কালিন্দী
কালিন্দী
ওরে রুমু তাড়াতাড়ি কর, হাতে কি আর সময় আছে নাকি, সেই সকাল থেকে মালা গাঁথতে বসেছিস, বলি এখনও মেলা কাজ বাকি ।
উফফফফ বড়মা তুমি এত চিল্লাচিল্লি করোনা তো, এত বড় মালা গাঁথা কি সহজ কাজ গো, ১০৮ টা ফুল যতবার গুনে গুনে ঠিক করে রাখছি একটা না একটা গোলমাল হচ্ছেই, পচাকে দিয়ে এই নিয়ে চার বার ফুল আনলাম , তুমি বলো এতে আমার দোষ কোথায়, আর এখানে তো আমি ছাড়া কেউ নেই যে বলবো কেও বদমায়েশি করে নিয়ে পালাচ্ছে ।
জানিনে বাপু তোর জ্যাঠামশাইকে কতবার বললাম একটা ভালো করে হোম যজ্ঞ করে তবেই নতুন মন্দিরে পুজো শুরু হবে, সে জমিদার শোনে নাকি আমার কথা ।
যাক গে তুই বরং বাকি কাজ গুলো করে নে বুঝলি , আমি দেখে আসি ভোগের বন্দোবস্ত কতদূর ।
বড়মা তোমার কি এখনো মনে হয়না ওই পুরনো রঘুডাকাতের তৈরি করা মন্দিরে শুধু শ্যাম বর্ণের ওই বাউরী মেয়েটা মায়ের মন্দিরে উঠেছিল বলে ওই মন্দিরে ছেড়ে মাকে এখানে আনা হলো, এটা কোনো ঠিক কাজ হলো । জানো বড়মা আমার খালি মনে হচ্ছে মা যেন রুষ্ট হয়েছেন, তাই পুজোতে একটার পর একটা অঘটন ঘটেই যাচ্ছে ।
দেখ রুমু আমি হয়তো তোর কথা বিশ্বাস করলাম কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ আছে, যাকে বললে লাভ হবে তিনি তো কোনো কথা শুনতেই রাজি নন, নিজের জেদে সদা স্থির । যাক গে আমি যাই , কথা বলতে বলতে অনেকটা দেরি হলো বুঝলি ।
*পুজোর দিন সন্ধে ৬ টা*
প্রমীলা এই প্রমীলা , কোথায় সব , বলি পুজোর জোগাড় জন্তর হলো না হয়নি , ঠাকুর মশাই এলে কিন্তু ওনাকে আমি সোজা পুজোয় বসাবো , আমি কিন্তু তোমাদের কাজে ফাঁকি দেওয়া একদম পছন্দ করছিনে, এই আমি বলে রাখলাম ।
কর্তা মশাই , ও কর্তা মশাই শুনছেন , শিগগিরি আসুন , দেখুন কি কান্ড !
কি হয়েছে রে নগেন এই পুজোর দিনে বেয়াদপের মত চিল্লাচ্ছিস কেন ? কি হয়েছে দেখি....
এই দেখুন কর্তা মশাই মায়ের খাড়াটা দুটুকরো হয়ে পড়ে আছে ।
কিন্তু নগেন এ কি করে সম্ভব এই ভারী লোহার খাড়াটা দুটুকরো হলো কিভাবে ?
মন্দিরে নানান সব ঘটনা দেখে জমিদার সাহেব মূর্ছা গেলেন , কবিরাজ বদ্দি সব এসেও কোনো কাজ হলো না আধ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলো তখন কর্তা মশায়ের , কিন্তু অবস্থা খুবই শোচনীয় , তাই ঘুমতে দেওয়া হলো কিছুক্ষন । এদিকে যথারীতি সবাই চিন্তিত, আবার পুজোর কাজে মন না দিলেও নয় ।
সন্ধ্যে ঠিক ৭.৩০ বাজে, কর্তা মশাই উঠে এসেছেন বাইরে, খানিকটা সুস্থ আগের চাইতে , কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ঘুম থেকে উঠে এই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না । ইতিমধ্যে প্রমীলা ওনার জন্য নিয়ে এসেছেন নুন চিনির সরবত, শরীরে খানিক বল পাবেন এই ভেবে ।
প্রমীলা : জমিদার মশাই নিন তো এই নুন চিনির সরবতটা একটু খেয়ে নিন ভালো লাগবে ।
কর্তা মশাই : প্রমীলা , প্রমীলা শিগগিরি এই পুজো বন্ধ করতে বলো , বন্ধ করতে বলো সব আয়োজন ।
প্রমীলা (অবাক হয়ে) : এসব আপনি কি বলছেন জমিদার মশাই ? আর কিছুক্ষণ পরেই তো পুরোহিত মশাই চলে আসবেন আর আপনি বলছেন পুজো বন্ধ করতে।
কর্তা মশাই : ওরে তোরা কে কোথায় আছিস , তাড়াতাড়ি আয় , মাকে নিয়ে পুরনো মণ্ডপে যেতে হবে , নইলে মা যে আজ পুজো পাবেনা রে ।
প্রমীলা : কর্তা মশাই এসব কি বলছেন ? আপনি এভাবে ব্যস্ত কেন হচ্ছেন আর মাকে ওই মন্দিরে নিয়ে যাবেন মানে ?
আপনিই তো মায়ের জন্য এই মন্দির তৈরি করালেন, ওই মন্দির তো অপবিত্র ।
কর্তা মশাই : না প্রমীলা না , মা আজ আমার চোখে আঙুল দিয়ে সবটা দেখিয়ে দিয়েছেন ।
জানো তোমরা জানো সবাই যে মাকে আমি দেখার জন্য এত বছর পুজো করে আসছি সেই মা আমার পুজোয় সন্তুষ্ট হননি , আমি তার দেখা পেলাম ঠিকই কিন্তু মা যে বড়ই রুষ্ট আমার উপর আজ ।
মায়ের অত ভারী লোহার খাড়াটা দু টুকরো কিভাবে হতে পারে । মা আমায় স্বপ্ন দেয়, যে আমি যে মেয়েকে মন্দিরে ঢোকার জন্য অপমান করেছি, মন্দিরকে অপবিত্র ভেবেছি সেটা আসলে অন্য কেউ নয় , সে আমাদের সকলের মা , মা কালী, মা দয়াময়ী ।
আজ মা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন জাত পাতের বিচার করে ঈশ্বর ভক্তি চলেনা , যেখানে মা নিয়েই শ্যামল বর্ণ সেখানে আমি সাধারন মানুষকে কিভাবে অপমান করতে পারলাম ।
মা , মা গো আমায় তুমি ক্ষমা করো মা, আমি কথা দিচ্ছি মা , তোমার পুজো ওই রঘুডাকাতের তৈরি করা মন্দিরেই হবে, আমি বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি মা , সেটা তুমি আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে ।
প্রমীলা গ্রামের সবাই আজ উপস্থিত থাকবে মন্দিরে, আর মায়ের পুজো করবে স্বয়ং মেয়েরা , মেয়েদের হাত দিয়ে শুরু হবে মায়ের পুজো ।
ওরে তোরা আর দেরি করিসনে যা নতুন খাড়া আনানোর ব্যবস্থা কর আর আরেকটা ঘোষণা আজ থেকে পশুবলি বন্ধ করলাম আমি ।
রঘু ডাকাত ছিল ঠিকই তবে
তোমার পরম ভক্ত ছিল মা, আর তার ডাকাতির প্রাপ্য জিনিসও বিলিয়ে দিতে গরিবদের ।
তাই আমিও আজ থেকে জনগণের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করবো , কাল সবার মন্দির প্রাঙ্গণে হবে নরনারায়ান সেবা , আমার বিশ্বাস মা ঠিক এসে প্রসাদ করবেন ।
জয় মা কালী , ভদ্রকালী কাপালিনী ।
পুজো শুরু হলে কালিন্দীও মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলো , জমিদার মশায় সবার সামনে ক্ষমা চাইলেন কালিন্দীর কাছে " আমায় ক্ষমা করে দিস রে মা , আমার খুব বড়ো ভুল হয়ে গেছে , আমার এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আমি চাই মাকে এই ১০৮ জবার মালাটা তুই পরা।"
পাস থেকে রুমু বলে উঠলো
"কিন্তু জ্যাঠা মশাই, এই মালাটা সকাল থেকে গাঁথছি আমি প্রতিবারেই একটা বা দুটো ফুল কম পড়ছেই, এখনও হয়তো তাই , এই নিয়ে পাঁচ বার হলো , এরপর কি করি বলতো আমি !"
কালিন্দী : রুমু দিদি আমাকে একবার দাও গুনে দিকি, যদি ঠিক থাকে তো কর্তা মশায়ের কথা মত পরিয়ে দেবো আর নইলে আমি ফুল এনে দেবো আবার গেঁথে নিও ।
অবাক করার বিষয় হলো ১০৮ টায় ফুল ছিল আর সেটা কালিন্দী খুব সহজেই মায়ের গলায় পরিয়ে দিল।
একেই হয়তো বলে মহামায়ার লীলা ।
জয় মা কালী বলে চেচিয়ে উঠলো সবাই ।