সে।



যেমন খোঁজ,তেমনি রহস্য । শালবনির জঙ্গলের ভেতরে মজা নদে যেখানে এতক্ষণ গরুর মহিষ চরছিল , বাছুর গরুগুলো হা করে জিভ দিয়ে লালা ঝরিয়ে হাফ ছাড়ছিল । এখন সেখানে জল গড়িয়ে পড়তে দেখে তারা ভারি আশ্চর্য হলো।


       ---------------------------


বদরুদ্দীন ফকির ওরফে বাদল ফকির কাঁধের ঝোলা থেকে পানের ঢিব্বাটি বের করে একখিল পান নিয়ে মুখে পুরে চিবোতে লাগলেন , পান চিবোতে চিবোতে জলের গ্লাস টা হাতে নিলেন। তখন পানের সুবাসে সারা বাড়ি ম ম করছে । 



তিনি শান বাঁধানো উঠোনের মাঝখানে পা'য়ের জুতো খুলে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখা গেল, একবার আকাশের দিকে তাকাতে,মনে হল আকাশের গায়ে মুদ্রিত মন্ত্র এক ঝলক দেখে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন , মন্ত্র পাঠ শেষে গেলাসের জলে সশব্দে ফুঁ দিলেন । তার সাথে পানের ছিবড়েও কিছু মিক্সড হল। ঐ জলটা প্রফেসর সাহেব কে খাইয়ে দেওয়া হল । খাওয়ানো বলাটা ঠিক হবে না,জলটা তাঁর চোখে মুখে ছিটিয়ে দেওয়া হল আর অসাড় ঠোঁটের ফাঁকে ফোঁটায় ফোঁটায় দিতে থাকল।


যেমন কথা, তেমন কাজ। কারেন্ট বরাবর। প্রফেসর সাহেব আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালেন,হাত পায়ের আঙ্গুল নাড়াচ্ছেন , এদিকে ওদিকে ঘাড় ঘুরাচ্ছেন দেখে মেয়ে মিম জিজ্ঞেস করলো , " পাপা আমাকে চিনতে পারছেন ? তাঁর ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সুচক উত্তরে সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।



এক হপ্তার মধ্যেই প্রফেসরের শারীরিক অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটল।প্রায় স্বাভাবিকে ফিরে এলেও ক'দিনের ধকলে তাঁর শরীরটা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। মেজাজ খিটখিটে। কিছু দিনের জন্য তাঁর এখন হাওয়া বদলের প্রয়োজন। এই সবের একটা তোড়জোড় চলছে , তাঁরা সপরিবারে রওনা দেবে পাহাড়রানি গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে।


এমন সময়ে প্রাসাদপ্রতুল এপার্টমেন্টের ভেতরে সবার অলক্ষ্যে আবির্ভূত হোন বদরুদ্দিন ফকির ওরফে বাদল ফকির । তিনি সবাইকে অবাক করে একগাল হেসে মিমকে কে জিজ্ঞেস করলেন, " আমার পাগলটা কেমন আছে রে ( মিম) ? "


আগন্তুক ফকিরের উপর প্রফেসরের নজর পড়তেই চোখ কপালে । তিনি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রয়েছেন ; কি বলবেন ,কি বলবেন না কিছুই মাথায় আসছে না তাঁর ,আবার ভাবলেও অবাক লাগছে তাঁকে ।


আধুনিক শিক্ষিতা এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বুদ্ধিমতী মেয়ে মিম পরিস্থিতি সামলে নিতে এগিয়ে আসেন। এবং আলতো করে মাথায় হাত দিয়ে বাবার মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন তার দিকে, একগাল হেসে বাবাকে জানান, 


--পাপা, উনি হলেন বাদল ফকির।


মিমের দেয়া তার পরিচয়কে সমর্থন জানাতে আগন্তুক একচিলতে ঠোঁটে হাসি আনেন, হেসে বললেন।


-- জ্বী, সবাই আমাকে বাদল ফকির বলেই চেনে। বাবার দেওয়া নাম বদরুদ্দিন, মহঃ বদরুদ্দিন ফকির। 


--ওনার আশীর্বাদে আপনি আজ এতোটা সুস্থ।

 ওনার মন্ত্রপূত জলে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বলেই আজ আমরা …. 


