উমার আগমন
উমার আগমন
উমার আগমন
সকাল হলো, অবশেষে শারদার জীবনে সেই দিনটা এসেই গেলো ,
আজ ষষ্ঠী , মায়ের বেল্লি বরণ হবে কাজ, আর কাল মা আসবে মর্তভূমিতে ।
মায়ের অপেক্ষায় প্রতিবছর সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেও এই অপেক্ষাটা শারদার জন্য ছিল একটু বিশেষ ধরনের কারণ আজ সে নিজের পয়সায় মাকে একখানা শাড়ি দেবে, হলুদ রঙের শাড়ি খুব ইচ্ছে ছিল যখনই রোজগার করবে মাকে সুন্দর করে সাজাবে তাতে যত পয়সায় খরচ হোক না কেন সে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে রাজি ।
শারদা বরাবরই খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে নিজের যেটা ঠিক মনে হয় সেটা সে করে থাকে ,কখনো কারো ক্ষতি করবো, কারো খারাপ করবো এই মনোভাব তার কোনোদিনই ছিল না ।
অবশেষে আজ উমাকে শাড়ি পড়বে তার মেয়ে শারদা , যতই হোক মায়ের নামেই যে তার নাম , হয়তো সে মায়েরই অংশ ।
মাকে সারাবছরের যা যা উৎসব আছে সবটাই শাড়ি কিনে দেয় ।
এই তো সেদিন , একজন মহিলা তার কাছে এসে বললো দশ টাকা দেবে গো দিদি, মেয়েটা আমার না খেয়ে আছে , খাওয়াতে হবে , সেদিন শারদার চোখে জল এসে গেছিলো , ওরা সব কত কত জমা পরবে পুজোয়, মন্দির প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে দেখবে ।
অথচ দেখো এদের পেটে একটা খাবার নেই...
আচ্ছা উমার আরেক নাম তো অন্নপূর্ণা , তাহলে সে কি কোনো মানুষকে অভুক্ত রেখে এই চারদিন ধরে প্রসাদ সামগ্রী গ্রহণ করবেন ?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ওই মহিলার কোলে থাকা ছোট্ট মেয়েটি কেঁদে উঠছিল বুঝতেই পারেনি সে ।
অবশেষে তার চিন্তা ভাঙলো , সঙ্গে সঙ্গে ওদের সামনের একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাওয়ালো শারদা, এবং রাতের জন্য খাবার প্যাক করেও হাতে দিল ।
মহিলা এবং বাচ্চা দুজনেই বেজায় খুশি আজ , কিন্তু হটাৎ শারদা বলে উঠলো তোমাদের একটা কাজ করতে হবে । মহিলা খানিকটা ভীত হলো , হয়তো মনে মনে ভাবলো পেট ভরে খাইয়ে কি এখন এই দিদি তার জুতো পরিষ্কার করাবে, নাকি গাড়ি মোছা করাবে ।
আসলে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়, অনেক বড়লোক অহংকারীদের দেখেছে এই সব ক্ষুধার্ত গরিবদের খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নিজের কার্য সিদ্ধি করতে এবং লোকজনের সামনে মজা নিতে ।
শারদা বললো আরে ভয় পেও না কাল সপ্তমী, তুমি সকাল 6 টায় আমার বাড়ি এসো তোমার মেয়েকে নিয়ে, বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমায় , মহিলা এবার হয়তো ভাবলো , পুজোতে বাড়ি ঘর পরিষ্কার করার জন্য ডাকছে ।
মহিলা একটু অন্যমনস্কভাবেই বাড়িটা কোথায় সেটা বুঝে নিল ।
পরের দিন
সকাল ঠিক 6টা মহিলা এসে হাজির, খুব খুশি হলো শারদা, উনি কথা শুনেছে এই ভেবে ।
ঠিক 7টায় মা দুর্গা এলেন মন্দিরে, নবপত্রিকা স্নান হলো ।
শারদার বাড়ির সবাই তার অপেক্ষায়, কারণ আজ যে উমা তার কেনা হলুদ শাড়ি পরবে।
হটাৎ শারদার মা দেখলো সে আসছে হাতে শাড়িটা নেই, বরং সেটা রয়েছে এক অচেনা মহিলার শরীরে, ঘন কালো চুলে মহিলার পিঠ ঢাকা, পায়ের লাল টুকটুকে আলতা, হাতে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ ।
সবাই ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব, মনে হলো উমা স্বয়ং যেন হেঁটে হেঁটে আসছে মন্দির প্রাঙ্গণে , শুধু সে না সাথে সাথে তার ছোট্ট মেয়ে সে পরেছে লাল শাড়ি, হাতে পদ্ম ফুল, পায়ে নূপুর , ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে তাতে , রং তুলি দিয়ে আঁকা তৃতীয় চোখ থেকে যেন জ্বলজ্বল করে বেরোচ্ছে রশ্মি ।
পুরোহিত মশাই ইতিমধ্যেই অজ্ঞান এসব দেখে , তারপর শারদা সব ঘটনা সবাইকে বললো , আর এও বললো যে মায়ের মাটির মূর্তিকে শাড়ি পরালে মা হয়তো এভাবে খুশি হতেন না , আর আমার ইচ্ছের প্রতি মা খুবই দায়িত্বপূর্ন ছিলেন তাই স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে নিজেই এসেছিলেন ষষ্ঠীর দিন আমার কাছে খাবার খেতে ।
সবার চোখে জল, মন্দিরের সব বিবাহিত মহিলারা ওই জ্যান্ত দুর্গাকে বরণ করলেন , পুরোহিত মশাই ঘোষণা করলেন ওই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটিকে কুমারী হিসেবে পুজো করা হবে , কুমারী পুজোয় ।
তিন দিন পর
দেখতে দেখতে আজ বিজয়া দশমী , মায়ের বিদায় বেলা ।
আজও হয়তো সেই মহিলাও নিজের বাড়ি ফিরে যাবেন অনেক দিন হলো এখানে আছে ।
শারদা রীতিমত তাকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু কোথাও তার দেখা নেই , মন্দিরের ভেতরে গেলো পুরোহিত মশাইয়ের কাছে খবর নিতে সেখানে গিয়ে জানলো যে সে চলে গেছে, কিন্তু আশীর্বাদ হিসেবে রেখে গেছে সেই তার কেনা শাড়ির আঁচলের এক টুকরো অংশ তাতে রয়েছে একটা পদ্ম ফুল আর নূপুরের ঘুঙুরটা।
শারদার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো , সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঠেকালো ওই অনাকাঙ্খিত আশীর্বাদ ,
মন্দিরে শুরু হলো সিঁদুর খেলা।
কলমে : সুনন্দা চক্রবর্তী