মিমের কথা শুনেই ফকির বাবা একগাল ক্রুর হাসি হাসলেন । তাকে লক্ষ্য করে জানালেন, " পাগলি , ওটা ওপরওয়ালার হাত ।" আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন , " হায়াত মউতের মালিক ঐ উপরওয়ালা । উনি মারতেও পারেন আবার ফিরিয়েও দিতে পারেন …...। " ফের একচিলতে ক্রুর হাসি তাঁর ঠোঁটে জ্বলজ্বল উঠলো ।


" আপনি থামুন তো ! এখানে আপনার হাদিস খুলতে বলা হয়নি " প্রফেসর কড়া ধমক দিয়ে তাঁকে চুপ করিয়ে দিল । মেয়ে মিম কে লক্ষ্য করে আপনার ভেতরের পুঞ্জিভূত বহুদিনের ক্ষোভ উদগীরণ করতে থাকেন.. ‌...


-- তুই কী বলছিস ,আমি তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না ! জলপড়া জলে উপকারিতা কি? কী মেডিসিন রয়েছে তাতে ?? এটা আমার মাথায় কোনো ভাবে ঢুকছে না রে ! আর এই ধান্দাবাজ লোকগুলো কে তুই কতটুকুই বা জানিস ???


প্রফেসর: তাঁকে চলে যেতে বললেন এবং চলে যাওয়ার আগে তাঁকে স্বরণ করিয়ে দেন , " এটা ধান্দাবাজের মাটি নয় ! এমাটি ভীষণই কঠিন ! পুড়তে পুড়তে অনেক শিখেছে তারা । ধান্দাবাজি করবেন , মানুষ বুঝে করবেন । যান …..


মিম আজ সকাল বেলায় গ্ৰিলে বাঁধা ফকিরের রুমালের রং লালচে দেখে এমনিতেই এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছিল। আবার বাবার তির্যক ভর্ৎসনায় অপমান অপদস্ত ফকিরের মুখমন্ডল লাল হয়ে আসলে , তাঁর টোলপড়া গালে রোদে পুড়া রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়লে মিম ভীষণই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে । তাহলে কী ফকিরের কথাগুলো সত্যি হতে চলেছে , সে যদি কোনোক্রমে রূষ্ট হোন । ভীষণই ভয় করছে তার।



তার ভয়টা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল , ফকিরের দুই চোখ দেখে , তাঁর চক্ষুযুগল দিয়ে যেন হলকা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছিল। মনে হচ্ছিল , তাঁর সেই ক্রোধাগ্নি দিয়ে পুড়িয়ে মারবে বাবার ভেতরের পশুটা কে, তাঁর অহং কে ; বাড়িশুদ্ধ যেন জ্বালিয়ে দেবে সে ।


প্রফেসরের কথার কোন প্রতিবাদ না করে অপমান অপদস্ত ফকির বুঁ করে পেছন ফিরলেন , ঠকঠক শব্দ করে গেটের দিকে যেতেই কখন বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেল ।

          

ফকির কে চড়া গলায় কথাগুলা শোনাতে গিয়ে প্রফেসরের গলাটা খসখস করে উঠল, কাশতে থাকে সে , কাশতে কাশতে তাঁর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠে ,চোখের পলক বন্ধ হয়ে আসে , বিস্ফারিত চক্ষুযুগল যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। বুকটা চেপে ধরে বসে পড়ল সে।


বাড়ির ভেতরে ছোটাছুটি ,দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। কে বলে চোখে মুখে জল দাও, ডাক্তার ডাকো , ওঁকে হাসপাতালে তোল ,বিপিটা দেখ, এযেন নানা মুণির নানা মত । কেউ ডায়েরি ঘেটে ডাক্তারের ফোন নং খোঁজে তো কেউ গাড়ি বের করে । কতেকটা দিশেহারা অবস্থা।



প্রফেসরের কাশতে কাশতে গলাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে , শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ! অসহ্য ! অসহ্য ! ভীষণ যন্ত্রনা ! চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে তার ! সামনে শুধু-ই অন্ধকার !অন্ধকার ! কফের সাথে রক্ত ! দলা দলা রক্ত ! ধীরে ধীরে আপনার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছেন ! অবশেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে ।

               সমাপ্ত

---------------------------০---------------------------








Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract